সহেলীর কৌতুহল
(পর্ব - ২)
প্রথমে তোকে আমাদের গ্রাম ও আমার ছোটবেলার কথা বলি। তাহলে তুই পল্লীগ্রামের পূজাটা ঠিকমতো অনুভব করতে পারবি।
আমাদের এখানে অর্থাৎ আমেরিকার প্রকৃতি বড়ই রুক্ষ, সেরকম গাছপালা দেখা যায় না। তালগাছের মত সারিবদ্ধভাবে শুধু লম্বা লম্বা বাড়ির সারি। পড়শির হাসি, পড়শির কান্না, পড়শিদের কানে পৌঁছয় না। রাস্তায় কোনো চেনা লোকের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে সে আগে তার ঠোঁটের ফাঁকের মাপ ঠিক করে নেয়। সে কতটা হাসবে বা কতটা কুশল বিনিময় করবে মনে মনে তার একটা হিসেবে কোষে নেয়। হাসি বা কুশল বিনিময় না করতে পারলে যেন তার পক্ষে সব থেকে ভালো হত বলে মনে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের লোকেদের চরিত্র ঠিক তার বিপরীত। কুশল বিনিময় করাটা ভারতবাসীদের চরিত্রের একটা বড় গুন।
আমার ছোটবেলা কেটেছে পল্লীগ্রামে। আমরা খুবই গরিব ছিলাম। আমাদের পরিবার কৃষিজীবি। কৃষিজীবী পরিবারের আয়টা নির্ভর করে ধানের ফলন ও বিক্রির উপর। মহাজনের দয়ার উপর অবশ্য কিছুটা নির্ভর করত। আমাদের জীবন, আনন্দ, উৎসব, সাহিত্য, হাসি-কান্না সবটাই ছিল পল্লীজীবনের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ। ফসল ফলানো মাঠ, অস্ত লাগা দিগন্ত, গঙ্গা ফড়িং-এর লাফালাফি, বর্ষায় গাছের পাতার ঝলমল, শাল, অশ্বত্থ, বটের মত যেমন বড় বড় গাছ ছিল, তেমন নানা রকম লতাপাতা, গুল্ফও ছিল আমাদের গ্রামে। মাটির রাস্তা, সবুজ প্রান্তর, পুকুর-দীঘি, খড়ের চাল, মাটির দালান, গরু-মোষের গোয়াল ঘর, ছাগল চড়ানো, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেতে সোনার ফসল, পুকুরের মাছ, তাজা স্নিগ্ধ নির্মল বাতাস, পাখির ডাক এই ছিল আমাদের সম্বল। আমাদের বাড়িতে একটা ছোট সাদা-কালো টেলিভিশন অবশ্য ছিল। সন্ধ্যার সময় মা-কাকীমারা সেটা দেখতো। ছোটদের দেখার কোনো অনুমতি ছিল না। আমরা গাছের আম-জাম-কলা পেড়ে খেতাম। আমাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিল আমাদের স্কুল। এই রাস্তাটা প্রতিদিন পায়ে হেঁটে যেতে হত। মাঝে মাঝে অবশ্য বাবার সাইকেল নিয়ে যেতাম। আমাদের বিদ্যালয়ে খুব ভালো লেখাপড়া হতো, খুব ভালো রেজাল্ট করতো। নিয়মিত পড়া করে স্কুলে যেতে হত, পড়া না পারলে মাস্টারমশাইদের কানমোলা বা বেতের বারি বাঁধা ছিল। আমাদের গ্রামের থেকে কিছুটা দূরে রথের সময় একটা মেলা বসতো। ওই মেলায় আমরা মোরগের লড়াই দেখতাম, নাগরদোলা চড়তাম, সমগ্র মেলাটা বন্ধুরা একসাথে প্রতিদিন ঘুরে বেড়াতাম। ফুটবল খেলা ছিল আমাদের জীবনের অঙ্গ। এছাড়া এক্কাদোক্কা, পিট্টু, চোর-পুলিশ, লুডো এরকম কত খেলা আমরা খেলতাম। কিন্তু সন্ধ্যের আগে আমাদের বাড়ি ফিরে আসতে হতো। এই ব্যাপারটা আমাদের বাড়িতে খুব কড়াভাবে পালন করা হতো।
নাগরদোলার কথা মায়ের মুখে শুনেছি। কোনোদিন ওখানে গেলে নাগরদোলা চড়ার ইচ্ছে রয়েছে। এক্কাদোক্কা, পিট্টু খেলার কথা কোনোদিন শুনিনি তবে লুডো খেলা, চোর-পুলিশ খেলার কথা শুনেছি। দাদু মোরগের লড়াইটা কি ? ওটা তো জানি না।
মোরগ হল পুরুষ মুরগি। মোরগের লড়াই এক ধরনের খেলা। এতে দুই বা তার বেশি মোরগ অংশ নেয়। এই খেলোয়াড় মোরগকে তার মালিক খুব ভালোভাবে লালন-পালন ও পরিচর্যা করে। লড়াই করার উপযোগী করে তোলার জন্য তাকে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগ প্রতিযোগিতায় একে-ওপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। তাদের মধ্যে চলে তুমুল লড়াই। এটা বহু প্রাচীন খেলা।
আমাদের অবসর সময় কাটানোর জন্য তোদের মত হোয়াটসআপ, ফেসবুক বা ইউটিউব ছিল না। আমরা অবসর সময় খেলাধুলা বা গল্পের বই পড়ে কাটাতাম। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই নিয়ে আসতাম। তুই হয়তো জানিস না আমাদের বাংলা সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধশালী, বাংলা ভাষা কত মিষ্টি ভাষা।
জানি, দাদু জানি। বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে বহু কথা মায়ের মুখে শুনেছি। আমি তো কয়েকটা বাংলা গল্পের বইও পড়েছি। আমার মা বাঙালি হিসেবে যেমন গর্ব বোধ করতো তেমন তাঁর মাতৃভাষা বাংলা বলে খুব অহংকার ছিল। মা বলত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাদের বাংলা অক্ষর চিনিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের মাতৃভাষায় ভাবতে শিখিয়েছিলেন আর কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়েছিলেন। মায়ের মুখে শুনেছি প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে ১৯৫২ সালে এগারো জন তরতাজা বাঙালি যুবক শহীদ হয়েছিলেন। ভাবা যায়, এতগুলো যুবক একটা ভাষার জন্য জীবন আহুতি দিয়েছিলেন।
শুধু দুই বাংলা নয়, এইদিন সারা পৃথিবীতেই বাঙালিরা 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে দিনটা উদযাপন করে থাকে। বাংলা ভাষা নিয়ে লেখা অতুলপ্রসাদের গানটা কি তুই শুনেছিস ?
কোন গানটা ?
তিনি লিখেছিলেন -
"মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা।।"
তাই,পুরো গানটা তুমি জানোনা?
জানতাম। কিন্তু এখন আর মনে নেই।
সারা বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের একমাত্র কবি যার কলমে দুটি দেশের জাতীয় সংগীত বাংলা ভাষায় লিখিত হয়েছে। ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষার তকমা দিয়েছে বলে শুনেছি।
জানো দাদু, কেউ যদি বাংলার সাথে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কথা বলে বা কোনো বাঙালি যখন বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে অন্য বাঙালির সাথে বিদেশী ভাষা অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় কথা বলে সেটা আমার মার খুব অপছন্দ ছিল। মা সব সময় বলতো নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষা শেখা বা চর্চা করা কোনো দোষের নয়। তবে নিজের ভাষায় কথা বলার সময় অন্য ভাষার সংমিশ্রণ না করলেই মাতৃভাষার স্বার্থকতা। বাঙালি হয়েও বাংলায় কথা বলতে লজ্জা পাওয়া, ট্রেনে, বাসে বা আড্ডায় ইংরেজিতে কথা বলা নতুন প্রজন্মের কাছে বর্তমানে যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন্মসূত্রে মাতৃভূমির সঙ্গে গড়ে ওঠে মানুষের নাড়ির টান। স্বদেশের জন্য ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মনেই জন্ম নেয় গভীর প্রীতি ও ভালোবাসা। যে ভালোবাসা অন্তর থেকে উৎসারিত হয়। বড় হয়ে কর্মসূত্রে বা অন্য কোনো কারণে কেউ অন্য কোনো স্থানে বসবাস করলেও মাতৃভূমির মায়া সে কখনো ভুলতে পারে না। জন্মভূমির প্রতি বা শৈশবের লীলাভূমির প্রতি মানুষের সীমাহীন আকর্ষণ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা আজীবন থেকে যায়।
যেহেতু আমার জন্ম এই দেশে তাই আমি বাংলার প্রতি হয়তো তোমাদের মত অতটা টান অনুভব করি না। কিন্তু বাংলা ভাষায় কিছু পড়তে বা বাংলা গান শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
মা আরো বলতো, বাংলায় কথা বললেই কেউ বাঙালি হয় না। বাঙালি হয় চরিত্রে, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে। বাঙালির পৃথক একটা জাতিসত্তা আছে। বাঙালি হল জাতীয় সংগ্রামের চেতনাবাহী একটি জাতি। যার আদর্শগত পুঁজি ও আবেগভাসী প্রেরণার উৎস হল রাজা রামমোহন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি মনীষীরা।
(চলবে)
তারিখ :২৮-০২-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।