Sunday, March 29, 2020

মহামারী ও কোয়ারান্টাইন>P

মহামারী ও কোয়ারান্টাইন

'মহামারী' এই শব্দটা শুনলেই মানুষ ভীত হয়ে ওঠে।  শব্দটি সত্যিই ভয়াবহ। সাধারণত কোনো সংক্রমণ রোগ দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যে কোন দেশের জনসংখ্যার এই বৃহৎ সংখ্যক লোকের মধ্যে সংক্রমিত হয় তাকেই 'মহামারী' বলা হয়ে থাকে।  মহামারীর ভয়াবহতা বারবার বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।  আমাদের কল্লোলিনী কলকাতাকেও একাধিকবার ছিন্ন-ভিন্ন করেছে।  অষ্টাদশ-উনিশ শতকে কলকাতায় প্রায় প্রতিবছর মহামারী লেগে থাকতো।  সাবেক কলকাতায় প্লেগ, আমাশা, কলেরায় বহু সাহেবকে আমরা মারা যেতে দেখেছি।  সেই আমলের পত্র-পত্রিকাগুলোতে সেইসব বিবরণ ছাপার অক্ষরে বের হতো।  পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাবো মহামারী কিন্তু ঘুরে ঘুরে দেখা দেয়।  ২০২০ সালের প্রথম থেকেই 'কোভিড -১৯' নামাঙ্কিত এক ভাইরাস ধীরে  ধীরে পৃথবীর বুকে থাবা বসিয়ে চলেছে।  গোটা বিশ্বই কম বেশি সংক্রমিত।  ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। মহামারী প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় অতীতের কিছু ঘটনার কথা।  অসুখ থেকে দূরে রাখার তারিকাটি অর্থাৎ কোয়ারান্টিনে পাঠানোর ইতিহাসটি দীর্ঘদিনের।  এই পদ্ধতি নানা দেশে নানা সময়ে কাজে লাগতে দেখা গেছে।

১৩৪০ সাল।  মধ্য এশিয়া থেকে সিল্ক রুট ধরে ক্রিমিয়া হয়ে এক ভয়ঙ্কর রোগ ইউরোপে হানা দিল।  লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে মারা যেতে লাগলো।  রোগটির নাম 'বিউবোনিক প্লেগ', কিন্তু লোকেরা রোগটির  'ব্ল্যাক ডেথ' নাম দিল। দশকে পর  দশকে রোগটি ইউরোপে বার বার ফিরে আসতো। ১৩৭০ সালেও রোগটি এসেছিল। ১৩৭৩ সালে ভেনিসের কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিল তাদের বন্দরে যেসব জাহাজ ভিড়বে সেইসব জাহাজে যদি কোন প্লেগ আক্রান্ত রুগী থাকে, তাকে ভেনিসে ঢোকার আগেই একটা দ্বীপে চল্লিশ দিন অপেক্ষা করতে হবে।  তারপর তাকে শহরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে।

১৭৯৩ সাল।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহরে এক ধরণের জ্বর দেখা দিল। এই জ্বরে শহরের মোট জনসংখ্যার  প্রায় দশ শতাংশ লোক মারা যায়।  জ্বরটির নাম 'ইয়োলো ফিভার'।  কারো কারো মতে এটা মশা বাহিত রোগ আবার কারো কারো মতে নাবিকদের থেকেই রোগটি ছড়াচ্ছে। ১৭৯৯ সালে স্থানীয় প্রশাসন ঠিক করলো শহরের বাইরে একটা বিশাল 'কোয়ারেন্টাইন সেন্টার' নির্মাণ করবে।  শহরে আসা জাহাজে যদি কেউ অসুস্থ থাকে প্রথমেই তাকে ওই সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

১৮৯২ সাল।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডে রাশিয়া থেকে ইহুদিদের একটা জাহাজ এসে ভিড়েছিল।  জাহাজটিতে প্রায় জনা  সত্তর যাত্রী ছিল।  দেখা গেলো দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ফলে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ফলে জাহাজটির বেশিরভাগ যাত্রীর সারা গায়ে থিক থিক করছে উকুন।  এই উকুন থেকে আবার অনেকে টাইফয়েড রোগেও আক্রান্ত হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ইস্ট রিভার নদীর নর্থ ব্রাদার দ্বীপে   তাঁবু খাটিয়ে রুগীদের শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দেওয়া হয়।

১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল।  রোগ সংক্রমণের ভয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বহু অঞ্চলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।  সেই সময়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগ লোক মারা গিয়েছিল। আনুমানিক প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।  ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমেরিকায় জনসমাবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি বিভিন্ন নথিতে ও সংবাদ মাধ্যমগুলো অসুখের ভয়াবহতা অনেকটা কম করে দেখিয়েছিল।   বিভিন্ন মাধ্যম  থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল স্পেনে এই রোগের প্রকোপ সব থেকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।  সেই কারণে বিশ্ব জুড়ে রোগটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'স্প্যানিশ ফ্ল'।

আর একটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়।  পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিদিনের জন্য কোয়ারান্টিনে কে ছিলেন ?

১৯০৭ সাল।  মেরী  ম্যালোন, পেশায় একজন পাচক ছিলেন।  জন্মসূত্রে আইরিশ হলেও তিনি মার্কিন নাগরিক ছিলেন।  তিনি এক সংক্রমক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যে সব বাড়িতে তিনি রান্নার কাজ করতেন প্রথমে সেই সব পরিবারের লোকদের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হয়েছিল।  পরবর্তীকালে বন্ধু -বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ও পাড়া-পড়শির মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।  প্রচুর মৃত্যুও ঘটে। মেরী ম্যালোন অবশ্য জীবিত ছিলেন।  স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাকে পাকড়াও করে তিন বছরের জন্য নিউ ইয়ার্কের নর্থ ব্রাদার আইল্যান্ডের কোয়ারান্টিনে পাঠিয়ে দেয়।  কোয়ারান্টিনে থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আর পাচকের কাজ করবেন না, কিন্তু  ১৯১৫ সালে তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।  তাকে কর্তৃপক্ষ আবার পাকড়াও করে সারা জীবনের জন্য ওই দ্বীপের কোয়ারান্টিনে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তিনি ২৩টা বছর বেঁচেছিলেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম কোয়ারান্টিনে থাকার নমুনা হয়ে আছে।

তথ্যসূত্র : এই সময় সংবাদপত্র (২২-০৩-২০২০)

ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ৩০-০৩-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 










  

Saturday, March 28, 2020

বেলা মিত্রের জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি>P

 বেলা মিত্রের  জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি  



মাত্র কয়েকটি চিঠিতেই স্বামীর ফাঁসি রদ করেছিলেন এক বঙ্গললনা। চিঠিগুলো অবশ্য বঙ্গললনা নিজে লেখেননি, তাঁর অনুরোধে মহাত্মা গান্ধী তৎকালীন ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ ভাইসরয়কে চিঠিগুলো লিখেছিলেন নেতাজি সুভাষ অনুগামী চারজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসির আদেশ বন্ধ করার জন্য। সেই চিঠিগুলোর ফলে অবশ্য তাঁদের ফাঁসি বন্ধ হয়েছিল, ফাঁসির বদলে তাঁরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত  হয়েছিলেন।  ভাবছেন নিশ্চই কে এই বঙ্গললনা?  তিনি আমাদের রাজ্যের অর্থমন্ত্রী শ্রী অমিত মিত্রের মাতৃদেবী, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ভাইজি, সুরেশচন্দ্র বসুর কন্যা বেলা বসু। ওই চারজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর একজন হলেন হরিদাস মিত্র, যিনি ছিলেন বেলাদেবীর স্বামী।  ১৯৭২ সালে হরিদাসবাবু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন।  বাকি তিন বিপ্লবী হলেন পবিত্র রায়, জ্যোতিষচন্দ্র বসু  ও  অমর  সিং গিল।

