Friday, October 1, 2021

চাঁচল রাজবাড়ীর পূজা >P

চাঁচল রাজবাড়ীর পূজা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 







উনিশ শতকে বাংলার আর্থ সামাজিক ও প্রশাসনিক জীবনের সাথে এককালে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল জমিদাররা। বর্তমানে সেই জমিদার আর  নেই, নেই তাঁদের সেই জমিদারি। মালদা জেলার চাঁচলে ছিল সেরকমই এক জমিদার, ছিল তাঁর সুবিশাল বাড়ি।  ১৮৪৮ সালে চাঁচল জমিদারি এস্টেটের জন্ম হয়েছিল ঈশ্বর চন্দ্র রায়ের হাত ধরে। ঈশ্বর চন্দ্র রায়ের ঠাকুরদা রামচন্দ্র রাযের পিতা সাবর্ণ রায় কালীঘাটের পূজারী ছিলেন। সাবর্ণ রায় ইংরেজদের কাছ থেকে গৌরহন্ড পরগণা  কিনে জমিদারি পত্তন করেন।  

ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৬৫-৬৬ সাল নাগাদ তাঁর দুই রানীকে অপুত্রক অবস্থায় রেখে মারা গেলেন।  বড় রানী সিদ্বেশ্বরী দেবী তাঁর বোনের পুত্র শিবপ্রসাদকে দত্তক নেওয়ার বাসনায় মুর্শিদাবাদ থেকে তাকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখলেন।  শিবপ্রসাদ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক প্রকৃতির। দত্তক নেওয়ার পূর্বেই স্বইচ্ছায় তিনি সন্ন্যাসীদের সাথে বাড়ি হইতে বেড়িয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সিদ্ধেশ্বরী দেবী পিভি কাউন্সিলের অনুমোদন অনুসারে  নিমতিতা  অঞ্চলের গরিব ব্রাহ্মণ  মধুসূদনের পাঁচ বছর বয়সী পুত্র শরৎচন্দ্রকে দত্তক নেন।  শরৎচন্দ্র মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাজ সিংহাসনে বসেন।  তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান।  এই বংশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন এই রাজা শরৎচন্দ্র।  



দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর একদিন হঠাৎ শিবপ্রসাদ চাঁচল রাজবাড়িতে ফিরে আসেন।  সিদ্ধেশ্বরী দেবী অবশ্য তাঁকে  বঞ্চিত করেননি। তিনি হাতিন্দা পরগণাটি তাঁকে দেন।  এই সামান্য ভূসম্পত্তিটি লাভ করে শিবপ্রসাদ খুব খুশী হলেন।  তিনি শিবানী দেবীকে বিবাহ করেন। শিবপ্রসাদ ও শিবানী দেবীর কোল আলো করে এলো এক  পুত্র  শিবরাম চক্রবর্তী। এই শিবনাথ চক্রবর্তী পরবর্তীকালে বিখ্যাত সাহিত্যিক বিশেষ করে শিশু সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।  শরৎচন্দ্র শিবপ্রসাদকে মাসিক ২৫০০০ টাকা মাসোহারা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর কাছ থেকে হাতিন্দা  পরগণাটি হাতিয়ে নেন। শিবপ্রসাদের পরিবারকে পুরাতন ভগ্ন জমিদার বাড়িতে আশ্রয় দেন।  কিছুদিন পরে শরৎচন্দ্র শিবপ্রসাদের মাসোয়ারা বন্ধ করে দেন।  এর ফলে শিবপ্রসাদের পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পড়েন। 

রাজা শরৎচন্দ্র ১৮৭২-৮২ সালে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে জন  স্টুয়ার্ড কোম্পানিকে দিয়ে সুবিশাল একটা রাজবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ করেন।  এই রাজবাড়ি ও মন্দির তৈরির উপকরণ যেমন সেগুন কাঠ এসেছিলো বার্মা থেকে, কাঁচ এসেছিলো বেলজিয়াম থেকে আর ইস্পাত এসেছিলো ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কারশায়ার থেকে। আজ সেই রাজবাড়ির মন্দিরটি বাদে বাকি অংশ সরকারি দপ্তরে পরিণত হয়েছে। 

মা দুর্গাকে চণ্ডীরূপে পূজা করা হয় মালদহের ঐতিহ্যবাহী চাঁচল রাজবাড়িতে। রাজবাড়ির  মন্দিরে রয়েছে রাম-সীতার মূর্তি। এছাড়া রয়েছে রাম-সীতার সাথে  রাজা ঈশ্বরচন্দ্র রায়ের  পিতা রামচন্দ্র রায়ের স্বপ্নাদেশে  প্রাপ্ত  সিংহ বাহিনী।  প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুরের চণ্ডী মণ্ডপে সিংহবাহিনীকে জমকালো শোভাযাত্রা সহকারে নিয়ে যাওয়া হয়।  এই শোভাযাত্রা এক রাজকীয় ব্যাপার। বড় বড় রুপার ছাতা, রুপার পাখা যেমন থাকে তেমন  সহস্রাধিক মানুষও এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। ঢাক, ঢোল, কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে সপ্তমীর দিন রাজবাড়ীর মন্দির থেকে সিংহবাহিনীকে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়পুরের চণ্ডী মন্দিরে আবার দশমীর দিন পুনরায় তাঁকে রাজবাড়ির মন্দিরে  ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। দুর্গাপূজার কটাদিন এখানে চার হাতের দেবী চন্ডীর পূজা করা হয়। দশমীর দিন এখানে এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি হয়।  কথিত রয়েছে, যে কোন এক বছর প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় সন্ধ্যা হয়ে যায়। সূর্য পশ্চিম পাড়ে  ঢলে পরে। সেই সময় বিদ্যানন্দপুরের মুসলিম মানুষেরা লণ্ঠন দেখিয়ে বিসর্জনের সময় সহযোগিতা করেছিল। সেই সময় নাকি এতদাঞ্চলে কলেরার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিলো। এই লণ্ঠন দেখানোর পর নাকি আশ্চর্যজনকভাবে কলেরার প্রাদুর্ভাব একদম কমে গিয়েছিলো ও সবাই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সেই বিশ্বাস থেকে আজও বিসর্জনের সময় মুসলিম মহিলাদের লণ্ঠনের আলোয় দেবীর বিসর্জন হয়ে থাকে। এই প্রথা প্রায় ৩০০ বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে। 



রাজ আমলের রীতি-নীতি মেনে আজও পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মূল পূজার বারো দিন পূর্বে কৃষ্ণানবমী তিথিতে তামার ঘটে ভোরে পাহাড়পুরের চণ্ডী মণ্ডপে পূজা শুরু হয়। পাহাড়পুরের এই পূজা রাজবাড়িরই পূজা বলে পরিচিত। তিনশো বছর পূর্বে প্রথমে হরিশচন্দ্রপুরের একটি  গ্রামে পূজাটি শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা পাহাড়পুর গ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছিল। রাজবাড়িরই মূল মন্দিরে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনীর মূর্তিটির নিত্য পূজা করা হয়। দুর্গা  পূজার কটাদিন পাহাড়পুরের মন্দিরে মৃন্ময়ী মূর্তির পাশে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনীর মূর্তিও  বিরাজ করে। 

রাজা শরৎচন্দ্রের ঠাকুরদা রামচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে পাহাড়পুরের সতীঘাটে স্নান করতে গিয়ে  সিংহবাহিনীর মূর্তিটি পান।  সেই থেকে এই ঘাটেই দশমীর দিন দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিটির বিসর্জন দেওয়া হয়।  সময় বয়ে গিয়েছে, নেই রাজা, নেই রাজ্যপাট তবুও ঘটা  করে প্রতি বছর মা এখানে চণ্ডীরূপে পূজিত হন।  




তারিখ : ০২-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 
















No comments: