Sunday, February 28, 2021

সহেলীর কৌতুহল (পর্ব - ২)

সহেলীর কৌতুহল

 
(পর্ব - ২)



প্রথমে তোকে আমাদের গ্রাম ও আমার ছোটবেলার কথা বলি। তাহলে তুই পল্লীগ্রামের পূজাটা  ঠিকমতো অনুভব করতে পারবি।  

আমাদের এখানে অর্থাৎ আমেরিকার প্রকৃতি বড়ই রুক্ষ, সেরকম গাছপালা  দেখা যায় না।  তালগাছের মত  সারিবদ্ধভাবে শুধু লম্বা লম্বা বাড়ির সারি।  পড়শির হাসি, পড়শির  কান্না, পড়শিদের কানে পৌঁছয় না।  রাস্তায় কোনো চেনা লোকের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে সে আগে তার ঠোঁটের ফাঁকের মাপ ঠিক করে নেয়। সে কতটা হাসবে বা কতটা কুশল বিনিময় করবে মনে মনে তার একটা হিসেবে কোষে নেয়। হাসি বা কুশল বিনিময় না করতে পারলে যেন তার পক্ষে সব থেকে ভালো হত  বলে মনে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের লোকেদের চরিত্র  ঠিক তার বিপরীত। কুশল বিনিময় করাটা ভারতবাসীদের চরিত্রের একটা বড় গুন। 

আমার ছোটবেলা কেটেছে পল্লীগ্রামে। আমরা খুবই গরিব ছিলাম। আমাদের পরিবার কৃষিজীবি। কৃষিজীবী পরিবারের আয়টা  নির্ভর করে ধানের ফলন  ও বিক্রির উপর। মহাজনের দয়ার উপর অবশ্য কিছুটা নির্ভর করত। আমাদের জীবন, আনন্দ, উৎসব, সাহিত্য, হাসি-কান্না সবটাই ছিল পল্লীজীবনের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ। ফসল ফলানো মাঠ, অস্ত লাগা দিগন্ত, গঙ্গা ফড়িং-এর লাফালাফি, বর্ষায় গাছের পাতার ঝলমল, শাল, অশ্বত্থ, বটের মত যেমন বড় বড় গাছ ছিল, তেমন নানা রকম লতাপাতা, গুল্ফও ছিল আমাদের গ্রামে।  মাটির রাস্তা, সবুজ প্রান্তর, পুকুর-দীঘি, খড়ের চাল, মাটির দালান, গরু-মোষের গোয়াল ঘর, ছাগল চড়ানো, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেতে  সোনার ফসল, পুকুরের মাছ, তাজা স্নিগ্ধ নির্মল বাতাস, পাখির ডাক এই ছিল আমাদের সম্বল। আমাদের বাড়িতে একটা ছোট সাদা-কালো টেলিভিশন অবশ্য ছিল। সন্ধ্যার সময় মা-কাকীমারা সেটা দেখতো। ছোটদের দেখার কোনো অনুমতি ছিল না। আমরা গাছের আম-জাম-কলা পেড়ে খেতাম। আমাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিল আমাদের স্কুল।  এই রাস্তাটা প্রতিদিন পায়ে হেঁটে যেতে হত।  মাঝে মাঝে অবশ্য বাবার সাইকেল নিয়ে যেতাম।  আমাদের বিদ্যালয়ে  খুব ভালো লেখাপড়া হতো, খুব ভালো রেজাল্ট করতো। নিয়মিত পড়া করে স্কুলে যেতে হত, পড়া না পারলে মাস্টারমশাইদের কানমোলা বা বেতের বারি বাঁধা ছিল।  আমাদের গ্রামের থেকে কিছুটা দূরে রথের সময় একটা মেলা বসতো। ওই মেলায় আমরা মোরগের লড়াই দেখতাম, নাগরদোলা চড়তাম, সমগ্র মেলাটা বন্ধুরা একসাথে প্রতিদিন ঘুরে বেড়াতাম। ফুটবল খেলা ছিল আমাদের জীবনের অঙ্গ। এছাড়া এক্কাদোক্কা, পিট্টু, চোর-পুলিশ, লুডো এরকম কত খেলা আমরা খেলতাম। কিন্তু সন্ধ্যের আগে আমাদের বাড়ি ফিরে আসতে হতো। এই ব্যাপারটা আমাদের বাড়িতে খুব কড়াভাবে পালন করা হতো। 

 নাগরদোলার কথা মায়ের মুখে শুনেছি। কোনোদিন ওখানে গেলে নাগরদোলা চড়ার ইচ্ছে রয়েছে।  এক্কাদোক্কা, পিট্টু খেলার কথা কোনোদিন শুনিনি তবে লুডো খেলা, চোর-পুলিশ খেলার কথা শুনেছি। দাদু মোরগের লড়াইটা  কি ? ওটা তো জানি না।  

 মোরগ হল পুরুষ মুরগি। মোরগের লড়াই এক ধরনের খেলা। এতে দুই বা তার বেশি মোরগ অংশ নেয়। এই খেলোয়াড় মোরগকে তার মালিক খুব ভালোভাবে লালন-পালন ও পরিচর্যা করে। লড়াই করার উপযোগী করে তোলার জন্য তাকে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগ প্রতিযোগিতায় একে-ওপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। তাদের মধ্যে চলে তুমুল লড়াই। এটা বহু প্রাচীন খেলা।   

আমাদের অবসর সময় কাটানোর জন্য তোদের মত  হোয়াটসআপ, ফেসবুক বা ইউটিউব ছিল না।  আমরা অবসর সময় খেলাধুলা বা  গল্পের বই পড়ে  কাটাতাম। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই নিয়ে আসতাম। তুই হয়তো জানিস না আমাদের বাংলা সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধশালী, বাংলা ভাষা কত মিষ্টি ভাষা।

জানি, দাদু জানি। বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে বহু কথা মায়ের মুখে শুনেছি। আমি তো কয়েকটা বাংলা গল্পের বইও পড়েছি। আমার মা বাঙালি হিসেবে যেমন গর্ব বোধ করতো তেমন  তাঁর মাতৃভাষা বাংলা বলে  খুব অহংকার ছিল। মা বলত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাদের বাংলা অক্ষর চিনিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের মাতৃভাষায় ভাবতে শিখিয়েছিলেন আর কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়েছিলেন। মায়ের মুখে শুনেছি প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।  বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে ১৯৫২ সালে এগারো জন তরতাজা বাঙালি যুবক শহীদ হয়েছিলেন। ভাবা যায়, এতগুলো যুবক একটা ভাষার জন্য জীবন আহুতি দিয়েছিলেন। 

শুধু দুই বাংলা নয়, এইদিন সারা পৃথিবীতেই বাঙালিরা 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে দিনটা উদযাপন করে থাকে।  বাংলা ভাষা নিয়ে লেখা অতুলপ্রসাদের গানটা কি তুই শুনেছিস ?

কোন গানটা ?

তিনি লিখেছিলেন -
"মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।  
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা।।" 

তাই,পুরো গানটা তুমি জানোনা?

জানতাম। কিন্তু এখন আর মনে নেই।


সারা বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের একমাত্র কবি যার কলমে দুটি দেশের জাতীয় সংগীত বাংলা ভাষায় লিখিত হয়েছে।  ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষার তকমা দিয়েছে বলে শুনেছি।  

জানো দাদু, কেউ যদি বাংলার সাথে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কথা বলে বা কোনো বাঙালি যখন বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে অন্য বাঙালির সাথে  বিদেশী ভাষা অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় কথা বলে সেটা আমার মার খুব অপছন্দ ছিল।  মা সব সময়  বলতো নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষা শেখা বা চর্চা করা কোনো দোষের নয়। তবে নিজের ভাষায় কথা বলার সময় অন্য ভাষার সংমিশ্রণ না করলেই মাতৃভাষার স্বার্থকতা। বাঙালি হয়েও বাংলায় কথা বলতে লজ্জা পাওয়া, ট্রেনে, বাসে বা আড্ডায় ইংরেজিতে কথা বলা নতুন প্রজন্মের কাছে বর্তমানে যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।  জন্মসূত্রে মাতৃভূমির সঙ্গে গড়ে ওঠে মানুষের নাড়ির টান।  স্বদেশের জন্য ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মনেই জন্ম নেয় গভীর প্রীতি ও ভালোবাসা। যে ভালোবাসা অন্তর থেকে উৎসারিত হয়।  বড় হয়ে কর্মসূত্রে বা অন্য কোনো কারণে কেউ অন্য কোনো স্থানে বসবাস করলেও মাতৃভূমির মায়া সে কখনো ভুলতে পারে না।  জন্মভূমির প্রতি বা শৈশবের লীলাভূমির প্রতি মানুষের সীমাহীন আকর্ষণ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা আজীবন থেকে যায়। 