১৯২০ সালে মাতুলালয় ভাগলপুরে জন্মেছিলেন বেলাদেবী।  তাঁর পিত্রালয় ছিল দক্ষিণ  ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে। ১৯৩৬ সালে তিনি  আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্তচর বিভাগের অন্যতম প্রধান  যশোর নিবাসী হরিদাসের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

বিবাহের বছর দুয়েকের মধ্যে বেলাদেবী তাঁর শশুরবাড়িতে গড়ে তুললেন মহিলা সমিতি।  ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন থেকে বেরিয়ে নেতাজি  আপস বিরোধী সম্মেলনের ডাক দেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সী বেলা সেই সম্মেলনের মহিলা শাখার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।  ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেহালার বাড়ি থেকে তিনি ট্রান্সমিটার মারফত সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুনে নেতাজির সঙ্গে সংবাদ বিনিময়ের ব্যবস্থা করেন।  নেতাজির পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের উড়িষ্যার কোনারক মন্দিরের কাছে নিরাপদে অবতরণ করার জন্য বেলা ও তাঁর স্বামী প্রভূত সহায়তা করেন।  বেলা দেবীকে এজন্য নিজের প্রায় সমস্ত গহনা বিক্রয় করতে হয়েছিল, হয়েছিল তাঁদের জীবন বিপন্ন।

নেতাজি তখন বিদেশে। ৬এ বিপিন পাল রোডের বাড়িতে ব্রিটিশ পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সুভাষ অনুগামী চার বিপ্লবীর  কার্য্যকলাপ চলতো।  তাঁরা এই বাড়িটিতে একটি টেলিগ্রাফ সেট বসিয়েছিলেন। এই টেলিগ্রাফ সেটের সাহায্যে তাঁরা সাংকেতিক ভাষায় গোপন খবর নেতাজিকে পাঠাতেন। মূলত এই কাজটি জ্যোতিষচন্দ্র বসু করতেন তাকে সহায়তা করতেন হরিদাস মিত্র ও পবিত্র রায়।  ১৯৪৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার হলেন জ্যোতিষচন্দ্র বসু।  তার কয়েকদিনের মধ্যে গ্রেফতার হলেন হরিদাস মিত্র, ওমর সিং গিল ও পবিত্র রায়। তাঁদের সকলকেই প্রথমে রাখা হয়েছিল লর্ড সিনহা রোডের গোয়েন্দা বিভাগের বাড়িতে।  নেতাজিকে সাংকেতিক ভাষায় জানানো বিভিন্ন সংবাদ জানার জন্য পুলিশ অকথ্য অত্যাচার চালাতো এই বিপ্লবীদের ওপর। কিছুদিন পরে অমর সিং গিল ও জ্যোতিষচন্দ্র কে রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে আর হরিদাস মিত্র ও পবিত্র রায়কে রাখা হয়েছিল আলিপুর জেলে। অল্প দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর  চার বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশ হল। জেলেরই এক কর্মীর পরামর্শে হরিদাস মিত্রের স্ত্রী ২২ বছরের বেলাদেবী  ও জ্যোতিষচন্দ্রের পিতা রঞ্জন বিলাস বসু পুনায় গিয়ে মহাত্মা গাঁধীর স্বরণাপন্ন হলেন। গাঁধীজি যদি ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড ওভেলকে অনুরোধ করে পত্র দেন তাহলে এই চার বিপ্লবীর ফাঁসির হুকুম রদ হতে পারে এমনই তাঁদের ধারণা ছিল।  সত্যি সত্যি  একদিন সেই  অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। রদ হল  তাঁদের ফাঁসির আদেশ।  শুধু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে  তাঁরা দণ্ডিত হলেন। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টায় শেষমেশ সবার মৃত্যুদণ্ড মকুব হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। 

আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপচর বিভাগের অন্যতম প্রধান  দায়িত্ব হরিদাস ও বেলা বহুদিন সামলেছেন  যখন হরিদাস যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জেলে ছিলেন, তখন বেলা নিজ হাতে সব  কিছু সামলেছিলেন। শ্রী হরিদাস মিত্র স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের টিকিটে জিতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার হন।  কিন্তু বেলাদেবী স্বামীর মতো রাজনীতিরআঙিনায় পা রাখেননি।  ১৯৪৭ সালে বেলাদেবী আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টের (Rani of Jhansi Regiment)  আদর্শে তৈরী  করেন 'ঝাঁসি রানী বাহিনী'। যার সর্বাধিনায়ক তিনিই হন। স্বাধীনতার পর শিয়ালদহ ও অন্য কয়েকটি জায়গায় শরণার্থীদের ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৫০ সালে বালি ও ডানকুনির মধ্যবর্তী জায়গায় অভয়নগর অঞ্চলে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন। কঠিন পরিশ্রমের ফলে তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই ভেঙে পড়তে লাগলো। তিনি কঠিন রোগে পড়লেন।  অবশেষে ১৯৫২ সালের ৩১শে জুলাই মাত্র ৩২ বছর বয়সে এই মহিয়সী মহিলার জীবনাবসান হয়। চিরকালই তিনি পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করে গেছেন। 

১৯৫৩ সালে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে অভয়নগর অঞ্চলের নামটির পরিবর্তন করে বেলানগর করা হয়।  ১৯৫৮ সালে ভারতীয় রেল ওই  অঞ্চলে একটা নতুন স্টেশন তৈরী করে তার নামে  নামাঙ্কিত করে।

এবছর অর্থাৎ ২০২০ সালে তার জন্মশতবর্ষ। কেউ আজ আর তাঁর নাম করে না। সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোথাও তাঁর জন্ম শতবর্ষের কথা শোনা যায় না।  কোথাও তাঁর একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেও শুনিনি।  কত সহজেই এই মহিয়সী নারীকে আমরা ভুলে গেলাম।




ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ২৮-০৩-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 







Monday, March 9, 2020

ল্যাংচা ও শক্তিগড়>P

ল্যাংচা ও শক্তিগড়





বাঙালির খাদ্য তালিকা মিষ্টান্ন ছাড়া ভাবা যায় না। শেষ পাতে মিষ্টি চাইই  চাই।  উৎসব অনুষ্ঠান হোক বা অতিথি আপ্যায়ন হোক রসনা তৃপ্তির জন্য মিষ্টি  অপরিহার্য।  বাংলার মিষ্টিও বৈচিত্রময়।  একেক জায়গা একেক ধরণের মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। স্থান বিশেষে বাঙালির মিষ্টি বিশ্ব জয় করেছে।

বাংলা অভিধানে ল্যাংচা কথাটির অর্থে বলা আছে পঙ্গু বা খোঁড়া অথচ এই শব্দটি বাঙালির রসনা তৃপ্তির জন্য একটি  অনবদ্য শব্দ।  বর্ধমান রাজপরিবারে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের কন্যার বিবাহ হয়েছিল।  বর্ধমান রাজার এই পুত্রবঁধুর গর্ভে যখন সন্তানের  আগমন ঘটলো তখন তাঁর মুখে কোনো সুখাদ্য ভালো লাগছিল না।  পরিবারের লোকেরা এই বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। একদিন বর্ধমান মহিষী অর্থাৎ বঁধুটির শাশুড়ি তাঁর কাছে জানতে চাইলেন তাঁর কি খেতে ইচ্ছে করছে। বালিকা বঁধুটি নতমুখে বলে ফেলেছিলো তাঁর ল্যাংচা খাওয়ার ইচ্ছে করছে।  কিন্তু ল্যাংচা কথাটি রানী পূর্বে কোনোদিন শোনেন নি। তিনি পরিবারের সবার কাছে কথাটি জানালেন। কেউই শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলেন না।  পরেরদিন রাজপুত্র সবার সামনে তাঁর মাকে জানালেন ল্যাংচা কোনো খাদ্যদ্রব্য নয়। একপ্রকার মিষ্টান্ন।  রাজবঁধু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে এক রকম মিষ্টান্ন খেয়েছিলেন, যে মিষ্টান্নটি একজন খোঁড়া মানুষ তৈরী করেছিলেন।  আজ আর তাঁর বঁধুসেই মিষ্টান্নটির নামটা মনে করতে পারছেন না।  সেই খোঁড়া মেঠাইওয়ালার তৈরী সেই মিষ্টিটি তাঁর খাওয়ার স্বাদ হয়েছে। রাজমহিষী গোপনে সংবাদটা মহারাজকে জানালেন।  বর্ধমান মহারাজ  কথাটি শোনার পরই তাঁর বিশ্বস্ত একজন অশ্বারোহীকে একটি জরুরি ও গোপন পত্র দিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে পাঠালেন। কয়েকদিনের মধ্যেই অশ্বারোহী নদিয়ার সেই খোঁড়া ময়রাকে বন্দী করে নিয়ে এসে বর্ধমান রাজপ্রাসাদে হাজির করলেন।  বর্ধমানরাজ সেই ময়রাকে বর্ধমান শহরের পুবদিকে প্রায় ক্রোস চারেক দূরে বড়সুল গ্রামে কিছু ভূসম্পত্তি দান করলেন এবং তার বসবাসের জন্য একটি ঘরও তৈরী করে দিলেন।  প্রতিদিন ময়রার ভিয়েন থেকে রাজবাড়িতে প্রায় মন খানিক এই বিচিত্র ধরণের মিষ্টান্ন সরবরাহ হতে লাগল। খোঁড়া ময়রা প্রতিষ্ঠা পেলেন ল্যাংচা বিশারদ হিসেবে। উপরিউক্ত কাহিনীটি বিখ্যাত লেখক নারায়ণ স্যান্যালের 'রূপমঞ্জরী' উপন্যাস অবলম্বনে লেখা। ল্যাংচা বিশেষভাবে তৈরী একপ্রকার রসের  ভাজা মিষ্টি, খেতে খুবই সুস্বাদু ও নরম।  রঙ হয় কালচে বাদামি। ময়দা, ছানা, খোয়া ক্ষীর ও চিনির সাহায্যে এই মিষ্টি তৈরী করা হয়।


কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরে বর্ধমান বা বোলপুর-শান্তিনিকেতন যাওয়ার সময় সবাই শক্তিগড়ে যাত্রাবিরতি নেয়।  এই শক্তিগরের পূর্বে নাম ছিল বড়সুল। রাস্তাটার দুধারে অসখ্য মিষ্টির দোকান। দোকানগুলোর নাম বেশিরভাগ ল্যাংচা শব্দটি দিয়ে কোনটা ল্যাংচা ঘর, কোনটা ল্যাংচা সম্রাট, ল্যাংচা প্লাজা, ল্যাংচা নিকেতন আবার কোনটা ল্যাংচা কুঠি এরকম। বাহারি স্বাদের মতো নামের বাহার সব।   সেখানেই পাওয়া যায় এই সুবিখ্যাত ও সুস্বাদু মিষ্টিটি।  গাড়ি থামিয়ে গরম গরম ল্যাংচার স্বাদ নিতে কেউ ভোলে না। যদিও বর্তমানে ল্যাংচা আর শক্তিগড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই তা পৌঁছে গেছে  ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই।  তবে শক্তিগড়ের ল্যাংচার স্বাদ ভিন্ন ধরণের। রসগোল্লা, ল্যাংচা, সন্দেশ বাঙালির খুবই প্রিয়। শক্তিগড়ের ল্যাংচা খাননি এরকম বাঙালি বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্ধমানের শক্তিগড়ের ল্যাংচা ছাড়াও সীতাভোগ ও মিহিদানাও খুব প্রসিদ্ধ। বছর আড়াই আগে বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহিদানা ভৌগোলিক স্বীকৃতি (জি. আই) পেয়েছে। এবার শক্তিগড়ের ল্যাংচার এই স্বীকৃতি পাওয়ার পালা।


ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ১০-০৩-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Tuesday, March 3, 2020

রবিকথা>P

রবিকথা ...






রবীন্দ্রনাথকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাঁর মৃত্যুর অন্তত বছর কুড়ি বাদে আমি পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কথা বাল্যকাল থেকেই বাড়ির বড়দের কাছ থেকে শুনতে অভ্যস্থ ছিলাম। বালক বয়সেই শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কথাও শুনি। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গল্প বাবার কাছে বাল্য বয়সেই শুনেছিলাম, আর বড় বয়সে এসে সংবাদপত্রের মাধ্যমে সেই নোবেল পুরস্কারের চুরি যাওয়ার কথাও জেনেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ।  আমি জানি রবীন্দ্রনাথের সব কিছু সবাই জানেন তবুও আমার উপলদ্ধিকে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

ছেলেবেলায় বড়দের দেখতাম রবীন্দ্রনাথের নামের আগে কবিগুরু কথাটি বসাতে। তখন ধারণা ছিল তিনি শুধুমাত্র একজন কবি ছিলেন। পরবর্তীকালে নানারকম বই পড়ার মাধ্যমেই জেনেছিলাম তিনি কেবল কবি নন।  কাব্য রচনাই  তাঁর একমাত্র রচনা নয়।  সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক শিরোমণি। তিনি শুধু কবি-সাহিত্যিক নন, একজন মহা-মনীষীও বটে। ভারতের স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম প্রথিকৃৎ। রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি দেশবাসীকে সত্য পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।  বিশ শতকের প্রথম দশকে বাঙালির জাতীয় জীবনে নবজাগরণ দেখা দেয়।  লর্ড কার্জন বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার চক্রান্ত করেন। কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলার বুকে জাতীয়তাবাদের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো। বাংলা থেকেই ভারতের সর্বত্র জাতীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। তার পরিপেক্ষিতে মহারাষ্ট্রের অন্যতম জননায়ক গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন "What bengal thinks today India thiinks tomorrow week"। যে বন্দেমাতরম মন্ত্র বাঙালির মনে জাতীয়তাবোধের প্রতীক হয়ে ওঠে সেই মন্ত্রের স্রষ্টা ছিলেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী অরবিন্দ দেশপ্রেমের বাণী প্রচার করেন। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও অন্যান্য কবিরা সব অপূর্ব দেশপ্রেমের গান রচনা করে নবযুগকে সাদরে আহ্বান করেন  ১৬ই আগস্ট ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব পাশ হয়।  ঐদিনটি ছিল রাখী পূর্ণিমার দিন।  রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে হিন্দু-মুসলমান দাদা ভাইয়ের হাতে হিন্দু বোনেদের রাখী বাঁধার উৎসব পালিত হয়। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের হাতে ভালোবাসার রাখী বেঁধে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন পাকা করলেন। কবি এইভাবেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।

কবি ও শিল্পীদের  চিত্ত বরাবরই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল হয়। স্বদেশী যুগ ছিল উদ্দীপনার ও উন্মাদনার যুগ। স্বদেশপ্রেমীরা সেই উদ্দীপনায় গা ভাসিয়েছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। রবীন্দ্রনাথও সেই উন্মাদনার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না।  স্বদেশী যুগে হোক বা তার পরবর্তী যুগের রাজনৈতিক ঘটনাগুলো স্বভাবতই তাঁর চিত্তে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা কেবল তাঁর গান বা প্রবন্ধে বা আলাপ-আলোচনায় প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর রচিত 'গোরা', 'ঘরে-বাইরে' এবং বিশেষভাবে 'চার অধ্যায়' উপন্যাসেও তা প্রকাশ পেয়েছিল।  বিভিন্ন প্রবন্ধ ও উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার ভাবনাগুলো।  রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর অপর  স্মরণীয় ঘটনা হল 'নাইটহুট' উপাধি ত্যাগ করা। জালিয়ানওয়ালাবাদে ইংরেজদের পাশবিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ওই উপাধি ত্যাগ করেন। এটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা।  ১৯১৫ সালে তাঁকে 'নাইটহুট' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ১৯১৯ সালের ৩০শে মে তিনি বড়লাট লর্ড চেমস্ফোর্ডকে  চিঠি লিখে  উপাধি ত্যাগ করার কথা জানান।  তাঁর পৃথিবীজোড়া খ্যাতির জন্যই চিঠিখানা দেশ বিদেশে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

রবীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পী হিসেবেও তাঁর প্রতিভার সাক্ষ্য রেখে গেছেন। জীবনের শেষ  দিকে এসে তিনি চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। চিত্রকলায় তাঁর কোনো প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না।  তাঁর আঁকা ছবিগুলো ছিল সার্থক শিল্পসৃষ্টি। তিনি তাঁর অঙ্কিত  ছবিগুলো নিয়ে গর্ব অনুভব করতেন।  বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসুও তার আঁকা ছবিগুলোর উচ্চ প্রশংসা করে গেছেন। আজও শান্তিনিকেতনের বিচিত্রভবনে ছবিগুলো রাখা আছে, যা চিত্রানুরাগীদের আকর্ষণের বস্তু হয়ে আছে।

দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর প্রতিভার পরিচয় রেখে গেছেন। দেশের সম্মুখে তিনি শিক্ষার এক নতুন আদর্শ স্থাপন করেন। সেই আদর্শ দেশবাসী ও সরকারের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তৎকালীন সময়ে বিদ্যালয়গুলোর প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রতিবাদেই শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা পাঠভবন বিদ্যালয়টি ১৩০৮ সালের ৭ই পৌষ (১৯০১ সালের ২২শে  ডিসেম্বর) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  তিনি মনে করতেন শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষ গড়া, পূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশ। সেই আদর্শকে সামনে রেখেই শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় ও আশ্রম স্থাপন করেছিলেন। যা আজ  এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে।  তাঁর নিজের মূল্যবান সময় ও শক্তি অকৃপণভাবে আশ্রমের সেবায় অর্পণ করেছিলেন। যদিও শান্তিনিকেতনের জমি কিনেছিলেন তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তিনি এখানে একটি প্রার্থনা কক্ষও তৈরী করেছিলেন। আশ্রমের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও মহর্ষির প্রভাব পরোক্ষভাবে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালের শিক্ষাও শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিজ্ঞান শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, সংগীত শিক্ষার সাথে চিত্রবিদ্যার শিক্ষাও শান্তিনিকেতনে অন্যতম ছিল, বর্তমানেও তা রয়েছে।  দেশের বহু নামি-দামি শিল্পীর হাতেখড়ি এখানেই হয়েছিল। শুধু শিক্ষা নয় তার সাথে খেলাধুলার প্রচলন করেছিলেন। সেকালে বাংলার স্কুলগুলোতে শুধুমাত্র ভারতের ইতিহাস পড়ানোর রেওয়াজ ছিল, কিন্তু এখানে তিনি সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস পোড়ানো শুরু করেন।  বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশীলতার উন্মেষই তাঁর শিক্ষার প্রকৃত আদর্শ ছিল। তাঁর কাছে প্রকৃতির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।  তাই তিনি মুক্ত আকাশে গাছের তলায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করতেন। সমাজ কল্যাণ সাধনে ও পল্লীবাসীদের উন্নয়ন সাধনে তাঁর পরিকল্পনাই শ্রীনিকেতনের বাস্তবরূপ।  শ্রীনিকেতন আজ নানাভাবে তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে চারপাশের পল্লীগুলোর শ্রী ফেরানোর চেষ্টা করছে, পল্লীবাসীদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য তিনি বস্ত্র ও চর্ম শিল্প প্রচলন করেছিলেন। গ্রামগুলোর অশিক্ষা দূর ও তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ফোটানোর চেষ্টা আজও করে চলেছে শ্রীনিকেতন।  শ্রীনিকেতন এমন একটা প্রতিষ্ঠান যার মূল্য দেশ ও দেশের সরকার উপলব্ধি করছে।

বাইরে রবীন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয় ছিল কবি-সাহিত্যিক হিসেবে কিন্তু শান্তিনিকেতনে তিনি গুরুদেব বলে পরিচিত ছিলেন। শোনা যায় আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় তাঁর প্রথম সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মহাশয়। তিনিই তাঁকে গুরুদেব আখ্যা দেন।  আশ্রমের ছাত্র ও শিক্ষকগণ তাঁকে গুরুদেব ছাড়া ভাবতে পারতেন না, আজও পারেন না।  তিনি মনে করতেন অধ্যাত্ব্য জীবনের উৎকর্ষ সাধনই মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।  তাই তিনি এখানে সকাল সন্ধ্যায় উপাসনার প্রবর্তন করেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি প্রত্যহ উপসনা করতেন। ৭ই পৌষ মহর্ষি ব্রহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন সেই দিনটিকে স্মরণে রাখার অভিলাষে রবীন্দ্রনাথ ৭ই পৌষ তাঁর বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। মহর্ষির জীবনে উপনিষদের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।  রবীন্দ্রনাথের মন্দিরের ভাষণেও উপনিষদের ঋষিবাক্যগুলো বারবার উঠে আসতো। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ধর্মের জয় হয়, অধর্ম সাময়িকভাবে সুখকর হলেও পরিণামে সমূলে বিনাশের কারণ হয়।  তিনি আরো মনে করতেন যিনি শান্তম তিনিই শিবম, তিনি আবার অদ্বৈতম। এই শান্তম শিবম অদ্বৈতম মন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথের অবচেতন ও জাগ্রত মনের কথা।  তাঁর অবচেতন মনে প্রতিনিয়ত মন্ত্রটি কাজ করে চলতো। তাঁর জীবনে যেমন শান্তিনিকেতন তেমন মন্ত্রটির বিশেষ স্থান ছিল। আশ্রমগুরু আশ্রমবাসীদের প্রকৃত কল্যাণের পথ মন্ত্রটির মাধ্যমে নির্দেশ করেছেন।

ছোটগল্প, নাট্যসাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রকলা ও সংগীতের মধ্যে তাঁর সাহিত্য কর্ম ছড়িয়ে আছে। তিনি প্রায় হাজার পঁচিশেক গান লিখে গেছেন। রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিত গানগুলি বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা তিনিই ছিলেন। তাঁর কাব্য বহুবর্ণময়। কখনো রক্ষণশীল ধ্রুপদী শৈলীতে, কখনো হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনো বা দার্শনিকের গাম্ভীর্যে আবার কখনো বা আনন্দের উচ্ছাসে কাব্যগুলি উদ্ভাসিত।

 রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আশ্রমের ছাত্র ও শিক্ষক উভয়েরই গুরুদেব, সমগ্র বাঙালি জাতিরও গুরুদেব। তিনি কেবল কবি-সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রকৃত জীবনশিল্পীও। শান্তিনিকেতন ছিল তাঁর তপস্যাকেন্দ্র। এই তপস্যাকেন্দ্রেই তিনি তাঁর জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছেন। তাঁর অনন্য সাধারণ প্রতিভার সাথে অনলস সাধনা যুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছিল এক মহান জীবন।

রবীন্দ্রনাথ এক অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক ব্যতিক্রমী  ব্যক্তিত্ব।  তাঁর আবির্ভাবের প্রায় ১৬০ বছর পর তিনি আমাদের কাছে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের শোকে-দুঃখে, আনন্দে-উৎসাহে যার অস্তিত্ব আমরা সবসময় অনুভব করে থাকি। আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি কেবল নিজের সাথে নিজেই তুলনীয়।  মহাকাল তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। যুগে যুগে, জন্ম-জন্মান্তরে তাঁর অমরত্ব নিয়েই বাঙালি তথা ভারতবাসীর কাছে তিনি চিরকালীন হয়ে থাকবেন। তিনি  ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর উদ্ভাসিত মহিমা আজও এবং ভবিষ্যতেও আমাদের সঠিক ও পরিপূর্ণ জীবন গঠনে সহায়তা করে চলবে। বাঙালি জীবনে তিনি বরাবরই একটা 'রোল মডেল' হয়ে থাকবেন।






ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ০৩-০৩-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।