সহেলীর কৌতুহল
(পর্ব - ৩)
আমাদের গ্রামটা ছিল খুবই ছোট। সব মিলিয়ে মোটামুটি চারশো জনের মত লোকের বসবাস ছিল। তার মধ্যে সবাই যে হিন্দু ছিল তা নয়। কয়েকটি মুসলমান পরিবারও বসবাস করত। প্রধানত কৃষিভিত্তিক গ্রাম ছিল। তবে কৃষক ছাড়াও কামার, কুমোর, জেলে প্রভৃতি পেশার লোকেরাও বাস করত।
গ্রামটা ছিল আমার প্রাণ। হৃদয় কাড়া গ্রামের সেইসব দৃশ্য, গ্রামের প্রকৃতি, গ্রাম্য জীবন আজও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় অবচেতন সময় হানা দেয়। ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে করলে এক পরম সুখ অনুভব করি ও মনে মনে খুব তৃপ্তি পাই, কারণ আমাদের জীবনের একটা রঙিন অধ্যায় হল শৈশব। সেই শৈশবকালটা আমার গ্রামেই কেটেছে।
আমাদের গ্রামের থেকে দু কিলোমিটার দূরে প্রতি সোমবার, বুধবার ও শুত্রুবারে একটা 'গ্রামীণ হাট' বসতো। 'হাট' কি তুই সেটা জানিসতো?
সেরকমভাবে না জানলেও কিছুটা শুনেছি। রবীন্দ্রনাথের লেখা 'হাট' নামের একটা কবিতা ছোটবেলায় পড়েছিলাম। কবিতাটা আমার খুব ভালো লেগেছিলো। কবিতাটার কিছু অংশ আজও মনে আছে।
"কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি
বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি
গাড়ি চালায় বংশীবদন,
সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন।
হাট বসেছে শুত্রুবারে
বক্সীগঞ্জের পদ্দাপাড়ে।"
কবিতাতে বলা আছে হাট সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ শুধু শুত্রুবার বসত আর তোমাদের গ্রামের হাট সপ্তাহে তিন দিন বসত, তাই তো।
হ্যা, সপ্তাহে তিনদিন বসত কারণ আমাদের ও আশপাশের গ্রামগুলোতে সেরকম কোনো দোকান ছিল না। ওই হাটটাই ছিল আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায়। এখানে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন পাওয়া যেত তেমন গৃহস্থালি দ্রব্যও পাওয়া যেত। এটাই ছিল ক্রয়-বিক্রয়ের উপযুক্ত স্থান। এই হাটের উপর আমাদের নির্ভর করতে হত। শুধু আমাদের গ্রাম নয়, দূর-দূরান্ত থেকে বহু লোক এই হাটে আসতো। হাটটা ছিল পরস্পরের দেখা-সাক্ষাতের ও কুশল বিনিময়ের উপযুক্ত স্থান। এরকম গ্রাম্য হাট পল্লীজীবনের এক উপযুক্ত যোগাযোগ কেন্দ্র, তাই তার গুরুত্ব অপরিসীম। একে বাদ দিয়ে গ্রামের লোকেদের জীবনযাত্রা, গ্রামের অর্থনীতি ভাবা যায় না। এখানে একদিকে যেমন কাঁচা বাজার অর্থাৎ শাক সবজি, মাছ, মাংস পাওয়া যেত তেমন অন্যদিকে চাল, ডাল, লবণ প্রভৃতি শুকনো দ্রব্যাদি বিক্রি করা হত। হাটে গাছের বীজ ও সার বিক্রি হত। কামার-কুমোর-ছুতোরের তৈরী জিনিসপত্র, জামা কাপড়ের দোকান বসতো। এছাড়া গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিও বিক্রি হত।
তোমাদের গ্রামে কোনো দোকান ছিল না?
না, সেই সময় ছিল না। পরে অবশ্য কয়েকটা হয়েছে বলে শুনেছি। এখন দিনকাল অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মানুষের চাহিদা ও রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। দিনের সাথে সাথে গ্রামের চেহারাও অনেকটা বদলে গেছে।
দূর্গাপুজোটা আমাদের দেশে শরৎ ঋতুতে করা হয়। বাংলায় বর্ষা গেলে আসে শরৎকাল। এই শরৎ ঋতুতে আমাদের দেশ শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে, কৃষকদের ঘর ভোরে ওঠে। শরতের আছে নিজস্ব বর্ণ ও গন্ধ। এই সময় প্রকৃতি সেজে ওঠে কাশফুল ও শিউলি ফুলে। মাতাল হাওয়া, নীল আকাশে যেমন দেখা যায় সাদা মেঘের ভেলা তেমন খাল-বিলের জলে শাপলা ফুটতে দেখা যায়।চলতে থাকে সময়-অসময়ে শুভ্র-সফেদ মেঘের আনাগোনা আবার কখনো কখনো রোদের ঝিলিক। ক্ষনে ক্ষনে ঋতুরানির দুরন্তপনা উচ্ছল কিশোরীকেও যেন হার মানায়। এমন প্রকৃতিতে রঙের খেলায় মেতে উঠতে চায় মন। তাই প্রকৃতির রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে সকল বাঙালির মনও বদলে যায়।
আমার গ্রাম, গ্রামের পূজা আমার সুখ স্মৃতির সঞ্চয়। অবসর জীবনের খোরাক। আমাদের গ্রামে মাত্র একটা দুর্গাপুজো হতো। গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট একটা টিনের চালার শিব মন্দির ছিল। এই মন্দিরে শিবরাত্রির দিন খুব ঘটা করে বাবা মহাদেবের পূজা করা হতো। গ্রামের মহিলারা এইদিন উপোষ করে মন্দিরে এসে বাবা মহাদেবের মাথায় জল ঢালতো। আমাদেরও সেই সময় কিছু প্রসাদ জুটে যেত। শিবরাত্রির দিন শিবমন্দির চত্বরটা সকাল থেকেই বেশ গমগম করত। লোকে-লোকারন্য হয়ে থাকতো।
এই শিব মন্দিরের বাঁপাশে ছোট একটা মাঠ ছিল। ওই মাঠে বাঁশ-কাপড় দিয়ে কালু কাকা প্যান্ডেল তৈরী করে দিত। সেই প্যান্ডেলে ছোট একচালা প্রতিমায় পূজা করা হত। প্রতিমাটা আমাদের গ্রামের অরুণকাকু বানাতো। রথের দিন থেকে কাকু প্রতিমার কাঠামো বানাতে শুরু করত। আমরা রোজ স্কুল যাওয়ার সময় ও স্কুল থেকে ফেরার সময় একবার করে অরুণকাকুর বাড়িতে ঠাকুর দেখতে যেতাম। লক্ষ করতাম প্রতিমার কাজ কতটা এগোলো। আমার খুব কৌতূহল ছিল অসুরকে নিয়ে। অসুরের গোঁফটা এবার কতটা মোটা হল, তার গড়নটা কতটা তাকরাই হল সেদিকে আমার সজাক দৃষ্টি থাকতো। গড়ন ভালো না হলে ওরকম তেজস্বীনি মহিলার সাথে যুজঁতে পারবে না তো। ভাবতাম একজন নারী হয়ে কি করে ওইরকম একজন বলবান পুরুষকে পরাস্ত করলো। আসলে তখন তো পৌরাণিক ব্যাখ্যাগুলো আমার জানা ছিল না। মায়ের চোখ তিনটিও আমায় খুব আকর্ষণ করতো। অরুণকাকু যখন মায়ের চোখ আঁকতো, তখন উপস্থিত থেকে সবটা দেখতাম।
মাটি, বাঁশ, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরী হত দশ হাতের দেবী দূর্গা। আমার চোখের সামনে আস্তে আস্তে তা গড়ে উঠতো। ছোটোবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম প্রতিমা তৈরী। প্রথমে খড়ের সাহায্যে দেবীর আকার তৈরি করা হতো। তারপর তাতে মাটি লেপা হত। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতো দেবীর সব অঙ্গ। গড়ে তোলা হত তাঁর পুত্র-কন্যাদের। শুধু তাই নয় দেখতাম সবার বাহনগুলোকেও নির্মাণ করতে। মাটির কাজ শেষ হলে অরুণকাকু প্রতিমায় রঙের কাজ শুরু করতো। আস্তে আস্তে মাটির ঠাকুরগুলো নানারকম রঙে রঙিন হয়ে উঠতো। কারো গায়ের রঙ হলুদ, কারো সবুজ। তারপর দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে কাপড় ও কার্তিককে রাজবেশে আর গণেশকে ধুতি পরিয়ে সজ্জিত করা শেষ হলে তাঁদের নানারকম অলংকারে অলংকৃত করা হত। এইভাবে চলতে চলতে একদিন প্রতিমা নির্মাণের কাজ শেষ হত। দেবীর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র উঠতো। দেবীর অস্ত্র ভান্ডারে দেখা যেত ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বাণ, ঢাল, ধনুক, ঘন্টা, নাগপাশ ইত্যাদি। ঠিক সময় ঠাকুর চলে আসতো কালু কাকার তৈরী মণ্ডপে। বড়দের সাথে ছোটোরাও মন্ডপে ঠাকুর আনার জন্য যেতাম। ঠাকুর মন্ডপে নিয়ে আসার পর অরুণকাকু প্রতিমাগুলোতে অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করতো। এই সময় প্রায় এক মাসের জন্য আমাদের স্কুল বন্ধ থাকত। ঢাকের শব্দে একদিন সকালে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। বুঝতে পারতাম আজ ষষ্ঠী, আজ দেবীর বোধন। আমরা তখন ছোট, আমাদের কাছে কোনো ধর্ম ছিল না, ছিল না কোনো জাত-পাত, আনন্দটাই প্রধান ছিল। গ্রামের সবাই একসাথে আনন্দে মেতে উঠতাম। মা বলত দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী, তাঁকে ভক্তিভরে ডাকলে নাকি লেখাপড়া খুব ভালো হয়। তাই আমি মায়ের কথা মত প্যান্ডেলে গিয়ে সবার প্রথমে দেবী সরস্বতীকে ভক্তিভরে প্রণাম করতাম। মা আরো বলতো 'মা' শব্দটি যেমন যে কোনো সন্তানের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শব্দ, ঠিক তেমন মা ও সন্তানের মিলনোৎসব হলো শারদীয়া দুর্গোৎসব। এই উৎসব বাঙালি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনের সবচেয়ে বড় ও প্রিয় উৎসব।
প্রতিবছর যে আমাদের নতুন জামা-কাপড় কেনা হত তা কিন্তু নয়, ধানের দাম মহাজন পূজার আগে ঠিকমতো মিটিয়ে দিলে সাধারণত নতুন জামা-কাপড় কেনা হত। যেবার মহাজন পূজার আগে দাম মেটাতে পারতো না, সেবার আর নতুন কিছু আমাদের কপালে জুটতো না। সেইসব বছরগুলোতে আমাদের যে মন খারাপ হত না, তা বলব না, তবে সবকিছু ভুলে আমরা পূজার আনন্দে মেতে থাকতাম। ওই কটাদিন লেখা পড়া বন্ধ, শুধুই আনন্দ, শুধুই মজা।
(চলবে)
তারিখ :০৬-০৩-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment