সুখরিয়ার বিশ্বাস বাড়ির পূজা
- সুদীপ্ত মুখার্জী
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা যেখানে সর্বপ্রথম বারোয়ারি পূজা শুরু হয়েছিল। সেই জেলাতেই তিন শত বছর অতিক্রম করা এক পারিবারিক দুর্গাপূজা হয়ে চলেছে। সাবেকি বাড়ির প্রাচীন দুর্গাপূজা। এই পূজার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এক জমিদার পরিবারের কাহিনী।
এই জমিদার পরিবারের ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় তিনশো বছর পূর্বে। ১৬৫৭ সাল। নদীয়া জেলার টেকা গ্রাম থেকে শান্তিপুরের বিখ্যাত গুরুমহাশয় মোহন মিত্র উঠে আসেন ওই জেলারই উলা গ্রামে। নদীয়া জেলার উলা গ্রামটি বর্তমানে বীরপুর নামে প্রসিদ্ধ। এই মোহন মিত্রের পুত্র ছিলেন রামেশ্বর মিত্র। তিনি উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। তখন বাংলার গভর্নর ছিলেন শায়েস্তা খান এবং বাংলার নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। রামেশ্বর তার পিতার পন্ডিতি ব্যবসা ছেড়ে নবাব মুর্শিদকুলির শাসনকালে সুবে বাংলার রাজস্ববিভাগের নায়েব কানুনগো ছিলেন। ১৭০৪ সালে তাঁর কাজের পারদর্শিতার জন্য দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেব রামেশ্বরকে 'মুস্তাফি' উপাধি প্রদান করেন। রামেশ্বর এই চাকরি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তিনি নদীয়া জেলায় একটি জমিদারি এস্টেট ক্রয় করেন। পরবর্তী সময় তিনি তাঁর জমিদারির সম্পত্তি আরো বৃদ্ধি করেন। তিনি ধীরে ধীরে জমিদার হিসেবে পরিচিত হন।
তিনি জমিদার হলেও অন্য জমিদারদের মতো কখনোই ভোগ বিলাসে নিজেকে ডুবিয়ে দেন নি। পরবর্তীকালে গঙ্গা নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে উলা গ্রাম থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে শুরু করে। তার ফলে উলার গৌরব ও সমৃদ্ধি কমতে থাকে। মিত্রমুস্তাফি পরিবার ভেঙে তিন ভাগ হয়ে যায়। রামেশ্বর মিত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র রঘুনন্দন ১৭০৮ সালে (১৬৩০ শকাব্দ) গঙ্গার নদীর পূর্বতীরে উলা গ্রাম থেকে পশ্চিমতীরের হুগলী জেলার আটিশেওড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং গ্রামটির নতুন নামকরণ করেন শ্রীপুর। রামেশ্বেরের আর এক পুত্র অনন্তরাম এই শ্রীপুর গ্রামের কিছুদূরে সুখরিয়া গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। এই অঞ্চলগুলো সেই সময় বাঁশবেড়িয়ার রাজা রঘুদেবের জমিদারির মধ্যে ছিল। বাঁশবেড়িয়ার রাজা রঘুনন্দন মিত্রমুস্তাফিকে আটিশেওড়া গ্রামে ৭৫ বিঘা ভূসম্পত্তি দান করেন। সেই জমিতেই রঘুনন্দন দীঘি, পুষ্করিণী, চণ্ডীমণ্ডপ প্রভৃতি নির্মাণ করেন।
অনন্তরামের নাতি রামজীবন মিত্র মুস্তাফি সুখরিয়াতে একটা সুবিশাল প্রাসাদ ও একটি মনোরম ঠাকুরদালান নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদেই ঠাকুরদালানের ঠিক পাশে রয়েছে রত্নেশ্বর মিত্র মুস্তাফির প্রতিষ্ঠিত শিবমোহিনী দুর্গার মূর্তি। তার সাথে একটি রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তিও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। শিবমোহিনী দূর্গা ও আনন্দময়ী কালী এনাদের কুলদেবী। আমি আজ সুখরিয়া রাজবাড়ীর দুর্গাপূজা নিয়ে আপনাদের জানাবো।
সুখরিয়ার গ্রামটি হুগলি জেলার বলাগড় ও সোমড়াবাজারের মধ্যবর্তী একটা গ্রাম। এক গ্রামেই জমিদার রত্নেশ্বর মিত্র তাঁর প্রাসাদ ও বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদ ও মন্দিরগুলোকে দেখলে তাঁর শিল্পকলা ও স্থাপত্যের নিদর্শন অনুমান করা যায়। রত্নেশ্বর মিত্রমুস্তাফির পুত্র রাধাজীবনের তিন কন্যা ও এক পুত্র ছিল। যোগমায়াদেবী দাসী, পদ্মাবতী দাসী ও ভবভাবিনী দাসী এই তিন কন্যা ও ক্ষেত্ৰনাথ নামে এক পুত্র ছিল। তাঁর একমাত্র পুত্র ক্ষেত্ৰনাথ বসন্ত রোগে মারা যায়। তাঁর তিন কন্যার মধ্যে একজনের বিবাহ হয় শোভাবাজার রাজবাড়ীর যতীন্দ্র মোহন দেবের সহিত, একজনের বিবাহ হয় রানাঘাটের জমিদার বিনোদ বিহারি বিশ্বাসের সহিত আর এক কন্যার কলকাতার ব্যবসায়ী যতীন্দ্রনাথ ঘোষের সহিত বিবাহ হয়। সুখরিয়ার এই বাড়িটি বর্তমানে বিনোদ বিহারি বিশ্বাসের পরিবারের উত্তরপুরুষদের অধীনে রয়েছে। বংশের কোনো পুত্র সন্তান জীবিত না থাকার জন্য বিশ্বাস পরিবার দীর্ঘকাল ধরে রাজবাড়ির এই দুর্গাপূজাটি বজায় রেখে চলেছেন।
এখানে রয়েছে মিত্রমুস্তাফিদের নির্মিত ভগ্নপ্রায় একটি ঠাকুরদালান। এই ঠাকুর দালানে আজও বেশ ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়ে থাকে।
এখানকার দেবীমূর্তি দশভুজা। ঘোড়ার মুখবিশিষ্ট সিংহ এখানে দেবীর বাহন। পূজার দিন সাতেক পূর্বে বোধন শুরু হয়। এখানে বৈষ্ণব মতে পূজা করা হয়। প্রত্যেকদিন সকাল বিকেল দুইবেলা পূজা করা হয়। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী এই তিনদিনই এখানে বলি দেওয়া হয়। পূর্বে মহিষ বলি দেওয়া হত কিন্তু বর্তমানে চালকুমড়া, আখ বলি দেওয়া হয়। পূজার কটাদিন ভোর চারটের সময় মঙ্গলারতি করা হয়। মঙ্গলারতির সময় প্রত্যেকদিন দেবীকে মাখন ও মিশ্রি দেওয়া হয়। দেবী মূর্তি এখানকার ঠাকুরদালানেই নির্মিত হয়। নবপত্রিকাকে কোন পুকুর বা নদীতে স্নান করানো হয়না। তাঁকে ঠাকুরদালানেই স্নান করানো হয়। দেবীকে ভোগ হিসেবে লুচি, তরকারি, বিভিন্ন ফল ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়। এছাড়া কাঁচা ডাল, বিভিন্ন সবজি, তেল দেবীকে বোধনের পর থেকে প্রতিদিন দেওয়া হয়। প্রত্যেকদিন সন্ধিপূজা করা হয়। অষ্টমীর দিন কুমারী পূজা করা হয়। এখানে বরণ ও কনকাঞ্জলি প্রথা রয়েছে কিন্তু সিঁদুরখেলার কোনো নিয়ম নেই। পূজায় বাড়ির মহিলারা বাইরের পুরুষদের সামনে আসতেন না। পূজার সময় পূজার দালানে আসতেন কিন্তু তখন বাইরের কেউ বাড়ির ভিতরে থাকতো না। তাই বিসর্জনের সময় যেহেতু বাইরের লোকজন ঠাকুরদালানে থাকতো তাই সেইসময় বাড়ির মহিলারা অন্দরমহল থেকে জানালা দিয়ে দেবী দুর্গার চলে যাওয়া দেখতেন। এককালে দুর্গাপুজোর সময় এখানে যাত্রাপালা, কবিগান, নাটকের আসর বসত।
মিত্রমুস্তাফি বা বিশ্বাস পরিবারের কেউ আজ আর এখানে বসবাস করেন না কিন্তু দুর্গাপূজার সময় তাঁরা ঠিক তাঁদের ভদ্রাসনে ফিরে আসেন। ঐতিহ্যের বাতি আজ আর সেভাবে জ্বলে ওঠে না। তাঁরা যতটা সম্ভব নিয়ম রক্ষা করে কোনোভাবে পূজাটি বজায় রেখে চলছেন। এই রাজবাড়িতেই মৃনাল সেন তাঁর "অকালের সন্ধানে" সিনেমার শুটিং করেছিলেন।
তারিখ : ২০-১০-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
2 comments:
Bah khub bhalo laglo
Bah khub bhalo laglo
Post a Comment