Tuesday, March 3, 2020

রবিকথা>P

রবিকথা ...






রবীন্দ্রনাথকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাঁর মৃত্যুর অন্তত বছর কুড়ি বাদে আমি পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কথা বাল্যকাল থেকেই বাড়ির বড়দের কাছ থেকে শুনতে অভ্যস্থ ছিলাম। বালক বয়সেই শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কথাও শুনি। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গল্প বাবার কাছে বাল্য বয়সেই শুনেছিলাম, আর বড় বয়সে এসে সংবাদপত্রের মাধ্যমে সেই নোবেল পুরস্কারের চুরি যাওয়ার কথাও জেনেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ।  আমি জানি রবীন্দ্রনাথের সব কিছু সবাই জানেন তবুও আমার উপলদ্ধিকে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

ছেলেবেলায় বড়দের দেখতাম রবীন্দ্রনাথের নামের আগে কবিগুরু কথাটি বসাতে। তখন ধারণা ছিল তিনি শুধুমাত্র একজন কবি ছিলেন। পরবর্তীকালে নানারকম বই পড়ার মাধ্যমেই জেনেছিলাম তিনি কেবল কবি নন।  কাব্য রচনাই  তাঁর একমাত্র রচনা নয়।  সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক শিরোমণি। তিনি শুধু কবি-সাহিত্যিক নন, একজন মহা-মনীষীও বটে। ভারতের স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম প্রথিকৃৎ। রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি দেশবাসীকে সত্য পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।  বিশ শতকের প্রথম দশকে বাঙালির জাতীয় জীবনে নবজাগরণ দেখা দেয়।  লর্ড কার্জন বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার চক্রান্ত করেন। কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলার বুকে জাতীয়তাবাদের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো। বাংলা থেকেই ভারতের সর্বত্র জাতীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। তার পরিপেক্ষিতে মহারাষ্ট্রের অন্যতম জননায়ক গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন "What bengal thinks today India thiinks tomorrow week"। যে বন্দেমাতরম মন্ত্র বাঙালির মনে জাতীয়তাবোধের প্রতীক হয়ে ওঠে সেই মন্ত্রের স্রষ্টা ছিলেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী অরবিন্দ দেশপ্রেমের বাণী প্রচার করেন। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও অন্যান্য কবিরা সব অপূর্ব দেশপ্রেমের গান রচনা করে নবযুগকে সাদরে আহ্বান করেন  ১৬ই আগস্ট ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব পাশ হয়।  ঐদিনটি ছিল রাখী পূর্ণিমার দিন।  রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে হিন্দু-মুসলমান দাদা ভাইয়ের হাতে হিন্দু বোনেদের রাখী বাঁধার উৎসব পালিত হয়। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের হাতে ভালোবাসার রাখী বেঁধে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন পাকা করলেন। কবি এইভাবেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।

কবি ও শিল্পীদের  চিত্ত বরাবরই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল হয়। স্বদেশী যুগ ছিল উদ্দীপনার ও উন্মাদনার যুগ। স্বদেশপ্রেমীরা সেই উদ্দীপনায় গা ভাসিয়েছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। রবীন্দ্রনাথও সেই উন্মাদনার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না।  স্বদেশী যুগে হোক বা তার পরবর্তী যুগের রাজনৈতিক ঘটনাগুলো স্বভাবতই তাঁর চিত্তে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা কেবল তাঁর গান বা প্রবন্ধে বা আলাপ-আলোচনায় প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর রচিত 'গোরা', 'ঘরে-বাইরে' এবং বিশেষভাবে 'চার অধ্যায়' উপন্যাসেও তা প্রকাশ পেয়েছিল।  বিভিন্ন প্রবন্ধ ও উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার ভাবনাগুলো।  রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর অপর  স্মরণীয় ঘটনা হল 'নাইটহুট' উপাধি ত্যাগ করা। জালিয়ানওয়ালাবাদে ইংরেজদের পাশবিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ওই উপাধি ত্যাগ করেন। এটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা।  ১৯১৫ সালে তাঁকে 'নাইটহুট' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ১৯১৯ সালের ৩০শে মে তিনি বড়লাট লর্ড চেমস্ফোর্ডকে  চিঠি লিখে  উপাধি ত্যাগ করার কথা জানান।  তাঁর পৃথিবীজোড়া খ্যাতির জন্যই চিঠিখানা দেশ বিদেশে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

রবীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পী হিসেবেও তাঁর প্রতিভার সাক্ষ্য রেখে গেছেন। জীবনের শেষ  দিকে এসে তিনি চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। চিত্রকলায় তাঁর কোনো প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না।  তাঁর আঁকা ছবিগুলো ছিল সার্থক শিল্পসৃষ্টি। তিনি তাঁর অঙ্কিত  ছবিগুলো নিয়ে গর্ব অনুভব করতেন।  বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসুও তার আঁকা ছবিগুলোর উচ্চ প্রশংসা করে গেছেন। আজও শান্তিনিকেতনের বিচিত্রভবনে ছবিগুলো রাখা আছে, যা চিত্রানুরাগীদের আকর্ষণের বস্তু হয়ে আছে।

দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর প্রতিভার পরিচয় রেখে গেছেন। দেশের সম্মুখে তিনি শিক্ষার এক নতুন আদর্শ স্থাপন করেন। সেই আদর্শ দেশবাসী ও সরকারের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তৎকালীন সময়ে বিদ্যালয়গুলোর প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রতিবাদেই শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা পাঠভবন বিদ্যালয়টি ১৩০৮ সালের ৭ই পৌষ (১৯০১ সালের ২২শে  ডিসেম্বর) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  তিনি মনে করতেন শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষ গড়া, পূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশ। সেই আদর্শকে সামনে রেখেই শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় ও আশ্রম স্থাপন করেছিলেন। যা আজ  এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে।  তাঁর নিজের মূল্যবান সময় ও শক্তি অকৃপণভাবে আশ্রমের সেবায় অর্পণ করেছিলেন। যদিও শান্তিনিকেতনের জমি কিনেছিলেন তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তিনি এখানে একটি প্রার্থনা কক্ষও তৈরী করেছিলেন। আশ্রমের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও মহর্ষির প্রভাব পরোক্ষভাবে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালের শিক্ষাও শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিজ্ঞান শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, সংগীত শিক্ষার সাথে চিত্রবিদ্যার শিক্ষাও শান্তিনিকেতনে অন্যতম ছিল, বর্তমানেও তা রয়েছে।  দেশের বহু নামি-দামি শিল্পীর হাতেখড়ি এখানেই হয়েছিল। শুধু শিক্ষা নয় তার সাথে খেলাধুলার প্রচলন করেছিলেন। সেকালে বাংলার স্কুলগুলোতে শুধুমাত্র ভারতের ইতিহাস পড়ানোর রেওয়াজ ছিল, কিন্তু এখানে তিনি সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস পোড়ানো শুরু করেন।  বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশীলতার উন্মেষই তাঁর শিক্ষার প্রকৃত আদর্শ ছিল। তাঁর কাছে প্রকৃতির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।  তাই তিনি মুক্ত আকাশে গাছের তলায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করতেন। সমাজ কল্যাণ সাধনে ও পল্লীবাসীদের উন্নয়ন সাধনে তাঁর পরিকল্পনাই শ্রীনিকেতনের বাস্তবরূপ।  শ্রীনিকেতন আজ নানাভাবে তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে চারপাশের পল্লীগুলোর শ্রী ফেরানোর চেষ্টা করছে, পল্লীবাসীদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য তিনি বস্ত্র ও চর্ম শিল্প প্রচলন করেছিলেন। গ্রামগুলোর অশিক্ষা দূর ও তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ফোটানোর চেষ্টা আজও করে চলেছে শ্রীনিকেতন।  শ্রীনিকেতন এমন একটা প্রতিষ্ঠান যার মূল্য দেশ ও দেশের সরকার উপলব্ধি করছে।

বাইরে রবীন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয় ছিল কবি-সাহিত্যিক হিসেবে কিন্তু শান্তিনিকেতনে তিনি গুরুদেব বলে পরিচিত ছিলেন। শোনা যায় আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় তাঁর প্রথম সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মহাশয়। তিনিই তাঁকে গুরুদেব আখ্যা দেন।  আশ্রমের ছাত্র ও শিক্ষকগণ তাঁকে গুরুদেব ছাড়া ভাবতে পারতেন না, আজও পারেন না।  তিনি মনে করতেন অধ্যাত্ব্য জীবনের উৎকর্ষ সাধনই মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।  তাই তিনি এখানে সকাল সন্ধ্যায় উপাসনার প্রবর্তন করেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি প্রত্যহ উপসনা করতেন। ৭ই পৌষ মহর্ষি ব্রহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন সেই দিনটিকে স্মরণে রাখার অভিলাষে রবীন্দ্রনাথ ৭ই পৌষ তাঁর বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। মহর্ষির জীবনে উপনিষদের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।  রবীন্দ্রনাথের মন্দিরের ভাষণেও উপনিষদের ঋষিবাক্যগুলো বারবার উঠে আসতো। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ধর্মের জয় হয়, অধর্ম সাময়িকভাবে সুখকর হলেও পরিণামে সমূলে বিনাশের কারণ হয়।  তিনি আরো মনে করতেন যিনি শান্তম তিনিই শিবম, তিনি আবার অদ্বৈতম। এই শান্তম শিবম অদ্বৈতম মন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথের অবচেতন ও জাগ্রত মনের কথা।  তাঁর অবচেতন মনে প্রতিনিয়ত মন্ত্রটি কাজ করে চলতো। তাঁর জীবনে যেমন শান্তিনিকেতন তেমন মন্ত্রটির বিশেষ স্থান ছিল। আশ্রমগুরু আশ্রমবাসীদের প্রকৃত কল্যাণের পথ মন্ত্রটির মাধ্যমে নির্দেশ করেছেন।

ছোটগল্প, নাট্যসাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রকলা ও সংগীতের মধ্যে তাঁর সাহিত্য কর্ম ছড়িয়ে আছে। তিনি প্রায় হাজার পঁচিশেক গান লিখে গেছেন। রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিত গানগুলি বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা তিনিই ছিলেন। তাঁর কাব্য বহুবর্ণময়। কখনো রক্ষণশীল ধ্রুপদী শৈলীতে, কখনো হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনো বা দার্শনিকের গাম্ভীর্যে আবার কখনো বা আনন্দের উচ্ছাসে কাব্যগুলি উদ্ভাসিত।

 রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আশ্রমের ছাত্র ও শিক্ষক উভয়েরই গুরুদেব, সমগ্র বাঙালি জাতিরও গুরুদেব। তিনি কেবল কবি-সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রকৃত জীবনশিল্পীও। শান্তিনিকেতন ছিল তাঁর তপস্যাকেন্দ্র। এই তপস্যাকেন্দ্রেই তিনি তাঁর জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছেন। তাঁর অনন্য সাধারণ প্রতিভার সাথে অনলস সাধনা যুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছিল এক মহান জীবন।

রবীন্দ্রনাথ এক অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক ব্যতিক্রমী  ব্যক্তিত্ব।  তাঁর আবির্ভাবের প্রায় ১৬০ বছর পর তিনি আমাদের কাছে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের শোকে-দুঃখে, আনন্দে-উৎসাহে যার অস্তিত্ব আমরা সবসময় অনুভব করে থাকি। আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি কেবল নিজের সাথে নিজেই তুলনীয়।  মহাকাল তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। যুগে যুগে, জন্ম-জন্মান্তরে তাঁর অমরত্ব নিয়েই বাঙালি তথা ভারতবাসীর কাছে তিনি চিরকালীন হয়ে থাকবেন। তিনি  ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর উদ্ভাসিত মহিমা আজও এবং ভবিষ্যতেও আমাদের সঠিক ও পরিপূর্ণ জীবন গঠনে সহায়তা করে চলবে। বাঙালি জীবনে তিনি বরাবরই একটা 'রোল মডেল' হয়ে থাকবেন।






ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ০৩-০৩-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 









No comments: