Tuesday, October 26, 2021

শেওড়াফুলির নিস্তারিণী মা >P

শেওড়াফুলির নিস্তারিণী মা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 





বহুদিন পূর্বের কথা তখনও শেওড়াফুলি নাম হয়নি, সাড়াপুলি নামটা  সকলের কাছে পরিচিত ছিল।  এই সাড়াপুলিতেই গঙ্গার ধারে ক্ষত্রিয়রাজ মনোহর রায়ের পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায়ের প্রপৌত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র রায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজা হরিশ্চন্দ্র ছিলেন পরম ধার্মিক,  নিষ্ঠাবান ও দেবী কালিকার ভক্ত। কথিত আছে, রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়ের প্রথম পত্নী সর্বমঙ্গলা দেবীর অপমৃত্যু হয়।  এই কারণে তিনি পন্ডিতদের শরণাপন্ন হন। পন্ডিতদের বিধান অনুসারে তিনি তাঁর স্ত্রীর আত্মার শান্তি কামনায় তাঁর রাজ্যে গঙ্গা তীরবর্তী স্থানে এই মন্দিরটি  স্থাপন করেন। মন্দিরটি বিশালাকার। মন্দিরে তিনি শিবপত্নী দক্ষিণাকালী শ্রী শ্রী নিস্তারিণী মাতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সালটা ছিল ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ (১২৩৪ বঙ্গাব্দ)।  

এখানকার দেবী নিস্তারিণীর সাথে একটি কাহিনীর কথা প্রচলিত রয়েছে। একবার রানী রাসমণি বেশ কয়েকটি বজরায় দাস-দাসী সমেত বেনারসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তখনও  দক্ষিনেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির তৈরী হয়নি।  যখন তাঁদের  বজরা শেওড়াফুলি ঘাটের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন রানীমা  দেখতে পেলেন যে ঘাটের ধারে একটি পরমাসুন্দরী কিশোরী তাঁকে ডাকছে। ঘাটে বা ঘাটের আশপাশে আর কারোকে দেখা যাচ্ছে না। কিশোরীর মনোমুগ্ধকর রূপ দেখে রানীমা মোহিত হয়ে গেলেন। রানীমা অবশ্য পূর্বেই জানতেন যে এখানে দেবী নিস্তারিণীর একটা সুন্দর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তিনি তাঁর  মাঝিকে ঘাটে বজরা ভিড়াতে বললেন।  ঘাটে এসে তিনি ওই কিশোরীকে দেবী নিস্তারিণীর কাছে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিতে বললেন। কিশোরী তাঁকে বললেন  আমিতো ওখানেই থাকি। রানী মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিশোরীকে অনুসরণ করলেন।  মন্দিরের কাছাকাছি আসার পর কিশোরী তাঁকে জানালেন এই পথ ধরে আর একটু এগোলেই নিস্তারিণীর মায়ের থান তিনি দেখতে পাবেন। একথা বলে হঠাৎ  কিশোরী কোথায় মিলিয়ে গেলো। রানী আর কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না। রানীমা দেবী নিস্তারিণীর সাথে ওই কিশোরীর একটা অপার্থিব মিল খুঁজে পেলেন। তিনি দেবীদর্শন ও দেবীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। এই কাহিনীর কথা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। 

এই কালী মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের একটা প্রাচীন কালীমন্দির। মন্দিরটি অল্প উচ্চতার ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত। সমতল ছাদযুক্ত। মন্দিরটির দক্ষিণদিকে দালান রয়েছে। মন্দিরের সামনের দিকে সাতটি  খিলান আর পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাঁচটি খিলান রয়েছে। খিলানগুলি সব থামের উপর স্থাপিত। মন্দিরের চারদিকে বারান্দা রয়েছে। মন্দিরটির ডানদিকে রয়েছে একটি নাটমন্দির। নাটমন্দিরের বেশিরভাগ অংশে দোকান রয়েছে। মন্দিরের মধ্যে কয়েকটি ঘর রয়েছে। মন্দিরের সামনের দিকের ঠিক মাঝখানের ঘরটিতে পঞ্চমুন্ডীর আসনে একটি তামার পদ্মাসনের  উপর নিস্তারিণী দেবীর বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেবী বিগ্রহের পদতলে শায়িত রয়েছেন মহাদেব। এখানে দেবী চতুর্ভূজা। দেবীর বামদিকের ওপরের হাতে তরবারি ও নিচের হাতে নরমুণ্ড বিদ্যমান। দক্ষিণের দুটি হাত দিয়ে দেবী বর ও অভয় দান করছেন। মাঝের ঘরটির দুপাশে দুটি ঘরে দুটি শ্বেতপাথরের শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেবী নিস্তারিণীর ঘরে দুটি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। গর্ভগৃহের সামনে অলিন্দ। এছাড়া মন্দিরের মধ্যে দুটি ঘরে রাজবংশের দুটি প্রাচীন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। একটি ঘরে কৃষ্ণরাযের বিগ্রহ রয়েছে। এই কৃষ্ণরায়ের বিগ্রহটিকে বর্ধমান জেলার পাটুলি গ্রাম থেকে নিয়ে এসে এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।ওপর একটি ঘরে পাটুলী রাজবংশের কুলদেবী মহিষাসুরমর্দিনীর একটি মূর্তি রয়েছে। এখানকার সবকটি বিগ্রহকে নিত্যপূজা করা হয়। মন্দির চত্বরে ভোগ রান্নার একটি ঘর রয়েছে। মন্দির চত্বরেই পূজা সামগ্রী, নিত্য ব্যৱহৃত সামগ্রীর দোকান ও খাবারের  দোকান রয়েছে।  

রাজ বংশের সদস্য শ্রী আশীষ ঘোষ মহাশয় জানালেন যে সম্প্রতি মন্দির ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ৮০ হাজার টাকা ব্যয় মন্দির চত্বরে ১৪ টা  ক্লোজ সার্কিট টিভি লাগানো হয়েছে। এখন পুলিশ ফাঁড়িতে বসেই মন্দির চত্বরে নজরদারি করা হচ্ছে।  

সকলের বিশ্বাস দেবী নিস্তারিণী খুবই জাগ্রত দেবী। সকলের সব রকম মনোস্কামনা তিনি পরিপূর্ণ করেন বলে সবাই মনে করে থাকে। তাই এখানে স্থানীয়রা ছাড়াও বহু দূর দূরান্ত থেকে বহু ভক্তের সমাগম হয়। গঙ্গা স্নান করে মায়ের পূজার মাধ্যমে তারা মায়ের কাছে তাদের মনোস্কামনা নিবেদন করেন।  


 মন্দির খোলার সময় : 

সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত আর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত্রি নয়টা সময় পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। বিশেষ বিশেষ দিনে অবশ্য বিশেষ পূজার জন্য অবশ্য মন্দির  অধিক সময় খোলা থাকে। 


কিভাবে যাবেন : 

হাওড়া স্টেশন থেকে শেওড়াফুলি স্টেশনে এসে নামুন। মন্দিরটি একদম স্টেশনের পাশে অবস্থিত। 

তারিখ : ২৪-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Sunday, October 24, 2021

সুখরিয়ার মিত্রমুস্তাফিদের আনন্দ ভৈরবী কালী মন্দির>P


সুখরিয়ার  মিত্রমুস্তাফিদের আনন্দ ভৈরবী কালী মন্দির  

- সুদীপ্ত মুখার্জী 






সুখরিয়া পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটা সুপ্রাচীন গ্রাম। গ্রামটি সোমড়াবাজার  ও বলাগড়ের  মধ্যে অবস্থিত।  গ্রামটির অলিতে গলিতে রয়েছে ঐতিহাসিক সব নিদর্শন।  মিত্র মুস্তাফি পরিবারের সন্তান অনন্তরাম এই গ্রামে এসে রাধাকুঞ্জ নামক একটা সুবিশাল প্রাসাদ বানান। গ্রামটির ঐতিহ্য এই রাজপ্রাসাদ ও রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মন্দিরকে  নিয়ে । এখানকার ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ী ও মন্দিরগুলো পর্যটকদের এখানে টেনে নিয়ে আসে। এখানকার মন্দির স্তাপত্যগুলো বৈচিত্রে ভরা।  






রাজবাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে সবুজ প্রকৃতির মধ্যে টুকটুকে লাল রঙের টেরাকোটার আনন্দ ভৈরবী মন্দির সুখরিয়ার সব থেকে আকর্ষণীয়। এক অসাধারণ মন্দির। এই মন্দিরটি বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরটির আকর্ষণে দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা আসে।  মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল ১৮১৩ সালে। রাজ পরিবারের সন্তান বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফি মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। কথিত আছে সেই সময় মন্দিরটি নির্মাণ করতে প্রায় লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়েছিল। মন্দিরটি উচ্চতায় ৭০ ফুট ২৮ ইঞ্চি। পঁচিশটি চূড়া বিশিষ্ট। মন্দিরটিতে টেরাকোটা শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন রয়েছে। মন্দিরের গায়ে টালির উপর নানা দেবদেবীর মূর্তি উল্লেখযোগ্য। বেদীর উপরে শায়িত শিবের উপর দেবী আনন্দময়ী ভৈরবী উপবিষ্টা। দেবী মূর্তির উচ্চতা তিন ফুট। মূর্তিটি কষ্টি পাথরে তৈরী।  মন্দিরের অভ্যন্তরে পাথরে গড়া বেশ কিছু দেবদেবীর মূর্তি পরিলক্ষিত হয়। 

 

মূল মন্দিরের দুপাশে দুটো সারিতে রয়েছে ১২টা ছোট মন্দির। এক একটি  সারিতে ছয়টি করে মন্দির বিদ্যমান।  দুটি সারিতে একটি করে মোট দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির রয়েছে আর বাকি মন্দিরগুলো আটচালা বিশিষ্ট। পঞ্চরত্ন মন্দির দুটিতে গণেশের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে আর বাকি আটচালা মন্দিরগুলোতে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। 



১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের সময় মন্দিরের সর্বোচ্চ পাঁচটি চূড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীকালে মন্দিরটির পাঁচটি চূড়াকে নতুন করে তৈরি  করা হয়। এখানকার সমস্ত মন্দিরগুলোকে সারিয়ে নতুনভাবে রঙ  করা হয়েছে।  

মন্দির খোলা

সকাল ছাড়তে থেকে বিকেল ছয়টা পর্যন্ত বাইরে থেকে দেখা যায়।  

কীভাবে যাবেন

শিয়ালদহ  বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকালে করে পৌঁছতে হবে সোমড়াবাজার স্টেশন। তারপর ভ্যান বা টোটো-এ চেপে খুব সহজেই  পৌঁছে যান সুখরিয়া।



তারিখ : ২৪-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



 

Wednesday, October 20, 2021

সুখরিয়ার বিশ্বাস বাড়ির পূজা >P

সুখরিয়ার বিশ্বাস বাড়ির পূজা 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 








পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা যেখানে সর্বপ্রথম বারোয়ারি পূজা শুরু হয়েছিল। সেই  জেলাতেই তিন শত বছর অতিক্রম করা এক পারিবারিক দুর্গাপূজা হয়ে চলেছে। সাবেকি বাড়ির প্রাচীন দুর্গাপূজা। এই পূজার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এক জমিদার পরিবারের কাহিনী। 

এই জমিদার পরিবারের ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় তিনশো বছর পূর্বে। ১৬৫৭ সাল।  নদীয়া জেলার টেকা গ্রাম থেকে শান্তিপুরের বিখ্যাত গুরুমহাশয় মোহন মিত্র উঠে আসেন  ওই জেলারই উলা গ্রামে। নদীয়া জেলার  উলা গ্রামটি বর্তমানে বীরপুর নামে প্রসিদ্ধ। এই মোহন মিত্রের পুত্র ছিলেন রামেশ্বর মিত্র।  তিনি উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। তখন বাংলার গভর্নর ছিলেন শায়েস্তা খান এবং বাংলার নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ।  রামেশ্বর তার পিতার পন্ডিতি ব্যবসা ছেড়ে নবাব মুর্শিদকুলির শাসনকালে সুবে বাংলার রাজস্ববিভাগের নায়েব কানুনগো ছিলেন।  ১৭০৪ সালে তাঁর কাজের পারদর্শিতার জন্য দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেব রামেশ্বরকে 'মুস্তাফি' উপাধি প্রদান করেন। রামেশ্বর এই চাকরি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তিনি নদীয়া জেলায় একটি জমিদারি এস্টেট ক্রয় করেন। পরবর্তী সময় তিনি তাঁর  জমিদারির সম্পত্তি আরো বৃদ্ধি করেন।  তিনি ধীরে ধীরে জমিদার হিসেবে পরিচিত হন।

তিনি জমিদার হলেও অন্য জমিদারদের মতো কখনোই ভোগ বিলাসে নিজেকে ডুবিয়ে দেন নি।  পরবর্তীকালে গঙ্গা নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে উলা গ্রাম থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে শুরু করে।  তার ফলে উলার গৌরব ও সমৃদ্ধি কমতে থাকে। মিত্রমুস্তাফি পরিবার ভেঙে তিন ভাগ হয়ে যায়। রামেশ্বর মিত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র রঘুনন্দন  ১৭০৮ সালে (১৬৩০ শকাব্দ) গঙ্গার  নদীর পূর্বতীরে উলা গ্রাম থেকে পশ্চিমতীরের হুগলী জেলার আটিশেওড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং গ্রামটির নতুন নামকরণ করেন শ্রীপুর। রামেশ্বেরের আর এক পুত্র অনন্তরাম এই শ্রীপুর গ্রামের কিছুদূরে সুখরিয়া গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। এই অঞ্চলগুলো সেই সময় বাঁশবেড়িয়ার রাজা রঘুদেবের জমিদারির মধ্যে ছিল। বাঁশবেড়িয়ার রাজা রঘুনন্দন মিত্রমুস্তাফিকে আটিশেওড়া  গ্রামে ৭৫ বিঘা ভূসম্পত্তি দান  করেন। সেই জমিতেই রঘুনন্দন দীঘি, পুষ্করিণী, চণ্ডীমণ্ডপ প্রভৃতি নির্মাণ করেন।  





অনন্তরামের নাতি রামজীবন মিত্র মুস্তাফি  সুখরিয়াতে একটা সুবিশাল প্রাসাদ ও একটি মনোরম ঠাকুরদালান নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদেই ঠাকুরদালানের ঠিক পাশে রয়েছে রত্নেশ্বর মিত্র মুস্তাফির  প্রতিষ্ঠিত  শিবমোহিনী দুর্গার মূর্তি।  তার সাথে একটি রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তিও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।  শিবমোহিনী দূর্গা ও আনন্দময়ী কালী এনাদের কুলদেবী।  আমি আজ সুখরিয়া  রাজবাড়ীর দুর্গাপূজা নিয়ে আপনাদের জানাবো। 

সুখরিয়ার গ্রামটি হুগলি জেলার বলাগড়  ও  সোমড়াবাজারের  মধ্যবর্তী একটা গ্রাম। এক গ্রামেই জমিদার রত্নেশ্বর মিত্র তাঁর প্রাসাদ ও বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদ ও মন্দিরগুলোকে দেখলে তাঁর শিল্পকলা ও স্থাপত্যের নিদর্শন অনুমান করা যায়। রত্নেশ্বর মিত্রমুস্তাফির পুত্র রাধাজীবনের তিন কন্যা ও এক পুত্র ছিল। যোগমায়াদেবী দাসী, পদ্মাবতী দাসী ও ভবভাবিনী দাসী এই তিন কন্যা ও ক্ষেত্ৰনাথ নামে এক পুত্র ছিল।  তাঁর একমাত্র পুত্র ক্ষেত্ৰনাথ বসন্ত রোগে মারা যায়।  তাঁর তিন কন্যার মধ্যে একজনের বিবাহ হয় শোভাবাজার রাজবাড়ীর যতীন্দ্র মোহন দেবের  সহিত, একজনের  বিবাহ হয় রানাঘাটের জমিদার বিনোদ বিহারি বিশ্বাসের সহিত আর এক কন্যার কলকাতার ব্যবসায়ী যতীন্দ্রনাথ ঘোষের সহিত বিবাহ হয়। সুখরিয়ার এই বাড়িটি বর্তমানে বিনোদ বিহারি  বিশ্বাসের পরিবারের উত্তরপুরুষদের অধীনে রয়েছে। বংশের কোনো পুত্র সন্তান জীবিত না থাকার  জন্য বিশ্বাস পরিবার দীর্ঘকাল ধরে  রাজবাড়ির এই দুর্গাপূজাটি বজায় রেখে চলেছেন। 


 



এখানে রয়েছে  মিত্রমুস্তাফিদের নির্মিত ভগ্নপ্রায় একটি ঠাকুরদালান। এই ঠাকুর দালানে আজও বেশ ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়ে থাকে। 

এখানকার দেবীমূর্তি দশভুজা।  ঘোড়ার মুখবিশিষ্ট সিংহ এখানে দেবীর বাহন। পূজার দিন সাতেক পূর্বে বোধন শুরু হয়। এখানে বৈষ্ণব মতে পূজা করা হয়।   প্রত্যেকদিন সকাল বিকেল দুইবেলা পূজা করা হয়।  সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী এই তিনদিনই এখানে বলি দেওয়া হয়।  পূর্বে মহিষ বলি দেওয়া হত কিন্তু বর্তমানে চালকুমড়া, আখ বলি দেওয়া হয়। পূজার কটাদিন ভোর চারটের  সময় মঙ্গলারতি করা হয়। মঙ্গলারতির সময় প্রত্যেকদিন দেবীকে মাখন ও মিশ্রি দেওয়া হয়।  দেবী মূর্তি এখানকার ঠাকুরদালানেই নির্মিত হয়। নবপত্রিকাকে কোন পুকুর বা নদীতে স্নান করানো হয়না।  তাঁকে ঠাকুরদালানেই স্নান করানো হয়। দেবীকে ভোগ হিসেবে লুচি, তরকারি, বিভিন্ন ফল ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।  এছাড়া কাঁচা ডাল, বিভিন্ন সবজি, তেল দেবীকে বোধনের পর থেকে প্রতিদিন দেওয়া হয়।  প্রত্যেকদিন সন্ধিপূজা করা হয়। অষ্টমীর দিন কুমারী পূজা করা হয়। এখানে বরণ  ও কনকাঞ্জলি প্রথা রয়েছে কিন্তু  সিঁদুরখেলার  কোনো নিয়ম নেই।  পূজায় বাড়ির মহিলারা বাইরের পুরুষদের সামনে আসতেন না। পূজার সময় পূজার দালানে আসতেন কিন্তু তখন বাইরের কেউ বাড়ির ভিতরে থাকতো না।  তাই বিসর্জনের সময় যেহেতু বাইরের লোকজন ঠাকুরদালানে থাকতো তাই সেইসময় বাড়ির মহিলারা অন্দরমহল থেকে জানালা দিয়ে  দেবী দুর্গার চলে যাওয়া দেখতেন। এককালে দুর্গাপুজোর সময় এখানে যাত্রাপালা, কবিগান, নাটকের  আসর বসত। 
  
  মিত্রমুস্তাফি বা বিশ্বাস পরিবারের কেউ আজ আর এখানে বসবাস করেন না কিন্তু দুর্গাপূজার সময় তাঁরা ঠিক তাঁদের ভদ্রাসনে ফিরে আসেন। ঐতিহ্যের বাতি আজ আর সেভাবে জ্বলে ওঠে না। তাঁরা যতটা সম্ভব  নিয়ম রক্ষা করে কোনোভাবে পূজাটি বজায় রেখে চলছেন। এই রাজবাড়িতেই মৃনাল সেন তাঁর "অকালের সন্ধানে" সিনেমার শুটিং করেছিলেন। 


তারিখ : ২০-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 






Friday, October 15, 2021

কালো দূর্গার আরাধনা চলছে তিলোত্তমাতেই >P

কালো দূর্গার আরাধনা চলছে তিলোত্তমাতেই  


- সুদীপ্ত মুখার্জী 




আমরা ছোটোবেলা থেকেই জেনে এসেছি কালী মাতার গায়ের রং কালো অর্থাৎ তিনি কৃষ্ণবর্ণা হন।  কিন্তু এবার আমি দেখে এলাম কালো দূর্গা মানে কৃষ্ণবর্ণ দেবী দূর্গা। তাও সেই পূজাটি খোদ কলকাতার বুকেই অনুষ্ঠিত হয়। বেশ আড়ম্বরের সাথে বেলেঘাটার ভট্টাচার্য্য পরিবারে কৃষ্ণবর্ণ দেবী দূর্গা পূজিত হন। 

অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্থলবসন্তপুরের জমিদার ছিলেন হরিদেব  ভট্টাচার্য্য।  তিনি আসলে  ছিলেন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার বাসিন্দা। নাটোরের মহারানী ভবানী তাঁকে  পাবনা জেলার স্থলবসন্তপুরের জমিদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি  তাঁকে ওই অঞ্চলের জমিদারি স্বত্ব প্রদান করেন। কথিত রয়েছে, যে এই ভট্টাচার্য্য পরিবারে বহু পূর্ব থেকেই মা কালীর পূজা করা হত।  শোনা যায় হিমালয়ের পাদদেশে কোনো কোনো জায়গায় নাকি কৃষ্ণবর্ণের অতসীপুষ্প ফোটে। এই ফুল অতীব দুষ্প্রাপ্য।  দেবীর হয়তো ইচ্ছা হয়েছিল কৃষ্ণবর্ণরূপে পূজা পেতে। তাই তিনি নাকি কারোকে স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর এই রূপকে পূজা করার।   



তেমনই এক স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন স্থলবসন্তপুরের জমিদার হরিদেব ভট্টাচার্য্য মহাশয়। তিনি স্বপ্নে এরকম কৃষ্ণবর্ণ দেবীকে দেখেছিলেন। তিনি স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর তার জমিদারিতে প্রথম দুর্গাপূজা করেন।  রানী ভবানীর আমলেই সেই পূজা শুরু হয়েছিল।  সেই থেকেই আজও  ভট্টাচার্য্য পরিবারে কালো দূর্গা প্রতিমা পূজিত হয়ে আসছে। যা এবছর ২৮৯ বছরে পদার্পন করলো। 

পূজা শুরু করার পূর্বে জমিদারবাবু প্রথমে মায়ের এই বিচিত্র রূপের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন।  তিনি ভাটপাড়া ও কাশীর পন্ডিতদের সাথে কথা বলেন কিন্তু তাদের ব্যাখ্যায় তাঁর মনঃপুত হল না।  এমতাবস্থায় একদিন হরিদেববাবু মনমরা হয়ে কাশীর গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলেন। সেই সময় একজন সাধু তার কাছে এসে জানতে চাইলেন কেন তিনি এইরকম বিষণ্ণভাবে বসে আছেন,  তার সমস্যাটা কোথায়? 
সব কিছু শুনে তিনি মাকে ভদ্রকালী রূপে পূজা করার কথা তাঁকে  বললেন।  তাঁকে  তালপত্রে লেখা এক প্রাচীন পুঁথি দেন  এবং তাঁকে এই পুঁথি অনুসরণ করে পূজা করতে বললেন।  

দেবী এখানে কৃষ্ণবর্ণ হলেও তার সন্তানদের গাত্রবর্ণ কিন্তু সাদা হয়। মহিষাসুরের গাত্রবর্ণ হয় সবুজ।দেবীর ডানপাশে থাকেন দেবী লক্ষ্মী ও কার্তিক আর বামপাশে থাকেন দেবী সরস্বতী ও গণেশ। পূজাটি দীর্ঘদিন যাবৎ স্থলবসন্তপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার পর পরিবারের সদস্যরা কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে এসে  বসবাস শুরু করেন।  তখন থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এখানে পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। শাক্ত মতে পূজা হয়। পূর্বে বলিদান প্রথা থাকলেও বর্তমানে চালকুমড়া  বলি দেওয়া হয়। সন্ধিপূজার সময় দেবীকে মাছভাজা দেওয়া হয়। সকালে নিরামিষ ও সন্ধ্যায় দেবীকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। দশমীর দিন দই, কলা, পান্তাভাত সহযোগে দেবীকে আপ্যায়িত করা হয়।  

প্রাচীন রীতি নীতি মেনে আজও পূজা করা হয়। পরিবারের নতুন প্রজন্ম সেই ঐতিহ্যকে যতটা সম্ভব বজায় রেখে চলেছে। স্থানাভাবের  জন্য বাড়িরই নীচে দেবী পূজা হয়ে থাকে।  পদ্মা  পেরিয়ে গঙ্গাপাড়ে এসেও তাদের পূজার জৌলুশ কিন্তু একদমই কমেনি।  



তারিখ : ১৫-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 







Sunday, October 10, 2021

হবু আইনজীবীর কাগজের দূর্গা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 





অমুক ধারার তমুক অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে অথবা অমুক অংশের এত নম্বর পৃষ্ঠায় কোনো কেসের কথা বলা রয়েছে। একজন আইন পড়ুয়ার এইসব পড়তে পড়তে যখন একঘেয়েমি লাগে তখন তার মনটা  অবশ্যই  চায় একটু আনন্দে ভাসতে, একটু ঘুরে আসতে অথবা কোনো শিল্পকর্মের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নিতে।  আজ আমি এমনই এক ছাত্রের কথা আপনাদের বলবো। জলপাইগুড়ি নিবাসী আইন পড়ুয়া ছাত্র কুণাল বিশ্বাস। হরপ্রসাদ ও বুলা দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান কুণাল। প্রথাগতভাবে আঁকা বা ভাস্কর্যের কোনোরূপ শিক্ষা সে কোনোদিন পায়নি, অথচ তার শিল্প নৈপুণ্যতা সকলকে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। 

তার পিতা জলপাইগুড়িতে একটি মোটর ড্রাইভিং স্কুলের কর্ণধার। কুণাল ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে তার পিতা হরপ্রসাদ বাবুকে  তার দিদির স্কুলের নানারকম আঁকা ও কর্মশিক্ষার বহুরকম জিনিস তৈরী করে দিতে। সেই বাচ্চা বয়স থেকেই এই ধরণের শিল্প কর্মের ওপর তার একটা ঝোঁক জন্মায়।  বাবার কাছে তার হাতেখড়ি হয়।  সে ছোটবেলা থেকেই আঁকা, মাটি ও প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে নানান রকম মডেল তৈরী করতো। প্রথম দিকে শিল্পের প্রতি তার ভালোবাসা ও আগ্রহ জন্মায় পরে ধীরে ধীরে সে তার শখকে নেশায় পরিণত করে।  এই ব্যাপারে অবশ্য সে বরাবর পরিবারের সহায়তা পেয়ে এসেছে। বাবার প্রশ্রয়েই বয়সের সাথে সাথে শিল্পের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে সে মাটি দিয়ে একটা বড় সরস্বতীর মূর্তি বানায়।  তারপর থেকে সে প্রতিবছর দেবী সরস্বতীর মূর্তি বানাতে থাকে।  
 

এইভাবে চলতে চলতে সে কাগজ দিয়ে মূর্তি বানানোর কথা ভাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ।  আর্ট পেপার, ভেলভেট পেপার, মার্বেল পেপার ও সংবাদপরের নিউজ  প্রিন্ট  ব্যবহার করে দূর্গা প্রতিমা বানিয়ে গতবছর সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। ফয়েল পেপার  দিয়ে সে মায়ের হাতের নানারকম অস্ত্র তৈরী করে।  মায়ের গহনা তৈরী করার জন্য অবশ্য সে চুমকি, পুঁথি, কাপড় ও কাগজ ব্যবহার করেছে। তার কাগজের মূর্তি দেখে পরিবারের সবাই, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সকলে তাকে অভিনন্দনে ভরিয়ে তোলে। তাকে আরো এগিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে তারা আরো উৎসাহ দিতে থাকে।  আইনের  কচকচালির ফাঁকে শিল্পকর্ম তার চলতে থাকে।  ইতিমধ্যে কুণাল তার কাগজের মূর্তির ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করেছে। তার মূর্তি দেখে সকলে খুব তারিফ করেছে। এবছর সে বাংলার রাজবাড়ীর আদলে ঠাকুরদালান এবং বীরভুম ও বাঁকুড়া জেলার পটচিত্রের মতো কাগজের সাহায্যে দেবী দুর্গার মূর্তি বানায়।  তার এই মূর্তিটিও  যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে। 



হবু আইনজীবীর শিল্পকর্ম আরও এগিয়ে যাক।  সে ভবিষ্যতে একজন প্রকৃত শিল্পী হয়ে উঠুক এই কামনা করি।  আদালতের আইনি জেরার সাথে চলুক তার শিল্পকর্ম।  তার শিল্প নৈপুণ্যতা শুধু জেলা নয় তা  ছড়িয়ে পড়ুক দেশ থেকে দেশান্তরে।  


তারিখ : ১০-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Saturday, October 9, 2021

চুঁচুড়া আঢ্য বাড়ির দুর্গাপূজা >P

চুঁচুড়া আঢ্য বাড়ির দুর্গাপূজা 


      - সুদীপ্ত মুখার্জী


হুগলি জেলার একটা সুপ্রাচীন জনপদ হল চুঁচুড়া। অনেকেরই জানা রয়েছে যে চুঁচুড়া বহুকাল পূর্বে ওলন্দাজদের ঘাঁটি ছিল।  আজও সেই আমলের বেশ কিছু স্থাপত্য শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।  এই শহরের দুর্গাপূজার কথা মনে আসলেই সবার প্রথমে আঢ্য বাড়ির দুর্গাপূজার কথা মনে পরে।  দেখতে দেখতে যা এবছর ২৮৭ বছরে পদার্পন করল। 

আঢ্য বাড়ির পূর্বপুরুষরা পূর্বে আদি সপ্তগ্রামে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে তাঁরা সেখান থেকে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় এসে বসবাস করতে থাকেন। তাঁরা প্রধানত ব্যবসায়ী পরিবার। পরিবারের সন্তান যোগীন্দ্রলাল আঢ্য ছিলেন  হুগলির স্টেশান মাস্টার। যিনি জগু মাস্টার নামে  অধিক পরিচিত ছিলেন। আঢ্য পরিবারের প্রাণপুরুষ ছিলেন সুবর্ণবণিক বদনচন্দ্র আঢ্য।  বদনবাবুই চুঁচুড়ার পঞ্চাননতলায় আঢ্য বাড়িতে তিন খিলানযুক্ত সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত একটি ঠাকুর দালান নির্মাণ করেন। এই ঠাকুর দালানে তিনি দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন।  পরবর্তীকালে যোগীন্দ্রলাল আঢ্যের সাত পুত্র ও তাঁদের উত্তরপুরুষরা পারিবারিক রীতি-নীতি মেনে পূজা করে আসছেন।  

এই পরিবারের দুর্গাপূজার সূচনা রথযাত্রার দিন কাঠামো পূজার মাধ্যমে শুরু হয়।  বংশ পরম্পরায় প্রতিমা গড়ে তুলছেন প্রতিমা শিল্পী। শুধু  প্রতিমাশিল্পী  নয়  পুরোহিত ও মিষ্টি তৈরির পাচকও বংশ পরম্পরায় কাজ করে চলেছেন। 

এখানে দেবী শিবদুর্গারূপে পূজিত হন। দেবী শিবক্রোড়ে অধিষ্ঠাতা। দেবী দ্বিভূজা অভয়দায়িনী শান্তিদাত্রী। তাঁর এক হাতে বরদানি ও ওপর দিকে তিনিও ভয়দায়িনীরূপে বিরাজিতা। দেবীর সাথে লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী এবং কার্তিক থাকেন।  প্রতিমা শোলা ও রাংতা  দিয়ে ডাকের সাজে সজ্জিত হন।  এছাড়া ডাকের সাজের উপর সোনা ও রুপার গহনা দেবীকে পড়ানো হয়।  

আঢ্য বাড়িতে পূজার দিন সাতেক পূর্ব থেকে ভিয়েন বসে। উড়িষ্যার ভদ্রক থেকে পাচক ঠাকুরেরা  আসেন। মিষ্টি তৈরিতে বাড়ির মহিলারাও তাদের সাথে হাতে হাত মেলান।  নানারকম মিষ্টি, নারকেল নাড়ু , মুগের নাড়ু, চুনোর  নাড়ু, পেরাকি  ইত্যাদি তৈরী করা হয়। 

মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদের প্রথম দিন দেবীর বোধন হয়।  সেইদিন থেকে চণ্ডীপাঠ করার রীতি সেই প্রাচীন কাল থেকে আজও বজায় রয়েছে।  সপ্তমীর দিন ষন্ডেশ্বরতলার  ঘাটে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়।  এখানে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে পূজা করা হয়।  

মহাঅষ্টমীর দিন এক মণ আতপ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়।  আঢ্য বাড়িতে অন্নভোগের প্রচলন না থাকলেও দেবীকে লুচি, রাধাবল্লবী, পাঁচরকম ভাজা, হালুয়া, ক্ষীর, পদ্ম নিমকি ও নানারকম নাড়ু, ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। পূর্বে  সন্ধিপূজার সময় বন্দুক দাগানো হত।  অবশ্য বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে। এই দিন ধুনো পোড়ানোর নিয়ম রয়েছে। মহানবমীর দিন আঢ্য বাড়িতে কুমারীপূজা এবং হোমযজ্ঞ করা হয়ে থাকে। দশমীর দিন দর্পণে প্রতিমা বিসর্জনের পর পরিবারের মহিলারা মাছভাত খান।  এই প্রথা আঢ্য  পরিবারে বরাবর চলে আসছে।  তারপর দেবীবরণ এবং কনকাঞ্জলি  প্রথা চালু হয়।  আঢ্য বাড়ির শিবদুর্গা বিসর্জনের পরে পরিবারের সদস্যরা ঠাকুর দালানে সকলে মিলিত হয়ে শান্তিজল গ্রহণ করেন ও উপস্থিত সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। মিষ্টিমুখের পর সকলের মধ্যে বিজয়ার  কোলাকুলি ও প্রণামের মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।  

আঢ্য বাড়ির কুলদেবতা হলেন শ্রী শ্রী শ্যামরায় জিউ। এই  বাড়িতে  ১৭৩০ সালে কুলদেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।  প্রতিবছর  নিয়ম করে আজও দোল, রাসযাত্রা, ও জন্মাষ্ঠমীর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  


তারিখ : ০৯-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



 


Friday, October 1, 2021

চাঁচল রাজবাড়ীর পূজা >P

চাঁচল রাজবাড়ীর পূজা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 







উনিশ শতকে বাংলার আর্থ সামাজিক ও প্রশাসনিক জীবনের সাথে এককালে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল জমিদাররা। বর্তমানে সেই জমিদার আর  নেই, নেই তাঁদের সেই জমিদারি। মালদা জেলার চাঁচলে ছিল সেরকমই এক জমিদার, ছিল তাঁর সুবিশাল বাড়ি।  ১৮৪৮ সালে চাঁচল জমিদারি এস্টেটের জন্ম হয়েছিল ঈশ্বর চন্দ্র রায়ের হাত ধরে। ঈশ্বর চন্দ্র রায়ের ঠাকুরদা রামচন্দ্র রাযের পিতা সাবর্ণ রায় কালীঘাটের পূজারী ছিলেন। সাবর্ণ রায় ইংরেজদের কাছ থেকে গৌরহন্ড পরগণা  কিনে জমিদারি পত্তন করেন।  

ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৬৫-৬৬ সাল নাগাদ তাঁর দুই রানীকে অপুত্রক অবস্থায় রেখে মারা গেলেন।  বড় রানী সিদ্বেশ্বরী দেবী তাঁর বোনের পুত্র শিবপ্রসাদকে দত্তক নেওয়ার বাসনায় মুর্শিদাবাদ থেকে তাকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখলেন।  শিবপ্রসাদ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক প্রকৃতির। দত্তক নেওয়ার পূর্বেই স্বইচ্ছায় তিনি সন্ন্যাসীদের সাথে বাড়ি হইতে বেড়িয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সিদ্ধেশ্বরী দেবী পিভি কাউন্সিলের অনুমোদন অনুসারে  নিমতিতা  অঞ্চলের গরিব ব্রাহ্মণ  মধুসূদনের পাঁচ বছর বয়সী পুত্র শরৎচন্দ্রকে দত্তক নেন।  শরৎচন্দ্র মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাজ সিংহাসনে বসেন।  তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান।  এই বংশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন এই রাজা শরৎচন্দ্র।  



দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর একদিন হঠাৎ শিবপ্রসাদ চাঁচল রাজবাড়িতে ফিরে আসেন।  সিদ্ধেশ্বরী দেবী অবশ্য তাঁকে  বঞ্চিত করেননি। তিনি হাতিন্দা পরগণাটি তাঁকে দেন।  এই সামান্য ভূসম্পত্তিটি লাভ করে শিবপ্রসাদ খুব খুশী হলেন।  তিনি শিবানী দেবীকে বিবাহ করেন। শিবপ্রসাদ ও শিবানী দেবীর কোল আলো করে এলো এক  পুত্র  শিবরাম চক্রবর্তী। এই শিবনাথ চক্রবর্তী পরবর্তীকালে বিখ্যাত সাহিত্যিক বিশেষ করে শিশু সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।  শরৎচন্দ্র শিবপ্রসাদকে মাসিক ২৫০০০ টাকা মাসোহারা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর কাছ থেকে হাতিন্দা  পরগণাটি হাতিয়ে নেন। শিবপ্রসাদের পরিবারকে পুরাতন ভগ্ন জমিদার বাড়িতে আশ্রয় দেন।  কিছুদিন পরে শরৎচন্দ্র শিবপ্রসাদের মাসোয়ারা বন্ধ করে দেন।  এর ফলে শিবপ্রসাদের পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পড়েন। 

রাজা শরৎচন্দ্র ১৮৭২-৮২ সালে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে জন  স্টুয়ার্ড কোম্পানিকে দিয়ে সুবিশাল একটা রাজবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ করেন।  এই রাজবাড়ি ও মন্দির তৈরির উপকরণ যেমন সেগুন কাঠ এসেছিলো বার্মা থেকে, কাঁচ এসেছিলো বেলজিয়াম থেকে আর ইস্পাত এসেছিলো ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কারশায়ার থেকে। আজ সেই রাজবাড়ির মন্দিরটি বাদে বাকি অংশ সরকারি দপ্তরে পরিণত হয়েছে। 

মা দুর্গাকে চণ্ডীরূপে পূজা করা হয় মালদহের ঐতিহ্যবাহী চাঁচল রাজবাড়িতে। রাজবাড়ির  মন্দিরে রয়েছে রাম-সীতার মূর্তি। এছাড়া রয়েছে রাম-সীতার সাথে  রাজা ঈশ্বরচন্দ্র রায়ের  পিতা রামচন্দ্র রায়ের স্বপ্নাদেশে  প্রাপ্ত  সিংহ বাহিনী।  প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুরের চণ্ডী মণ্ডপে সিংহবাহিনীকে জমকালো শোভাযাত্রা সহকারে নিয়ে যাওয়া হয়।  এই শোভাযাত্রা এক রাজকীয় ব্যাপার। বড় বড় রুপার ছাতা, রুপার পাখা যেমন থাকে তেমন  সহস্রাধিক মানুষও এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। ঢাক, ঢোল, কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে সপ্তমীর দিন রাজবাড়ীর মন্দির থেকে সিংহবাহিনীকে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়পুরের চণ্ডী মন্দিরে আবার দশমীর দিন পুনরায় তাঁকে রাজবাড়ির মন্দিরে  ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। দুর্গাপূজার কটাদিন এখানে চার হাতের দেবী চন্ডীর পূজা করা হয়। দশমীর দিন এখানে এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি হয়।  কথিত রয়েছে, যে কোন এক বছর প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় সন্ধ্যা হয়ে যায়। সূর্য পশ্চিম পাড়ে  ঢলে পরে। সেই সময় বিদ্যানন্দপুরের মুসলিম মানুষেরা লণ্ঠন দেখিয়ে বিসর্জনের সময় সহযোগিতা করেছিল। সেই সময় নাকি এতদাঞ্চলে কলেরার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিলো। এই লণ্ঠন দেখানোর পর নাকি আশ্চর্যজনকভাবে কলেরার প্রাদুর্ভাব একদম কমে গিয়েছিলো ও সবাই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সেই বিশ্বাস থেকে আজও বিসর্জনের সময় মুসলিম মহিলাদের লণ্ঠনের আলোয় দেবীর বিসর্জন হয়ে থাকে। এই প্রথা প্রায় ৩০০ বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে। 



রাজ আমলের রীতি-নীতি মেনে আজও পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মূল পূজার বারো দিন পূর্বে কৃষ্ণানবমী তিথিতে তামার ঘটে ভোরে পাহাড়পুরের চণ্ডী মণ্ডপে পূজা শুরু হয়। পাহাড়পুরের এই পূজা রাজবাড়িরই পূজা বলে পরিচিত। তিনশো বছর পূর্বে প্রথমে হরিশচন্দ্রপুরের একটি  গ্রামে পূজাটি শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা পাহাড়পুর গ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছিল। রাজবাড়িরই মূল মন্দিরে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনীর মূর্তিটির নিত্য পূজা করা হয়। দুর্গা  পূজার কটাদিন পাহাড়পুরের মন্দিরে মৃন্ময়ী মূর্তির পাশে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনীর মূর্তিও  বিরাজ করে। 

রাজা শরৎচন্দ্রের ঠাকুরদা রামচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে পাহাড়পুরের সতীঘাটে স্নান করতে গিয়ে  সিংহবাহিনীর মূর্তিটি পান।  সেই থেকে এই ঘাটেই দশমীর দিন দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিটির বিসর্জন দেওয়া হয়।  সময় বয়ে গিয়েছে, নেই রাজা, নেই রাজ্যপাট তবুও ঘটা  করে প্রতি বছর মা এখানে চণ্ডীরূপে পূজিত হন।  




তারিখ : ০২-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।