যেহেতু আমার জন্ম এই দেশে তাই  আমি বাংলার প্রতি হয়তো তোমাদের মত অতটা  টান অনুভব করি না। কিন্তু বাংলা ভাষায়  কিছু পড়তে বা বাংলা গান শুনতে আমার ভীষণ  ভালো লাগে।  

মা আরো বলতো, বাংলায় কথা বললেই কেউ বাঙালি হয় না। বাঙালি হয় চরিত্রে, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে। বাঙালির পৃথক একটা জাতিসত্তা আছে। বাঙালি হল জাতীয় সংগ্রামের চেতনাবাহী একটি জাতি।  যার আদর্শগত পুঁজি ও আবেগভাসী প্রেরণার উৎস হল রাজা রামমোহন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর  প্রভৃতি মনীষীরা।  


(চলবে)




তারিখ :২৮-০২-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 





















Sunday, February 21, 2021

সহেলীর কৌতুহল (পর্ব - ১)

সহেলীর কৌতুহল 

(পর্ব - ১)


সহেলী   দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন তার বন্ধু ঋতুপর্ণার বাড়িতে এলো। ফর্সা রোগাটে চেহারায়  আজ সে হালকা রঙের একটা সুন্দর শাড়ি পড়েছে। তার সাথে রঙের সামঞ্জ্যস্য বজায় রেখে একটা ব্লাউজ পড়েছে।  চুলটা বেশ পরিপাটি করে বাঁধা রয়েছে।  সাধারণত অন্যদিন সে জিন্সের প্যান্ট ও টপ পরে আসে। কিন্তু আজ  একেবারে বাঙালি সাজে সজ্জিত হয়ে এসেছে। দেখতে তাকে  খুবই সুন্দর লাগছে। এতো সেজেগুজে আসলেও  মনটা তার একদমই ভালো নেই, খুব উতলা হয়ে আছে।   নানা প্রশ্ন তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।  সত্যি কথা বলতে, আজ সে তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে আসেনি, সে এসেছে ঋতুর দাদু শ্যামল বাবুর সাথে গল্প করতে।  গল্পের মাধ্যমেই সে তার সব প্রশ্নগুলোর উত্তর  জেনে নেবে।  তার মনের ক্ষিদে মেটাবে।  দাদুর কাছ থেকে  সব প্রশ্নের উত্তর তাকে জানতে হবে।  সবকিছু জানতে পারলেই যেন তার মনের জ্বালা  মিটবে।  

শ্যামলবাবু অর্থাৎ শ্রী শ্যামল কুমার ঘোষ।  শ্যামলবাবু আদপে  পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার মানুষ।  বর্তমানে আমেরিকাবাসী। তাঁর ছোটবেলা, লেখা-পড়া সবই কেটেছে বর্ধমান জেলা ও কলকাতাতে। তাঁদের বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে নবধেনু গ্রামে। জন্ম কৃষিজীবী পরিবারে।  তিনি গ্রামের স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন।  কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।  তারপর গবেষণার কাজে আমেরিকায় চলে আসেন। সেই থেকে তিনি এখানে রয়ে গেছেন। দেখতে দেখতে তা আজ প্রায় বছর ৪০ পার হয়ে গেলো। ১৯৮০ সালে তিনি আমেরিকাতে আসেন। এখন  অবসর জীবন যাপন  করেছেন । 

সহেলী শ্যামলবাবুর কাছ থেকেই তাঁদের গ্রামের দুর্গাপুজো সম্বন্ধে জানতে চান, জানতে চান কলকাতার দুর্গাপুজো সম্বন্ধেও। সেই কারণেই আজ তার ঋতুপর্ণাদের বাড়িতে আসা। যেহেতু সে ঋতুকে না জানিয়ে এসেছে, তাই ভেবেছিল ঋতু হয়তো বাড়িতে নাও থাকতে পারে। কিন্তু  সে এসে ঋতুকে বাড়িতে পেয়ে গেলো। সামান্য কথা ঋতুর সাথে বলেই সে ছুট লাগালো দাদুর কাছে।  দাদুকে আগেই বলে রেখেছিল। দাদুও তার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঋতুকে সময় না দেওয়ায় অর্থাৎ এইভাবে ঋতুকে অবজ্ঞা করায়, ঋতু কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হলো।  সহেলী  ঘরে ঢুকেই প্রথমে দাদুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। দাদু বেশ অবাক হয়ে গেলো। 

তুই তো কোনোদিন প্রণাম করিস না, আজ হঠাৎ প্রণাম করলি?  

 দাদু একদিন পরেই আমাদের দেশে দুর্গাপুজো শেষ হয়ে যাবে। আসবে বিজয়া দশমী।  তাই তোমায় আগাম প্রণাম করে রাখলাম।  আজ তোমার কাছ থেকে দুর্গাপুজোর গল্প শুনবো বলেই তো আমার এখানে আসা।

 সহেলীর কথাগুলো শুনে শ্যামলবাবু বেশ অবাক হয়ে গেলেন।  ভাবতে লাগলেন দুর্গাপুজোর কথা ও  কি করে জানলো।  তিনি বললেন তুই তো কোনোদিন পশ্চিমবঙ্গে যাসনি। ভারতেও কোনোদিন যাসনি দুর্গাপুজোর কথা তুই কিভাবে জানলি ? 

দাদু, পৃথিবীটা তো এখন হাতের মুঠোয়। তুমি যা জানতে চাইবে আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় তাই অনায়াসে জানতে পারবে। 

সেটা  তো বুঝলাম কিন্তু তোর দুর্গাপুজো নিয়ে এতো আগ্রহ জন্মালো কি করে ? সেটা তো বল।  

আসলে আমি সেদিন  একটা বাংলা সিনেমা দেখছিলাম।  সিনেমাটার নামটা  ছিল "উমা"। সিনেমাটার প্রধান চরিত্রে ছিল একটা বাচ্চা বাঙালি মেয়ে, যে সুইজারল্যান্ডে বসবাস করতো।  মাতৃহারা  বাচ্চা মেয়েটি মরণ রোগে আক্রান্ত। ডাক্তার মোটামুটি জবাব দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির মনোবাঞ্ছা  ছিল সে কলকাতায় গিয়ে সেখানকার দুর্গাপুজো অর্থাৎ বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসবটি নিজের চোখে দেখবে। মেয়েটির বাবা তার স্বপ্নপুরণের জন্য কলকাতায় অকালে একটা নকল দুর্গাপুজোর আয়োজন করলো। ছবিটা ছিল ভীষণ ইমোশনাল মুভি। ছবিটার শেষটা দেখে আমি আর থাকতে পারিনি, চোখে জল এসে গিয়েছিলো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ছবিটাতে পাঁচদিন ধরে চলা একটা দুৰ্গোৎসবকে দেখানো হয়েছিল। ওখানে যেমন বহুরকম নিয়ম-নিষ্ঠা দেখানো হয়েছিল তেমন  মানুষদের উচ্ছাস ও উদ্দীপনাও  দেখানো হয়েছিল।  সেই পুজোয় উমা খুব আনন্দ করে, সে খুবই উপভোগ করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না।  অচিরেই তাকে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে হয়। এই সিনেমাটা আমায় ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়।  আমি ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে  দুর্গাপুজোর  গল্প বহুবার শুনেছি।  মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন নানারকম গল্পের মধ্যে কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলের কথা, দুর্গাপুজোর কথা মাঝে মাঝেই উঠে আসতো।  বিশেষ করে মায়ের মামাবাড়ি টাকির জমিদারদের দুর্গাপুজো ও ভাসানের কথা বলতো।  দেবী দূর্গা ও মা কালী ছিল মায়ের পরম ভক্তির জায়গা। 

দুর্গাপুজো বাঙালিদের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব অথচ আমি বাঙালি হয়ে কোনোদিন এই উৎসবে সামিল হতে পারিনি।  শুধু তাই নয়, কোনোদিন দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।  সিনেমাতে বাচ্চা মেয়েটির দুর্গাপুজো নিয়ে যে আবেগ, যে উচ্ছাস দেখলাম, তা আমায় কলকাতার দুর্গাপুজো দেখার ইচ্ছে আরো বাড়িয়ে দিলো।  দেবী দূর্গা ও তাঁকে কেন্দ্র করে যে  উৎসব তা জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল। খুব ইচ্ছে করে, একবার ওখানে গিয়ে নিজেদের দেশটাকে দেখে আসতে।যে দেশে জন্ম নিয়েছে বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, নেতাজির মতো মহান ব্যক্তিত্বরা সে দেশ দেখার জন্য আমার মনটা ব্যাকুল  হয়ে আছে।  

আমি তাই তোমার কাছে কলকাতার দুর্গাপূজা ও তোমাদের পল্লীগ্রামের দুর্গাপুজোর কথা যেমন জানতে চাই তেমন দূর্গাপুজো নিয়ে আমাদের শাস্ত্রে যা বলা আছে সেগুলোও জানতে সমান আগ্রহী। তুমি আমায় সবটা জানাবে। কোনো রকম ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবে না। 

আমি সবকিছু তো জানি না, তবে আমার যতটুকু জানা রয়েছে তোকে নিশ্চয়ই তা জানাবো।  ফাঁকি দেওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে আরো অনেক কিছু আছে যা আমার জানা নেই।   আমি তো বহু বছর ওখানকার পুজোতে যাইনি তাই  বর্তমানে  ওখানকার পুজোর পরিবেশ তোকে হয়তো  ঠিক ভাবে বলতে পারবো না।  


(চলবে )


তারিখ :২১-০২-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Wednesday, February 3, 2021

বড়বাজারের পুঁটে কালী >P

বড়বাজারের পুঁটে কালী 





কলকাতার সঙ্গে দেবী কালিমাতার সম্পর্ক বহুদিন এবং তা খুবই ঘনিষ্ঠ। সবাই বলে থাকে,  দক্ষিণ কলকাতার শক্তিপীঠ কালীঘাট থেকেই শহরের গৌরবের শুরু।কালীঘাটের এই মন্দিরটি ছাড়া শহরের বহু জায়গায় বহু কালী মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেই সব মন্দিরে কোথাও  ডাকাত কালী, কোথাও  আদ্যা  কালী, কোথাও শ্মশান কালী আবার কোথাও  সিদ্ধেশ্বরী কালীর প্রতিমা বিরাজমান। রঘু ডাকাত, মনোহর ডাকাত ও চিতু ডাকাতের কালীপূজার গল্প সবার কাছে খুবই পরিচিত। কালীঘাটের মন্দির ছাড়াও  নিমতলার  আনন্দময়ী, বৌবাজারের ফিরিঙ্গি কালী,   বড়বাজারের পুঁটে কালী, বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী, টালিগঞ্জের করুণাময়ী এরকম বেশ  কয়েকটি  বিখ্যাত  কালী প্রতিমার স্থায়ী মন্দির আমাদের শহরে  রয়েছে। আমরা জানি যে ডাকাত ও তান্ত্রিকদের হাত থেকে দেবী কালীকে সর্বজনীন করে তুলেছিলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।  যদিও তাঁর আরাধনার স্থল কলকাতায় ছিল না, তা ছিল  দক্ষিণেশ্বরে। 

শহরের বড়বাজার অঞ্চলটি ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য।  এই অঞ্চলের পোস্তার  কাছে ২০ নম্বর কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটে রাস্তার উপরে একটি ছোট কালী মন্দির রয়েছে।  মন্দিরটি খুবই প্রাচীন। মন্দিরটি হল পুঁটে কালী মন্দির।  মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবী মূর্তিটির উচ্চতা মাত্র ছয় ইঞ্চি। পুঁটে কালী মূর্তিটি খুবই  ছোট, তাই সকলে এটিকে পুঁটে কালী বলে ডাকে। কিন্তু ভিন্ন আর একটা  ইতিহাস প্রসিদ্ধ কাহিনী রয়েছে।  খেলারাম বন্দ্যোপাধ্যায় নামক একজন তন্ত্রসাধক ছিলেন। কোনো এক সময় মন্দির লাগোয়া একটা খাল ছিল।  খালটি দিয়ে গঙ্গার ধারা বয়ে যেত।  তন্ত্রসাধক খেলারাম একদিন মন্দিরের সামনে বসে হোমযজ্ঞ করছিলেন।  সেই সময় খালটি থেকে একটা পুঁটি মাছ হঠাৎ লাফিয়ে এসে হোমাগ্নিতে পড়ে।  সাধক হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় প্রথমে  চমকে ওঠেন।  তিনি পরে পোড়া মাছটিকে হোমের  আগুন থেকে তুলে খালের জলে ফেলে দেন।  দেবীর কৃপায় অলৌকিকভাবে মাছটি তার প্রাণ ফিরে পায়। সেই  থেকে এই দেবী মূর্তি পুঁটি কালী বলে পরিচিতি পায়।  পরবর্তী সময় লোকমুখে প্রচার হতে হতে পুঁটি হয়ে যায় পুঁটে।  

হুগলীর ভরশুট গ্রামের বাসিন্দা মানিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এক তন্ত্রসাধক।  তাঁকে সবাই 'রাজামানিক' নামে ডাকতো। ৯৬৪ সাল।  তখন সম্রাট আকবরের শাসন। এই সময় পঞ্চমুন্ডীর আসন পেতে তন্ত্রসাধক মানিকচন্দ্র একটি কালী মন্দির নির্মাণ করেন।  মন্দিরটি লম্বাকৃত ও তিনচালা বিশিষ্ট ছিল।  মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী শিলাময়ী বিগ্রহ ছিল।  এই মানিকচন্দ্রের উত্তর পুরুষ ছিলেন খেলারাম।  


বর্তমান মন্দিরের তিনটি চুড়াবিশিষ্ট। চক্র, ত্রিশূল ও পতাকা গাঁথা রয়েছে চূড়াগুলিতে। মন্দিরটির ভিতরে বর্তমানে কষ্টিপাথরের বিগ্রহ রয়েছে। এই বিগ্রহটি পরবর্তী সময় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পূর্বের বিগ্রহটিকে বর্তমানে আর দেখা যায় না।  বর্তমান মন্দিরটি ১৯৫৮ সালে স্থাপিত হয়েছিল। অতীতকাল থেকেই নিত্যপূজা হয়ে আসছে। দেবীকে এখানে তন্ত্রমতে পূজা করা হয়। কালীপূজার দিন বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করা হয়।  কালীপূজার রাতে দেবীকে স্বর্ণবেশে ভৈরবীরূপে পূজা করা হয়ে থাকে। কালী পূজার  পরের দিন কুমারীপূজা ও অন্নকূট উৎসব পালন করা হয়।  আমিষ ও নিরামিষ দুরকমের ভোগ মাকে নৈবেদ্য হিসেবে  নিবেদন করা হয়। নিরামিষ ভোগের  মধ্যে খিচুড়ি, পোলাও, লুচি, দুরকমের সবজি, চাটনি ও পায়েস থাকে।  আমিষ ভোগের  মধ্যে নিরামিষ পদগুলোর সাথে পুঁটি, রুই, বোয়াল, ভেটকি ও ইলিশ এই পাঁচ রকমের মাছ থাকে। বিশেষ উপাচার হিসেবে খাস্তা কচুরি আর চানাচুর থাকে। খেলারামের পরিবারই এখনও এখানকার সেবাকার্যে যুক্ত রয়েছে। কালী মূর্তির পাশে একটি শ্বেতপাথরের শীতলা  মূর্তিও রয়েছে।  এখানকার দেবী মূর্তি খুবই জাগ্রত হিসেবে পরিচিত। 










তারিখ :০৩-০২-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।