Sunday, July 18, 2021

আজ স্বর্ণযুগের কিংবদন্তি ছিয়াত্তরে পা রাখলেন >P

আজ স্বর্ণযুগের কিংবদন্তি ছিয়াত্তরে পা রাখলেন 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 



আজ ১৮ই জুলাই। ১৯৪৩ সালের আজকের দিনেই স্বর্ণযুগের কিংবদন্তি শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায় কলকাতার এক সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পরিবারে বরাবরই সংগীতের চর্চা হতো। খুব ছোট্ট বয়সেই তিনি তাঁর মাতৃদেবীর কাছে সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন।  পরবর্তী সময় তিনি সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ মোহাম্মদ সাগিরুদ্দিন খান, পন্ডিত চিন্ময় লাহিড়ী, পন্ডিত লক্ষণ প্রসাদ জয়পুরওয়ালা ও পন্ডিত রমেশ নাদকার্নির কাছে শাস্ত্রীয়  সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন।  

পরবর্তীসময় তিনি "মেট্রো-মর্ফি কনটেস্ট" সংগীত প্রতিযোগিতায় তিনি বিজয়ী হন। অনিল বিশ্বাস নওশাদ, বসন্ত দেশাই ও সি রামচন্দ্রের মতো গুণী সংগীত পরিচালকরা সেই প্রতিযোগিতার বিচারকের আসন অলংকৃত করেছিলেন।  এই কন্টেস্টে বিজয়ী হওয়ার পর আরতি মুখোপাধ্যায়কে  আর পিছনে ফিরে  তাকাতে হয়নি।
  
১৯৫৮ সালে 'সাহারা' নামে একটা  হিন্দি সিনেমাতে প্লেব্যাক করার সুযোগ পান। এটাই তাঁর  সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। কিন্তু এই সিনেমার গানগুলো শ্রোতাদের মন ভরাতে পারেনি। তারপর 'গার্ল ফ্রেন্ড' নামে আর একটা সিনেমায় তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু সেই সিনেমাটি ফ্লপ হয়। তারপর 'কন্যা' নামে  একটি বাংলা সিনেমাতে তিনি গান গাওয়ার সুযোগ পান। এটাই তাঁর বাংলা সিনেমাতে প্রথম  সুযোগ পাওয়া। বাংলা সংগীত জগতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। তাঁর আসামান্য গায়কী ও সুমধুর কন্ঠস্বর সবাইকে মুগ্ধ করে দেয়। 

১৯৬৬ সালে "গল্প হলেও সত্যি" নামে  বাংলা সিনেমাতে গান  গেয়ে তিনি সেরা মহিলা নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে 'বিজেএফ' পুরস্কার পেয়েছিলেন। 'ছুটির ফাঁদে' সিনেমায় গান গেয়ে তিনি পুনরায় 'বিজেএফ' পুরস্কার পান। পরবর্তী সময় তিনি হিন্দি সিনেমা 'গীত গাতা চল' ও বাংলা 'হংসরাজ', 'অমরগীতি'র মতো সংগীত প্রধান সিনেমাতে গান গেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর গাওয়া বহু আধুনিক গান ও ছায়াছবির গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল।  ষাটের দশকের শেষদিক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত তিনি বাংলা সংগীত জগতে মহিলা শিল্পী হিসেবে শীর্ষ স্থান অলংকৃত করেছিলেন। তিনি শুধু বাংলা বা হিন্দি নয় বহু ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন। তিনি রাগাশ্রয়ী, আধুনিক গান, ভজন, গজল ইত্যাদি গান বহুবার কলকাতা ও মুম্বাই রেডিওতে গেয়েছেন। আনুমানিক প্রায় ১৫০০০ গান তিনি গেয়েছেন। 'বন্য বন্য এ অরণ্য', 'এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে', 'লজ্জা মরি মরি একি  লজ্জা', 'মাধবী মধুপে হল মিতালি', 'তখন তোমার একুশ বছর', 'আমি মিস ক্যালকাটা' ইত্যাদি তাঁর খুবই জনপ্রিয় গান। ঋত্বিক ঘটক তাঁর 'যুক্তি তক্কো গল্প' সিনেমাতে আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইয়েছিলেন।  সম্ভবত তিনি সর্বপ্রথম হিন্দিতে রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছিলেন।  তিনি বহুবার বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হলেও তিনি সবসময় মনে করেন শ্রোতারাই তাঁকে অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছেন এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।  বাংলায় যে কজন সংগীত শিল্পী এসেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন খুবই ভার্সেটাইল।  বিভিন্ন রকম গান তিনি অনায়াস ও সাবলীলভাবে গাইতে পারতেন। সব ধরণের সংগীতে তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল।  

আজ আপনার জন্মদিন, আমার তরফ থেকে আপনাকে অফুরন্ত শুভেচ্ছা জানাই।  আপনি সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।  আপনার অগুনতি ভক্তরা আপনাকে সবসময় ঘিরে থাকুক।


তারিখ :১৮-০৭-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Thursday, July 8, 2021

সহেলীর কৌতূহল (পর্ব ৫)

সহেলীর  কৌতূহল 

(পর্ব ৫) 


পূজার শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে সন্ধ্যার সময় আমাদের পূজামণ্ডপে প্রতিবছর নিয়ম করে একটা যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হতো। প্রতিবছর রথের দিন গ্রামের রবীন  কাকা যাত্রার দলকে বায়না করে আসতো। সাধারণত কলকাতার চিৎপুর অঞ্চল থেকে যাত্রাদলকে নিয়ে আসা হতো। সেইসব যাত্রাপালাগুলো বেশিরভাগ ছিল পুরাণের বা ইতিহাসের গল্প অবলম্বন করে তৈরী। পালাগুলো বেশ জমজমাট হয়ে উঠতো। যাত্রা দেখার জন্য আমাদের গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রাম থেকেও বহু দর্শক আসতো। সন্ধ্যার সময় গ্রামটা যেন কানায় কানায় ভরে উঠতো। আমাদের দেবীর বিসর্জনের ব্যাথা  কিছুটা হলেও কমতো।  

সহেলী জানিস, একবার একটা দারুন মজা হয়েছিল। সেবার 'সীতাহরণ' নামে একটা পালা মঞ্চস্থ হচ্ছিলো।  আমি খুব মন দিয়ে পালাটা  দেখছিলাম হঠাৎ আমার খুব বাথরুম পেয়ে গেলো।  বাথরুম করার জন্য প্যান্ডেলের পিছন দিকে গেছি।  ওখানে গিয়ে দেখি সাদা সিল্কের শাড়ি পরে একজন মহিলা বিড়ি টানছে।  সেটা দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম।  আগে কখনো কোনো মহিলাকে এভাবে বিড়ি বা সিগারেটে টানতে দেখিনি, তাই এতটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।  প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না ওই ভদ্রমহিলা আবার কোথা থেকে আসলো, আগে কখনও আমাদের গ্রামে বা আশপাশের কোনো গ্রামে দেখিনি, তাও আবার মহিলা হয়ে বিড়ি টানছে। এইসব ভাবতে ভাবতে  বাথরুম করে আমি আবার পালা দেখার জন্য ফিরে এলাম। তার একটু পরে দেখি ওই ভদ্রমহিলা মঞ্চে সীতার  ভূমিকায় অভিনয় করতে আসলো। তখন আমার বোধোদয় হলো। পরে অবশ্য বড়দের কাছ থেকে জেনেছিলাম ওটা মহিলা নয়, একজন পুরুষ ছিল। পুরুষ মহিলা সেজে অভিনয় করছিলো।  এই ব্যাপারটায় আমি বেশ মজা পেয়েছিলাম।  

উৎসব সব সময় সুখের হয়। আমার স্মৃতিপটে গ্রামের কত কথা ও গ্রামের দুর্গাপুজোর কথা গচ্ছিত রয়েছে। সেইসব স্মৃতি আজও আমি ভুলতে পারি না। অবসর সময়ে বসে বসে সেই সময়কার স্মৃতিগুলোকে রোমন্থন করি।  

দাদু, তুমি যে নবপত্রিকা ও মহাস্নানের কথা বললে আমি ঠিক বুজতে পারলাম না।  যদি তুমি এই দুটো সম্বন্ধে আর একটু বিশদে বলো তাহলে ভালো হয়। 

দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ঠ অঙ্গ হলো নবপত্রিকা। পৌরাণিক কাহিনীর থেকে জানা যায় প্রকৃতিরূপা দেবী মহামায়া নয়টি বিশেষ রূপে অবস্থান করেন নয়টি বৃক্ষে। প্রাচীনকালে উঁচু বৃক্ষতে দেব-দেবীর আবাসস্থল বলে কল্পনা করা হত।  এই সব বৃক্ষে সূর্যের আসন বা আশ্রয়রূপে ভাবা হতো।  নবপত্রিকা হলো দেবী দুর্গার প্রতীক অর্থাৎ গণেশের জননী।  দুর্গাপূজার ইতিহাস বলে বৃক্ষ, যূপ, স্তুপ ও  স্তম্ভের ভিতর দিয়ে প্রতীক পূজার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। নবপত্রিকার অর্থ নয়টি পবিত্র গাছ বা গাছের শাখার একত্রীকরণ। মূলত একটা সপত্র কলাগাছের সাথে আটটি সমূল সপত্র গাছ একত্র করে একজোড়া বেল গাছে শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ির আবরণে বৌয়ের মত ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবী প্রতিমার ডান  দিকে ঠিক গণেশের পাশে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। যেহেতু কলগাছকেই বৌয়ের আকার দেওয়া হয় তাই তাকে লোকে কলাবৌ বলে অভিহিত করে থাকে। সকলের ধারণা এই নয়টি গাছে দেবীর কুলোযোগিনীরা বাস করে যোগিনীদের বলা হয় দেবী দুর্গার লীলাসহচরী, সাঙ্গপাঙ্গ কিংবা দেবী নিজেই। নবপত্রিকার নয়টি গাছ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকস্বরূপ।  এই নয়রুপী দেবীকে একত্রে 'নবপত্রিকাবাসিনী' বলা হয়।  নবপত্রিকা আসলে দেবীর বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ প্রতীক। তাই ইনি নবপত্রিকাবাসিনী দূর্গা।  

  

নবপত্রিকা কৃষিসম্পদের প্রতীক। দেবী এখানে শস্যরূপে পূজিত হন। নবপত্রিকায় প্রত্যেকটি বৃক্ষকে দেবীর এক একটি রূপে কল্পনা করা হয়েছে। নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়। 


কলা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ব্রহ্মাণী 
কচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালিকা। 
হরিদ্রা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন উমা। 
জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কার্তিকী। 
বিল্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন  শিবা। 
দাড়িম্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন রক্তদন্তিকা। 
অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন শোকরোহিতা। 
মানকচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন চামুন্ডা। 
ধান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী। 

দেবীপূজার পূর্বদিন অর্থাৎ ষষ্ঠীতিথিতে প্রথমে বিল্ববৃক্ষে দেবীর আবির্ভাব ও অধিষ্ঠান চিন্তা করে বিল্ববৃক্ষমূলে দেবী দুর্গার পূজা করা হয়।   অর্থাৎ মহাসপ্তমীর দিন সকাল বেলায় নিকটস্থ নদী বা অন্য কোনো জলাশযে নবপত্রিকাকে স্নান করানোর উদ্দেশ্যে পুরোহিত কাঁধে করে নিয়ে আসেন। পুরোহিতের পিছনে পিছনে ঢাকিরা ঢাক বাজাতে বাজাতে, মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিতে দিতে সঙ্গে যান।  স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে মণ্ডপে প্রবেশ করানো হয়।  দেবী তখন বৃক্ষ থেকে প্রতিমায় বা বৃক্ষরূপ থেকে দেবীমূর্তিতে রূপান্তরিত ও প্রতিষ্ঠিত হন পূজার জন্য। তারপর শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী পূজার কাজ শুরু হয়, শুরু হয় দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা। 
 
 নবপত্রিকার আর এক নাম 'নবদুর্গা'।  দেবী দুর্গার পুত্র-কন্যা এবং মহিষাসুরের সাথে নবপত্রিকা  পূজা পান।  নবপত্রিকা কিভাবে দেবী দুর্গার সাথে মিশলো তা নিয়ে অনেক রকম মতামত রয়েছে।  নবপত্রিকা মণ্ডপে প্রবেশের পর দেবীকে দর্পণে মহাস্নান করানো হয়।  এরপর থেকে পূজার বাকি দিনগুলোতে নবপত্রিকা দেবীর সাথে পূজিত হয়ে থাকেন। এই নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে দেবী চামুণ্ডার পূজা  করা হয়।  

(চলবে)


তারিখ :০৮-০৭-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।