সোনামুখীর বিট পরিবারের দুর্গাপূজা
- সুদীপ্ত মুখার্জী
বাঁকুড়া হল পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা। প্রাচীন যুগে বাঁকুড়া জেলা ছিল রাঢ় অঞ্চলের অধীনস্ত। বাঁকুড়া জেলা ও এর আশপাশের অঞ্চলগুলো এককালে মল্লরাজত্বের কেন্দ্রভূমি ছিল। খিষ্ট্রীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনাকাল পর্যন্ত যাঁরা এখানে রাজত্ব করে গেছেন তাঁরা "মল্লরাজ" নামে খ্যাত ছিল।
এই বাঁকুড়া জেলারই একটি ছোট্ট গ্রাম হলো সোনামুখী গ্রাম। গ্রাম্য দেবী স্বর্ণময়ী দেবীর নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ হয় সোনামুখী। এই গ্রামে প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে বীট পরিবার। তাঁদের এই পারিবারিক পূজাটিও প্রায় দ্বিশতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ১২৩৩ বঙ্গাব্দে বীট পরিবারের সন্তান স্বর্গীয় শত্রুঘ্ন বীট মহাশয় স্বইচ্ছায় তাঁদের পরিবারে দুর্গাপূজা শুরু করেন। গতবছর এই পারিবারিক পূজাটি ১৯৫ বছরে পদার্পন করেছে। বীট পরিবারের বসতবাড়ির অনতিদূরে দে পরিবারের বাসভূমির নিকট রয়েছে একটি সুপ্রাচীন দুর্গামন্দির। বীট ও দে এই দুই পরিবার আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। স্বর্গীয় শত্রুঘ্ন বীট মহাশয়ের প্রপৌত্রগণের পরিবারের মিলিত উদ্যোগে আজও পূজাটি বেশ আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
প্রতিমা এই দূর্গা মন্দিরেই নির্মাণ করা হয়। একচালা সাবেকি প্রতিমায় পূজা করা হয়। মা দূর্গা ও লক্ষ্মী অতসী বর্ণের হয়। পরিবারের দেবত্ব করা জমিতে ধান চাষ করা হয়। সেই ধানের খড় ও মাটি দিয়ে দেবী মূর্তি নির্মাণ করা হয়। এখানে কোনোপ্রকার বাইরের খড় ও মাটি দেবী মূর্তি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়না।
রথযাত্রার দিন কাঠামো পূজা করা হয়। বোধন শুরু হয় পূজার দিন ১৫ পূর্বে আদ্রানক্ষত্র সংযুক্ত অশ্বিন মাসের কৃষ্ণানবমী তিথিতে। মূল পূজা শুরু হয় ষষ্ঠীর দিন থেকে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পরিবারের কেউ তাদের পায়ে কোনোপ্রকার জুতো ব্যবহার করেন না। এই কটাদিন পরিবারের যে যেখানেই থাকুক তারা খালি পায়ে থাকে। এটাই পরিবারের রীতি। এই রীতিটি প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে।
সপ্তমীর দিন নিকটবর্তী দশের পুকুরে নবপত্রিকা স্নান করানো হয়। স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে সেগুন কাঠের পালকিতে চড়িয়ে মূল মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। এই দিন গৃহলক্ষ্মীকে শোভাযাত্রা সহকারে বাড়ির মহিলারা বাসগৃহ থেকে দূর্গা মন্দিরে নিয়ে আসেন। পূজার কটাদিন গৃহদেবী মন্দিরে অবস্থান করেন। দশমীর দিন নবপত্রিকাকে বিসর্জন দেওয়ার পূর্বে গৃহদেবী লক্ষ্মীকে পুনরায় বাসগৃহে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।
অষ্টমীর দিন সকালবেলা পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এই দিন বাড়ির এয়োস্ত্রীরা পূজারী ব্রাহ্মণের স্ত্রীকে আলতা পরিয়ে বস্ত্রদান করেন এবং তাঁকে জল-মিষ্টি খাওয়ানো হয়। তারপর পরিবারের সবাই ওনার আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। পূজার কটাদিন পরিবারের সবাই সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর দিন চালকুমড়া বলি দেওয়া হয়।
একসময় বিষ্ণুপুরের দলমাদল কামানের আওয়াজ শোনার পর এখানে সন্ধিপূজা শুরু হতো, যদিও সে প্রথা আজ বিলুপ্ত। তবে আজও অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে 'খ্যান' উৎসব এখানে অনুষ্ঠিত হয়। বলি দেওয়ার পর দুভাগ করা চালকুমড়োটি, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে বেশ কয়েকজন মিলে সোনামুখী থানায় দৌঁড়ে নিয়ে যায়। এই প্রথা কম বেশি অঞ্চলের সকল পূজা কমিটিই অনুসরণ করে। থানা থেকে তাদের তরবারিটিকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর ওই তরবারি নিয়ে তারা পুনরায় দূর্গা মন্দিরে ফিরে আসে। তারা ফিরে আসার পর মন্দিরে দেবীর আরতি শুরু হয়।
নবমীর দিন হোমযজ্ঞ করা হয়। এই দিন সোনামুখী গ্রামের গ্রাম্য দেবী স্বর্ণময়ী মাতার মন্দিরে বিশেষ পূজার উদ্দেশ্যে সবাই উপস্থিত হয়। শুধু এই বাড়ি নয় সোনামুখী গ্রামের প্রত্যেকটা পূজা মণ্ডপ থেকে এই দিন স্বর্ণময়ী দেবীর মন্দিরে বিশেষ পূজার উদ্দেশ্যে আসে।
দশমীর দিন সকালে নবপত্রিকা গ্রামের দশের পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। পূজার দিনগুলোতে পরিবারের সবাই নিরামিষ আহার গ্রহণ করলেও দশমীর দিন মাছ, শাক ও পায়েস খাওয়ার পর দেবীকে প্রথমে বরণ করা হয় তারপর সিঁদুর খেলা হয়। অপরাজিত পূজা করার নিয়ম রয়েছে। বাড়ির সকল সদস্য এই দিন অপরাজিতার মালা বাহুতে ধারণ করেন। সন্ধ্যাবেলা দেবী মৃন্ময়ীকে গ্রামের দশের পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।
পূজার কটাদিন দেবীকে বিভিন্ন ফল, মিষ্টি ও বিভিন্ন প্রকার নাড়ু, খাজা, গজা ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর দিন লুচি ভোগ নিবেদন করা হয়। এখানে দেবীকে কোনো প্রকার অন্নভোগ দেওয়ার নিয়ম নেই।
কর্মসূত্রে বা বৈবাহিক সূত্রে দূর দূরান্তে থাকা পরিবারের সদস্যরা এবং আত্মীয়-স্বজনেরা এইসময় সকলেই পূজা প্রাঙ্গনে এসে মিলিত হয়। পূজার কটাদিন পূজা প্রাঙ্গনটি হয়ে ওঠে পারিবারিক মিলন উৎসব। এ যেন সারা বছরের অপেক্ষার অবসানের মহামিলন উৎসব।
ছবি সৌজন্যে : সৌভিক বীট ও নিলয়া দে
তারিখ : ০১-১০-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment