Sunday, May 19, 2019

রবীন্দ্রনাথের আদি নিবাস >

রবীন্দ্রনাথের আদি নিবাস.....





পুরোনো কলকাতার গল্পে কলকাতার নানারকম কাহিনীর কথা বলা হয়। সেইসব কাহিনীর বেশিরভাগই কলকাতার স্থাপত্যের ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়। কলকাতার ঐতিহ্য শুধুই তার স্থাপত্যে সীমাবদ্ধ নয়। সেই সময়কার কলকাতার পরিবহন, রাস্তাঘাট এবং কলকাতাবাসীদের জীবনধারণ, খ্যাদ্যাভাস সবই এই ইতিহাসের সামিল হয়ে আছে। কলকাতার আদি যুগে প্রচুর বর্ধিষ্ণু পরিবার এখানে বসবাস করত। তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে বজায় করে চলত। এইরকমই এক ঐতিহ্যশালী বিশ্ববিখ্যাত  পরিবারের আদি নিবাসের কথা আজ  বলব। আমার এক বন্ধুর অনুরোধে এই বিষয় নিয়ে লেখা। এই কাহিনী হয়তো বেশিরভাগ মানুষের জানা আছে,  মবে হয়  কিছু মানুষের বা বর্তমান প্রজন্মের জানা নেই। তাই আজ আমার লেখার বিষয়বস্তু উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস নিয়ে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি সর্বজন পরিচিত এক ঐতিহ্যশালী বাড়ি। এই ঠাকুর পরিবারের সন্তান দর্পনারায়ণ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বিশ্বজোড়া। এই পরিবারের ইতিহাস প্রায় তিনশো বছরের ইতিহাস। বাংলার নবজাগরণে এই পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গভীর ছিল। সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজ-সংস্কার, শিল্পকলা ও সংগীতে এই পরিবারের নাম বাংলার ইতিহাসে প্রথম সারিতে রয়েছে। ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস কিন্তু জোড়াসাঁকো বা পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে ছিল না। তাঁদের পূর্ব পুরুষদের পদবিও ঠাকুর ছিল না।

এই ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস সম্বন্ধে নানাজনের নানা মত রয়েছে। কেউ বলেন বর্ধমান জেলার কুশগ্রামে আদি নিবাস ছিল, কেউ বলেন অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার পিঠভোগ গ্রামে ছিল। আবার কেউ বলেন যশোর জেলা থেকেই এই পরিবারের উদ্ভব।  ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল বর্ধমানের কুশগ্রাম থেকেই এই বংশের পদবি "কুশারী" হয়েছিল।  বর্ধমানের কুশগ্রামের কুশারীরাই বাংলাদেশের খুলনা ও যশোরে এসে বসবাস শুরু করে।  এই বংশের আদি পুরুষ ছিলেন জগন্নাথ কুশারী। তিনি খুলনা  থেকে যশোরে এসে বাস করেন। তিনি যশোরের পিরালী ব্রাহ্মণ শুকদেব রায়চৌধুরীর কন্যাকে তিনি বিবাহ করেন। জগন্নাথের পুত্র পুরুষোত্তম ও প্রপৌত্র ছিলেন পঞ্চানন কুশারী। এই পঞ্চানন কুশারী ভাগ্য অন্নেষণে গোবিন্দপুর গ্রামে এসে গঙ্গা তীরবর্তী স্থানে বসবাস শুরু করেন।  সেই আমলে যারা ভাগ্য অন্নেষণে কলকাতা, সুতানুটি বা গোবিন্দপুরে আসতেন, তারা বেশিরভাগই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কেউ কেউ আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে লিপ্ত হতেন। পঞ্চানন কুশারী কিন্তু ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।  তিনি কোম্পানির জাহাজের ক্যাপ্টেন ও খালাসীদের বিভিন্নরকম মাল সরবরাহ করতেন। জাহাজে মাল ওঠানো-নামানোর কাজও তিনি করতেন।

 আমাদের দেশে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ব্রাহ্মণ সন্তানদের "ঠাকুরমশাই" বলে সম্বোধন করা হতো। ইংরেজরা এই ঠাকুর কথাটিকে বিকৃত করে টেগোর বলতো। ঠাকুর মশাই খেতাবের আড়ালে তাদের আসল পদবি  হারিয়ে যেতে দেখা যেত। পঞ্চানন কুশারীকে ইংরেজরা পঞ্চানন টেগোর  বলে ডাকত। ব্যবসার কাজে যেসব নীচু শ্রেণীর মানুষের সাহায্য তিনি নিতেন, তারাও তাঁকে ঠাকুরমশাই বলে সম্বোধন করত। এইভাবে পঞ্চানন কুশারীও ধীরে ধীরে পঞ্চানন ঠাকুর হয়ে যান। ইংরেজরাও তাদের নথিপত্রে কুশারী পদবিটা পাল্টে ঠাকুর পদবি লেখা শুরু করে। এই পরিবার এইভাবে  কুশারী পরিবার থেকে  ঠাকুর পরিবারে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

পঞ্চানন ঠাকুরের দুই  পুত্র ছিল।  তাঁদের নাম জয়রাম,  রামসন্তোষ। পঞ্চানন তাঁর জীবদ্দশায় ইংরেজ কালেক্টর রালফ শেলডন সাহেবকে ধরে তাঁর দুই পুত্র জয়রাম ও রামসন্তোষকে  কোম্পানিতে আমিনের চাকরি করে দেন। তাঁরা দীর্ঘদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে আমিনের কাজ করেছিলেন। তাঁরা তখন গোবিন্দপুর নিবাসী ছিলেন। পরবর্তীকালে কোম্পানি গোবিন্দপুরে একটা দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এই দুর্গই বর্তমানের ফোর্ড উইলিয়াম দুর্গ।  এই দুর্গ নির্মাণের জন্য প্রচুর জমির প্রয়োজন হয়ে পরে। কোম্পানি গোবিন্দপুরে বসবাসকারীদের এখানকার জমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তখন জয়রামদের  এই জমির মায়া ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল। তাঁরা সেই সময় পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে চলে আসেন। জয়রামের চার পুত্র ছিল তাঁরা হলেন আনন্দরাম , দর্পনারায়ণ, নীলমনি ও গোবিন্দরাম। ১৭৫৬ সালে জয়রামের মৃত্যু হয়।  তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আনন্দরাম অকালে মারা যান। জয়রাম ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র গোবিন্দরাম নিঃসন্তান ছিলেন। চারজনের মধ্যে সুযোগ্য পুত্র ছিলেন দর্পনারায়ণ ও নীলমনি। দর্পনারায়ণ ব্যবসায়ী ছিলেন। দর্পনারায়ণ ঠাকুরই ঠাকুর বংশের প্রথম পুরুষ হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। নীলমনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে সেরেস্তার কাজ করতেন। তাঁরা পাথুরিয়াঘাটাতে একটা বিশাল বাড়ি নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে পারিবারিক বিবাদ শুরু হয়।। এই বিবাদের ফলে নীলমনি ঠাকুর পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ত্যাগ করেন। তাঁরা এক সালিশি সভা করে ঠিক করেন দর্পনারায়ণ নীলমনিকে এক লক্ষ টাকা প্রদান করবেন এবং গৃহদেবতা লক্ষীনারায়ানের ভার নীলমনিকে নিতে হবে। দর্পনারায়ানকে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি দিয়ে নীলমনি তাঁদের গৃহদেবতা লক্ষীনারায়ণ ও এক লক্ষ টাকা নিয়ে পাথুরিঘাটার বাড়ি ত্যাগ করেন।। এই সময় বৈষ্ণবদাস শেঠ নামে এক ব্যবসায়ী নীলমনিকে চিৎপুরের মেছোবাজারে বাড়ি নির্মাণ করার জন্য কয়েক বিঘা জমি প্রদান করেন। নীলমনি ওই জমির উপর আলাদাভাবে নিজের বসতবাড়ি গড়ে তুললেন। নীলমনি ঠাকুরের তৈরী এই বাড়িই হলো আজকের জগৎবিখ্যাত "জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি"। মেছোবাজার অঞ্চলটি পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকো নাম হয়েছিল। নীলমনি ঠাকুরের পুত্র দ্বারকানাথ। তিনি প্রথমে ল এজেন্ট ও.পরবর্তীকালে তিনি চব্বিশ পরগনার জেলার কালেক্টর ছিলেন। দ্বারাকানাথ পরবর্তীকালে রাজসাহীর কালিগ্রামের বিশাল জমিদারি কিনে জমিদার হয়ে যান। দ্বারকানাথের হাত ধরেই ঠাকুর পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।  বাঙালি সমাজ থেকে ইংরেজি সমাজ সর্বত্রই তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। ঠাকুর পরিবার জমিদার পরিবারে পরিণত হয়। প্রিন্স দ্বারকানাথের পাঁচ পুত্র ছিল যথাক্রমে দেবেন্দ্রনাথ, নরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ, ভূপেন্দ্রনাথ এবং নগেন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন  কবি, সংগীতজ্ঞ, সাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী ও সমাজ-সংস্কারক হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন।  তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত।

এইভাবেই খুলনা থেকে গোবিন্দপুর, গোবিন্দপুর থেকে পাথুরিয়াঘাটা  হয়ে ঠাকুর পরিবার  জোড়াসাঁকোয় চলে আসেন। বিশ্ববিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি তৈরী হয়।  কুশারী পদবি থেকে তাঁরা  ঠাকুর পদবি লাভ করে।

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


No comments: