Saturday, October 9, 2021

চুঁচুড়া আঢ্য বাড়ির দুর্গাপূজা >P

চুঁচুড়া আঢ্য বাড়ির দুর্গাপূজা 


      - সুদীপ্ত মুখার্জী


হুগলি জেলার একটা সুপ্রাচীন জনপদ হল চুঁচুড়া। অনেকেরই জানা রয়েছে যে চুঁচুড়া বহুকাল পূর্বে ওলন্দাজদের ঘাঁটি ছিল।  আজও সেই আমলের বেশ কিছু স্থাপত্য শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।  এই শহরের দুর্গাপূজার কথা মনে আসলেই সবার প্রথমে আঢ্য বাড়ির দুর্গাপূজার কথা মনে পরে।  দেখতে দেখতে যা এবছর ২৮৭ বছরে পদার্পন করল। 

আঢ্য বাড়ির পূর্বপুরুষরা পূর্বে আদি সপ্তগ্রামে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে তাঁরা সেখান থেকে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় এসে বসবাস করতে থাকেন। তাঁরা প্রধানত ব্যবসায়ী পরিবার। পরিবারের সন্তান যোগীন্দ্রলাল আঢ্য ছিলেন  হুগলির স্টেশান মাস্টার। যিনি জগু মাস্টার নামে  অধিক পরিচিত ছিলেন। আঢ্য পরিবারের প্রাণপুরুষ ছিলেন সুবর্ণবণিক বদনচন্দ্র আঢ্য।  বদনবাবুই চুঁচুড়ার পঞ্চাননতলায় আঢ্য বাড়িতে তিন খিলানযুক্ত সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত একটি ঠাকুর দালান নির্মাণ করেন। এই ঠাকুর দালানে তিনি দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন।  পরবর্তীকালে যোগীন্দ্রলাল আঢ্যের সাত পুত্র ও তাঁদের উত্তরপুরুষরা পারিবারিক রীতি-নীতি মেনে পূজা করে আসছেন।  

এই পরিবারের দুর্গাপূজার সূচনা রথযাত্রার দিন কাঠামো পূজার মাধ্যমে শুরু হয়।  বংশ পরম্পরায় প্রতিমা গড়ে তুলছেন প্রতিমা শিল্পী। শুধু  প্রতিমাশিল্পী  নয়  পুরোহিত ও মিষ্টি তৈরির পাচকও বংশ পরম্পরায় কাজ করে চলেছেন। 

এখানে দেবী শিবদুর্গারূপে পূজিত হন। দেবী শিবক্রোড়ে অধিষ্ঠাতা। দেবী দ্বিভূজা অভয়দায়িনী শান্তিদাত্রী। তাঁর এক হাতে বরদানি ও ওপর দিকে তিনিও ভয়দায়িনীরূপে বিরাজিতা। দেবীর সাথে লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী এবং কার্তিক থাকেন।  প্রতিমা শোলা ও রাংতা  দিয়ে ডাকের সাজে সজ্জিত হন।  এছাড়া ডাকের সাজের উপর সোনা ও রুপার গহনা দেবীকে পড়ানো হয়।  

আঢ্য বাড়িতে পূজার দিন সাতেক পূর্ব থেকে ভিয়েন বসে। উড়িষ্যার ভদ্রক থেকে পাচক ঠাকুরেরা  আসেন। মিষ্টি তৈরিতে বাড়ির মহিলারাও তাদের সাথে হাতে হাত মেলান।  নানারকম মিষ্টি, নারকেল নাড়ু , মুগের নাড়ু, চুনোর  নাড়ু, পেরাকি  ইত্যাদি তৈরী করা হয়। 

মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদের প্রথম দিন দেবীর বোধন হয়।  সেইদিন থেকে চণ্ডীপাঠ করার রীতি সেই প্রাচীন কাল থেকে আজও বজায় রয়েছে।  সপ্তমীর দিন ষন্ডেশ্বরতলার  ঘাটে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়।  এখানে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে পূজা করা হয়।  

মহাঅষ্টমীর দিন এক মণ আতপ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়।  আঢ্য বাড়িতে অন্নভোগের প্রচলন না থাকলেও দেবীকে লুচি, রাধাবল্লবী, পাঁচরকম ভাজা, হালুয়া, ক্ষীর, পদ্ম নিমকি ও নানারকম নাড়ু, ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। পূর্বে  সন্ধিপূজার সময় বন্দুক দাগানো হত।  অবশ্য বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে। এই দিন ধুনো পোড়ানোর নিয়ম রয়েছে। মহানবমীর দিন আঢ্য বাড়িতে কুমারীপূজা এবং হোমযজ্ঞ করা হয়ে থাকে। দশমীর দিন দর্পণে প্রতিমা বিসর্জনের পর পরিবারের মহিলারা মাছভাত খান।  এই প্রথা আঢ্য  পরিবারে বরাবর চলে আসছে।  তারপর দেবীবরণ এবং কনকাঞ্জলি  প্রথা চালু হয়।  আঢ্য বাড়ির শিবদুর্গা বিসর্জনের পরে পরিবারের সদস্যরা ঠাকুর দালানে সকলে মিলিত হয়ে শান্তিজল গ্রহণ করেন ও উপস্থিত সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। মিষ্টিমুখের পর সকলের মধ্যে বিজয়ার  কোলাকুলি ও প্রণামের মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।  

আঢ্য বাড়ির কুলদেবতা হলেন শ্রী শ্রী শ্যামরায় জিউ। এই  বাড়িতে  ১৭৩০ সালে কুলদেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।  প্রতিবছর  নিয়ম করে আজও দোল, রাসযাত্রা, ও জন্মাষ্ঠমীর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  


তারিখ : ০৯-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



 


No comments: