Wednesday, October 21, 2020

দুর্গাপুজোকে উৎসবে পরিণত করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ>P

দুর্গাপুজোকে উৎসবে পরিণত করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 

কলকাতায় বাঙালির দুর্গোপূজো খুব বেশিদিনের নয়।  ১৬১০ সালে বেহালায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের হাত ধরে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আটচালায় শুরু হয়েছিল।  তার দেড়শো বছর পরে উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে বেশ ঘটা করে পুজো করা হয়েছিল।  মাঝে অবশ্য অস্টাদশ শতকের প্রথমভাগে ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের কুমারটুলির বাড়িতে পুজোর প্রচলন হয়েছিল।  পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়কে দুর্গাপুজোর মাধ্যমে উৎসবে পরিণত করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব।  ধীরে ধীরে তা সর্বজনীন উৎসবের রূপ নিয়েছে।  শহরের অলিতে গলিতে দুর্গোৎসবটি ছড়িয়ে পড়েছে। 

নবকৃষ্ণের পিতা রামচরণ দেব বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর অধীনে তার সেরেস্তায় কাজ করতেন বলে শোনা যায়।  নবাব তাঁকে  হিজলি, তমলুক, মহিষাদল, ইত্যাদি স্থানের কলেক্টর পদে নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তিনি কটকের দেওয়ান হয়েছিলেন।  মেদিনীপুরের জঙ্গলে মারাঠা দস্যুদের হাতে তিনি নিহত হয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যা রেখে গেছেন।  রামচরণের বিধবা পত্নী পুত্র-কন্যা নিয়ে খুবই কষ্ট করে গোবিন্দপুরে জীবনযাপন করতেন।  পরবর্তী কালে প্রথমে তিনি আড়িপুলিতে ও তারপরে শোভাবাজারে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।  নবকৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন।  মায়ের চেষ্টায় ও অনুপ্রেরণায় প্রথমদিকে আরবি ও ফরাসি ভাষা শেখেন এবং পরবর্তীকালে নবকৃষ্ণ ইংরেজি ভাষাটিকেও বেশ রপ্ত করে নেন।  সেই আমলে ধনকুবের নকু ধরের  কাছে তিনি চাকরি নেন।  নকু ধরের  আনুকূল্যে তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের ফরাসি শিক্ষক নিযুক্ত হন।  তখন অবশ্য হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য কর্মচারী ছিলেন।  বুদ্ধিমান নবকৃষ্ণ হেস্টিংস ও লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।  ধীরে ধীরে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেশ বিশস্ত কর্মী হয়ে ওঠেন।  কোম্পানি তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মুন্সী পদে উত্তীর্ণ  করেন।  পলাশীর যুদ্ধের পর নবকৃষ্ণের ভাগ্যের  চাকা ঘুরে যায়।  তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হর্তাকর্তা ছিলেন লর্ড ক্লাইভ।  তিনি তার বন্ধু নবকৃষ্ণের  জন্য দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে "রাজাবাহাদুর" খেতাব নিয়ে আসেন। 

ক্রমে ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রপ হিসেবে কলকাতাকে গড়ে তোলে।  তারা বাংলার বহু জায়গায় বাণিজ্যকুঠি তৈরী করে।  সেই সময় কেউ কেউ ইংরেজদের বদান্যতায় হঠাৎ ধোনি হয়ে ওঠে।  এই নব্য ধোনিরা শহরে চালু করেছিলেন বাবু সংস্কৃতি। বাবু সংস্কৃতির প্রধান পথ প্রদর্শক ছিলেন অবশ্য নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র।  কলকাতার ধোনিদের মধ্যে রাজা নবকৃষ্ণের হাত ধরে বাবু কালচার শুরু হয়।  পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সহায় করার জন্য পুরস্কার হিসেবে প্রভূত ধনসম্পত্তি পেয়েছিলেন।  শোভাবাজারে তিনি একটি প্রাসাদোপম বাড়ি শোভারাম বসকের কাছ থেকে কেনেন।  বাড়িটি কেনার পর তিনি বহু টাকা ব্যয় করে সংস্কার করেন।  বাড়িটি ঠাকুরদালান সমেত কয়েক মহল ছিল।  ঐতিহাসিকদের মতে বাংলার শেষ নবাব সিরাজের বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারায় তিনি প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন।  

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়কে স্মরণীয় করে রাখতে লর্ড ক্লাইভ বাঙালির দুর্গাপূজাকে হাতিয়ার করেন।  তিনি রাজা নবকৃষ্ণকে বিজয়ৎসব করার কথা বলেন।  রাজা তাঁর নবনির্মিত ঠাকুরদালানে এই উৎসবের আয়োজন করেন।  শুরু হল দেবী দুর্গাকে ঘিরে উৎসব।  এই পুজোয় আমন্ত্রিত হয়ে সাঙ্গপাঙ্গ সমত লর্ড ক্লাইভ এসেছিলেন।  মহামান্য ক্লাইভের ও আমন্ত্রিত সাহেবদের বসার জায়গা এমনভাবে করা হয়েছিল  যাতে তাঁরা সরাসরি দেবীর পুজো দেখতে পারেন।  কথিত আছে, লর্ড ক্লাইভ সঙ্গে করে কয়েক ঝুড়ি ফল নিয়ে এসেছিলেন।  এছাড়া তিনি ১০১ টাকা চাঁদাও দিয়েছিলেন।  

পূজা উপলক্ষ্যে লাগামহীন আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ উচ্ছাসের  ব্যবস্থা করা হয়েছিল।  খানাপিনা ও বাইজি নাচের অঢেল ব্যবস্থা ছিল।  শোনা যায়,  লখনউ থেকে বাইজি ও বেনারস থেকে পুরোহিত নিয়ে আসা  হয়েছিল।  ১৮০১ সালে উইলিয়াম ওয়ার্ড শোভাবাজার রাজবাড়ীর দুর্গাপুজোর নবমী রাত্রির   বিবরণ লিখে গেছেন। তাঁর বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি, হিন্দু নর্তকীদের নাচ, মুসলমান বাঈজীরা হিন্দুস্থানী গান গেয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে সকলকে আপ্যায়ন করেছিল।  চারদিকে সাবেবরা বসে এই নাচের দৃশ্যগুলো উপভোগ করেছিলেন।  পূজামণ্ডপে নানারকম খিস্তিখেউড় ও বেলেল্লাপনা করা হয়েছিল, যা কলকাতার পুজোয় সর্বপ্রথম এখানেই দেখা গিয়েছিলো।  

১৮০২ সালে ফ্যানি পার্কস নবকৃষ্ণের পুজো সম্বন্ধে লিখে গেছেন - "পুজোমণ্ডপের পাশের একটা বড় ঘরে নানারকম উপাদেয় খাবার অঢেল পরিমানে সাজানো রয়েছে। সবই বাড়ির কর্তার সাহেব অতিথিদের জন্য।  খাবার সরবরাহ করেছেন বিদেশী পরিবেশক গান্টার আন্ড হুপার।  খাবার জিনিসের সঙ্গে বরফ ও ফরাসি মদ ছিল প্রচুর।  মণ্ডপের আর একদিকে একটা বড় হল ঘরে সুন্দরী বাঈজীদের নাচগান হচ্ছিলো।  সাহেব ও এদেশীও ভদ্রলোকেরা চেয়ার বসে সুরা পান করতে করতে সেই নাচ দেখছিলেন।  বাঈজীদের গান শোনার জন্য বাইরেও বেশ লোকের ভিড় হয়েছিল।  বাঈজীদের নাচগান সকলকে বেশ মাতিয়ে রেখেছিল।"

সেই থেকে বাবুদের দুর্গাপুজো মহাসমারোহে উদযাপিত হতে আরম্ভ করে।  শুধু নাচ নয়, পুজোর জাঁকজৌলুস, বিলাস,-বৈভব, খানাপিনার বহর, সাহেব-মেমদের আপ্যায়ন শুরু হয়েছিল।  দেবী দুর্গার পুজোকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উৎসব।  এই নিয়ে সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় নানারকম মুখরোচক খবর ছাপা হত।  সাহেবরা কলকাতার দুর্গাপুজোকে "গ্রান্ট ফেস্ট"  নামে  অবিহিত করেছিলেন। 

বাবুদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল আভিজাত্যের লড়াই।  বিলাস-বৈভব ও বিপুল ব্যয়ের কারণে বর্তমানে বনেদি বাড়িগুলোর দুর্গাপুজোয় পড়তির চিহ্ন স্পষ্ট,  হারিয়ে গেছে বাবু কালচার।  সে যাই  হোক, রাজা নবকৃষ্ণের হাত ধরেই আমাদের শহরে ধুমধাম  সহকারে পুজো শুরু হয়েছিল।  দুগাপুজো তাঁর  হাত ধরেই পরিণত হয়েছিল দুর্গোৎসবে।  



ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  

তারিখ :২০-১০-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




 










 

No comments: