Tuesday, October 26, 2021

শেওড়াফুলির নিস্তারিণী মা >P

শেওড়াফুলির নিস্তারিণী মা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 





বহুদিন পূর্বের কথা তখনও শেওড়াফুলি নাম হয়নি, সাড়াপুলি নামটা  সকলের কাছে পরিচিত ছিল।  এই সাড়াপুলিতেই গঙ্গার ধারে ক্ষত্রিয়রাজ মনোহর রায়ের পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায়ের প্রপৌত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র রায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজা হরিশ্চন্দ্র ছিলেন পরম ধার্মিক,  নিষ্ঠাবান ও দেবী কালিকার ভক্ত। কথিত আছে, রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়ের প্রথম পত্নী সর্বমঙ্গলা দেবীর অপমৃত্যু হয়।  এই কারণে তিনি পন্ডিতদের শরণাপন্ন হন। পন্ডিতদের বিধান অনুসারে তিনি তাঁর স্ত্রীর আত্মার শান্তি কামনায় তাঁর রাজ্যে গঙ্গা তীরবর্তী স্থানে এই মন্দিরটি  স্থাপন করেন। মন্দিরটি বিশালাকার। মন্দিরে তিনি শিবপত্নী দক্ষিণাকালী শ্রী শ্রী নিস্তারিণী মাতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সালটা ছিল ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ (১২৩৪ বঙ্গাব্দ)।  

এখানকার দেবী নিস্তারিণীর সাথে একটি কাহিনীর কথা প্রচলিত রয়েছে। একবার রানী রাসমণি বেশ কয়েকটি বজরায় দাস-দাসী সমেত বেনারসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তখনও  দক্ষিনেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির তৈরী হয়নি।  যখন তাঁদের  বজরা শেওড়াফুলি ঘাটের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন রানীমা  দেখতে পেলেন যে ঘাটের ধারে একটি পরমাসুন্দরী কিশোরী তাঁকে ডাকছে। ঘাটে বা ঘাটের আশপাশে আর কারোকে দেখা যাচ্ছে না। কিশোরীর মনোমুগ্ধকর রূপ দেখে রানীমা মোহিত হয়ে গেলেন। রানীমা অবশ্য পূর্বেই জানতেন যে এখানে দেবী নিস্তারিণীর একটা সুন্দর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তিনি তাঁর  মাঝিকে ঘাটে বজরা ভিড়াতে বললেন।  ঘাটে এসে তিনি ওই কিশোরীকে দেবী নিস্তারিণীর কাছে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিতে বললেন। কিশোরী তাঁকে বললেন  আমিতো ওখানেই থাকি। রানী মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিশোরীকে অনুসরণ করলেন।  মন্দিরের কাছাকাছি আসার পর কিশোরী তাঁকে জানালেন এই পথ ধরে আর একটু এগোলেই নিস্তারিণীর মায়ের থান তিনি দেখতে পাবেন। একথা বলে হঠাৎ  কিশোরী কোথায় মিলিয়ে গেলো। রানী আর কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না। রানীমা দেবী নিস্তারিণীর সাথে ওই কিশোরীর একটা অপার্থিব মিল খুঁজে পেলেন। তিনি দেবীদর্শন ও দেবীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। এই কাহিনীর কথা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। 

এই কালী মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের একটা প্রাচীন কালীমন্দির। মন্দিরটি অল্প উচ্চতার ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত। সমতল ছাদযুক্ত। মন্দিরটির দক্ষিণদিকে দালান রয়েছে। মন্দিরের সামনের দিকে সাতটি  খিলান আর পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাঁচটি খিলান রয়েছে। খিলানগুলি সব থামের উপর স্থাপিত। মন্দিরের চারদিকে বারান্দা রয়েছে। মন্দিরটির ডানদিকে রয়েছে একটি নাটমন্দির। নাটমন্দিরের বেশিরভাগ অংশে দোকান রয়েছে। মন্দিরের মধ্যে কয়েকটি ঘর রয়েছে। মন্দিরের সামনের দিকের ঠিক মাঝখানের ঘরটিতে পঞ্চমুন্ডীর আসনে একটি তামার পদ্মাসনের  উপর নিস্তারিণী দেবীর বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেবী বিগ্রহের পদতলে শায়িত রয়েছেন মহাদেব। এখানে দেবী চতুর্ভূজা। দেবীর বামদিকের ওপরের হাতে তরবারি ও নিচের হাতে নরমুণ্ড বিদ্যমান। দক্ষিণের দুটি হাত দিয়ে দেবী বর ও অভয় দান করছেন। মাঝের ঘরটির দুপাশে দুটি ঘরে দুটি শ্বেতপাথরের শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেবী নিস্তারিণীর ঘরে দুটি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। গর্ভগৃহের সামনে অলিন্দ। এছাড়া মন্দিরের মধ্যে দুটি ঘরে রাজবংশের দুটি প্রাচীন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। একটি ঘরে কৃষ্ণরাযের বিগ্রহ রয়েছে। এই কৃষ্ণরায়ের বিগ্রহটিকে বর্ধমান জেলার পাটুলি গ্রাম থেকে নিয়ে এসে এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।ওপর একটি ঘরে পাটুলী রাজবংশের কুলদেবী মহিষাসুরমর্দিনীর একটি মূর্তি রয়েছে। এখানকার সবকটি বিগ্রহকে নিত্যপূজা করা হয়। মন্দির চত্বরে ভোগ রান্নার একটি ঘর রয়েছে। মন্দির চত্বরেই পূজা সামগ্রী, নিত্য ব্যৱহৃত সামগ্রীর দোকান ও খাবারের  দোকান রয়েছে।  

রাজ বংশের সদস্য শ্রী আশীষ ঘোষ মহাশয় জানালেন যে সম্প্রতি মন্দির ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ৮০ হাজার টাকা ব্যয় মন্দির চত্বরে ১৪ টা  ক্লোজ সার্কিট টিভি লাগানো হয়েছে। এখন পুলিশ ফাঁড়িতে বসেই মন্দির চত্বরে নজরদারি করা হচ্ছে।  

সকলের বিশ্বাস দেবী নিস্তারিণী খুবই জাগ্রত দেবী। সকলের সব রকম মনোস্কামনা তিনি পরিপূর্ণ করেন বলে সবাই মনে করে থাকে। তাই এখানে স্থানীয়রা ছাড়াও বহু দূর দূরান্ত থেকে বহু ভক্তের সমাগম হয়। গঙ্গা স্নান করে মায়ের পূজার মাধ্যমে তারা মায়ের কাছে তাদের মনোস্কামনা নিবেদন করেন।  


 মন্দির খোলার সময় : 

সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত আর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত্রি নয়টা সময় পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। বিশেষ বিশেষ দিনে অবশ্য বিশেষ পূজার জন্য অবশ্য মন্দির  অধিক সময় খোলা থাকে। 


কিভাবে যাবেন : 

হাওড়া স্টেশন থেকে শেওড়াফুলি স্টেশনে এসে নামুন। মন্দিরটি একদম স্টেশনের পাশে অবস্থিত। 

তারিখ : ২৪-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


No comments: