মহামারী ও কোয়ারান্টাইন
'মহামারী' এই শব্দটা শুনলেই মানুষ ভীত হয়ে ওঠে। শব্দটি সত্যিই ভয়াবহ। সাধারণত কোনো সংক্রমণ রোগ দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যে কোন দেশের জনসংখ্যার এই বৃহৎ সংখ্যক লোকের মধ্যে সংক্রমিত হয় তাকেই 'মহামারী' বলা হয়ে থাকে। মহামারীর ভয়াবহতা বারবার বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের কল্লোলিনী কলকাতাকেও একাধিকবার ছিন্ন-ভিন্ন করেছে। অষ্টাদশ-উনিশ শতকে কলকাতায় প্রায় প্রতিবছর মহামারী লেগে থাকতো। সাবেক কলকাতায় প্লেগ, আমাশা, কলেরায় বহু সাহেবকে আমরা মারা যেতে দেখেছি। সেই আমলের পত্র-পত্রিকাগুলোতে সেইসব বিবরণ ছাপার অক্ষরে বের হতো। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাবো মহামারী কিন্তু ঘুরে ঘুরে দেখা দেয়। ২০২০ সালের প্রথম থেকেই 'কোভিড -১৯' নামাঙ্কিত এক ভাইরাস ধীরে ধীরে পৃথবীর বুকে থাবা বসিয়ে চলেছে। গোটা বিশ্বই কম বেশি সংক্রমিত। ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। মহামারী প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় অতীতের কিছু ঘটনার কথা। অসুখ থেকে দূরে রাখার তারিকাটি অর্থাৎ কোয়ারান্টিনে পাঠানোর ইতিহাসটি দীর্ঘদিনের। এই পদ্ধতি নানা দেশে নানা সময়ে কাজে লাগতে দেখা গেছে।
১৩৪০ সাল। মধ্য এশিয়া থেকে সিল্ক রুট ধরে ক্রিমিয়া হয়ে এক ভয়ঙ্কর রোগ ইউরোপে হানা দিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে মারা যেতে লাগলো। রোগটির নাম 'বিউবোনিক প্লেগ', কিন্তু লোকেরা রোগটির 'ব্ল্যাক ডেথ' নাম দিল। দশকে পর দশকে রোগটি ইউরোপে বার বার ফিরে আসতো। ১৩৭০ সালেও রোগটি এসেছিল। ১৩৭৩ সালে ভেনিসের কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিল তাদের বন্দরে যেসব জাহাজ ভিড়বে সেইসব জাহাজে যদি কোন প্লেগ আক্রান্ত রুগী থাকে, তাকে ভেনিসে ঢোকার আগেই একটা দ্বীপে চল্লিশ দিন অপেক্ষা করতে হবে। তারপর তাকে শহরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে।
১৭৯৩ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহরে এক ধরণের জ্বর দেখা দিল। এই জ্বরে শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ লোক মারা যায়। জ্বরটির নাম 'ইয়োলো ফিভার'। কারো কারো মতে এটা মশা বাহিত রোগ আবার কারো কারো মতে নাবিকদের থেকেই রোগটি ছড়াচ্ছে। ১৭৯৯ সালে স্থানীয় প্রশাসন ঠিক করলো শহরের বাইরে একটা বিশাল 'কোয়ারেন্টাইন সেন্টার' নির্মাণ করবে। শহরে আসা জাহাজে যদি কেউ অসুস্থ থাকে প্রথমেই তাকে ওই সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
১৮৯২ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডে রাশিয়া থেকে ইহুদিদের একটা জাহাজ এসে ভিড়েছিল। জাহাজটিতে প্রায় জনা সত্তর যাত্রী ছিল। দেখা গেলো দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ফলে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ফলে জাহাজটির বেশিরভাগ যাত্রীর সারা গায়ে থিক থিক করছে উকুন। এই উকুন থেকে আবার অনেকে টাইফয়েড রোগেও আক্রান্ত হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ইস্ট রিভার নদীর নর্থ ব্রাদার দ্বীপে তাঁবু খাটিয়ে রুগীদের শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দেওয়া হয়।
১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল। রোগ সংক্রমণের ভয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বহু অঞ্চলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগ লোক মারা গিয়েছিল। আনুমানিক প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমেরিকায় জনসমাবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি বিভিন্ন নথিতে ও সংবাদ মাধ্যমগুলো অসুখের ভয়াবহতা অনেকটা কম করে দেখিয়েছিল। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল স্পেনে এই রোগের প্রকোপ সব থেকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেই কারণে বিশ্ব জুড়ে রোগটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'স্প্যানিশ ফ্ল'।
আর একটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিদিনের জন্য কোয়ারান্টিনে কে ছিলেন ?
১৯০৭ সাল। মেরী ম্যালোন, পেশায় একজন পাচক ছিলেন। জন্মসূত্রে আইরিশ হলেও তিনি মার্কিন নাগরিক ছিলেন। তিনি এক সংক্রমক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যে সব বাড়িতে তিনি রান্নার কাজ করতেন প্রথমে সেই সব পরিবারের লোকদের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বন্ধু -বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ও পাড়া-পড়শির মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর মৃত্যুও ঘটে। মেরী ম্যালোন অবশ্য জীবিত ছিলেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাকে পাকড়াও করে তিন বছরের জন্য নিউ ইয়ার্কের নর্থ ব্রাদার আইল্যান্ডের কোয়ারান্টিনে পাঠিয়ে দেয়। কোয়ারান্টিনে থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আর পাচকের কাজ করবেন না, কিন্তু ১৯১৫ সালে তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তাকে কর্তৃপক্ষ আবার পাকড়াও করে সারা জীবনের জন্য ওই দ্বীপের কোয়ারান্টিনে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তিনি ২৩টা বছর বেঁচেছিলেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম কোয়ারান্টিনে থাকার নমুনা হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র : এই সময় সংবাদপত্র (২২-০৩-২০২০)
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ৩০-০৩-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
১৭৯৩ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহরে এক ধরণের জ্বর দেখা দিল। এই জ্বরে শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ লোক মারা যায়। জ্বরটির নাম 'ইয়োলো ফিভার'। কারো কারো মতে এটা মশা বাহিত রোগ আবার কারো কারো মতে নাবিকদের থেকেই রোগটি ছড়াচ্ছে। ১৭৯৯ সালে স্থানীয় প্রশাসন ঠিক করলো শহরের বাইরে একটা বিশাল 'কোয়ারেন্টাইন সেন্টার' নির্মাণ করবে। শহরে আসা জাহাজে যদি কেউ অসুস্থ থাকে প্রথমেই তাকে ওই সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
১৮৯২ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডে রাশিয়া থেকে ইহুদিদের একটা জাহাজ এসে ভিড়েছিল। জাহাজটিতে প্রায় জনা সত্তর যাত্রী ছিল। দেখা গেলো দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ফলে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ফলে জাহাজটির বেশিরভাগ যাত্রীর সারা গায়ে থিক থিক করছে উকুন। এই উকুন থেকে আবার অনেকে টাইফয়েড রোগেও আক্রান্ত হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ইস্ট রিভার নদীর নর্থ ব্রাদার দ্বীপে তাঁবু খাটিয়ে রুগীদের শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দেওয়া হয়।
১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল। রোগ সংক্রমণের ভয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বহু অঞ্চলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের একভাগ লোক মারা গিয়েছিল। আনুমানিক প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমেরিকায় জনসমাবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি বিভিন্ন নথিতে ও সংবাদ মাধ্যমগুলো অসুখের ভয়াবহতা অনেকটা কম করে দেখিয়েছিল। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল স্পেনে এই রোগের প্রকোপ সব থেকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেই কারণে বিশ্ব জুড়ে রোগটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'স্প্যানিশ ফ্ল'।
আর একটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিদিনের জন্য কোয়ারান্টিনে কে ছিলেন ?
১৯০৭ সাল। মেরী ম্যালোন, পেশায় একজন পাচক ছিলেন। জন্মসূত্রে আইরিশ হলেও তিনি মার্কিন নাগরিক ছিলেন। তিনি এক সংক্রমক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যে সব বাড়িতে তিনি রান্নার কাজ করতেন প্রথমে সেই সব পরিবারের লোকদের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বন্ধু -বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ও পাড়া-পড়শির মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর মৃত্যুও ঘটে। মেরী ম্যালোন অবশ্য জীবিত ছিলেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাকে পাকড়াও করে তিন বছরের জন্য নিউ ইয়ার্কের নর্থ ব্রাদার আইল্যান্ডের কোয়ারান্টিনে পাঠিয়ে দেয়। কোয়ারান্টিনে থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আর পাচকের কাজ করবেন না, কিন্তু ১৯১৫ সালে তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তাকে কর্তৃপক্ষ আবার পাকড়াও করে সারা জীবনের জন্য ওই দ্বীপের কোয়ারান্টিনে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তিনি ২৩টা বছর বেঁচেছিলেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম কোয়ারান্টিনে থাকার নমুনা হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র : এই সময় সংবাদপত্র (২২-০৩-২০২০)
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ৩০-০৩-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।