পৌষের আমন্ত্রণে গ্রামীণ মেলায়
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে
আয় রে চলে, আয় আয় আয়।
শীত ঋতুর পৌষ মাসেই বাংলায় নবান্ন উৎসবের পরে আয়োজিত হয় বিভিন্ন উৎসব। পৌষের কুয়াশায়, শীত শীত হাওয়ায়, শীতল বাতাসে নেচে ওঠে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের মন। শীতকাল আর মেলা যেন একে ওপরের পরিপূরক। এই সময় কলকাতা ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি মন এইসব মেলাগুলোকে উপেক্ষা করে ঘরে বসে থাকতে পারে না। বছর দুয়েক আগে আমিও পৌষের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারিনি। চলে গিয়েছিলাম এক গ্রামীণ মেলায়। ডাকছিল পৌষ, ডাকছিল শান্তিনিকেতন, এ যেন মাটির টানেই চলে যাওয়া।
এককালে পশ্চিমবঙ্গের একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। ১৮৬০ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ গ্রামটির বিস্তীর্ণ অঞ্চল কিনে নিয়েছিলেন। অঞ্চলটির উন্নয়ন করেন। তৈরী করেন তাঁর সাধের প্রার্থনা ভবন। পরবর্তীকালে ভুবনডাঙা হয়ে যায় শান্তিনিকেতন। মেলাকে কেন্দ্র করে কবিগুরুর নানান স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে , জড়িয়ে রয়েছে নানান গল্পগাঁথা।
১৮৪৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর (৭ই পৌষ, ১২৫০) মহর্ষি কয়েকজন অনুগামীকে নিয়ে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছ থেকে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১২৯৮ সালের ৭ই পৌষ (২১শে ডিসেম্বর, ১৮৯১) শান্তিনিকেতনে তিনি একটা ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করেন। এই মন্দিরের উদ্বোধনের সময় তিনি মূল মন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকের মাঠে একটা ছোট্ট মেলায় আয়োজন করেন। সেই থেকেই শান্তিনিকেতনের জগৎ বিখ্যাত পৌষ মেলার শুরু। মহর্ষির প্রয়ানের পর রবীন্দ্রনাথই মেলার রূপকার হিসেবে দেখা দেন। মেলার আয়তন বৃদ্ধি পাবার ফলে পরে মেলাটি পূর্বপল্লীর মাঠে আয়োজন করা হয়। মেলাটি চলে দিন তিনেক তবে ভাঙা মেলাটি চলে আরো বেশ কয়েকদিন। সমগ্র শহরটি জুড়েই বসে যায় পসরার হাট। খোয়াইয়ের পাড়ও হয়ে ওঠে জমজমাট। একতারার সুরে রবীন্দ্রনাথের শহর দুলতে থাকে। প্রতিবছর নিয়ম করে বিশ্বভারতী ৭ই পৌষ থেকে ৯ই পৌষ মেলাটির আয়োজন করে থাকে। মেলার সূচনা হয় বৈতালিক গান দিয়ে। গান গেয়ে গেয়ে আশ্রমিকরা ও অতিথিরা শালবীথি, আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথি, ছাতিমতলা পরিক্রমা করেন।উপাসনা, প্রয়াত আশ্রমিকদের স্মরণ থেকে খ্রিস্ট উৎসবের মাধ্যমে মূল পৌষ মেলাটির সমাপ্তি ঘটে। এই মেলার বড় বিশেষত্ব হস্তশিল্প ও গ্রামীণ কৃষ্টির উপস্থিতি। বাঙালির অনুভূতির সঙ্গী যেমন রবীন্দ্রনাথ, তেমন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা বাঙালির মননের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বছর দুয়েক আগে কলকাতা থেকে রওনা দিলাম পৌষের আমন্ত্রণে বোলপুরে। পৌঁছে গেলাম ঘন্টা তিনেকের মধ্যে। স্টেশনে নেমে দেখলাম লোকে লোকারণ্য। সবাই একটা গাড়ির জন্য ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ কিছু না পেয়ে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ভাগ্যক্রমে একটা সাইকেল রিক্সা পেয়ে গেলাম। আগে শুনেছিলাম স্টেশন থেকে মেলা প্রাঙ্গনের ভাড়া ৩০ টাকা, কিন্তু রিক্সাওয়ালা আমার কাছে ২০০ টাকা চাইলো। অনেক দরাদরি করার পর ১৫০ টাকায় সে রাজি হলো। অল্প সময়ের মধ্যে মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে গেলাম।
রিক্সা করে যেতে যেতে দেখছিলাম রাস্তার ধারে অনেক জায়গায় গ্রাম্য মহিলারা নানারকম পসরা সাজিয়ে বসে আছে। মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকে দেখলাম চারদিকে শুধু দোকান আর দোকান। বেশিরভাগই হস্তশিল্পের দোকান। প্রাঙ্গনটিতে নিরাপত্তার বেশ আঁটোসাঁটো ব্যবস্থা রয়েছে। সাদা পোশাকের মহিলা ও পুরুষ পুলিশ টহল দিচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ার ও সিসিটিভির মাধ্যমে অঞ্চলটির দেখভাল চলছে একটি কেন্দ্র থেকে। রয়েছে পুলিশের একটা সহাযতা কেন্দ্র। এছাড়া বিশ্বভারতীর বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষীও পর্যটকদের সহাযতা করছে। রিক্সাওয়ালার মুখে শুনছিলাম আগে আতসবাজির প্রদর্শনী হতো, বর্তমানে নিরাপত্তার কারণে তা বন্ধ রয়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাঙ্গনটিতে মাঝে মাঝে জল ছড়ানো ও ঝাড় দেওয়া হচ্ছে। মেলার এক ধারে একটা বিশাল মঞ্চ রয়েছে, রয়েছে মঞ্চটির পিছনে বাউলের আখড়া। মঞ্চটিতে সারাক্ষণই বাউল সংগীত পরিবেশন করা হচ্ছে। এই বাউল সংগীত মেলাটির অন্যতম আকর্ষণ।
মেলাটিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দপ্তরের স্টল রয়েছে, রয়েছে শান্তিনিকেতন ব্যাগ, কাঠের তৈরী বিভিন্ন খেলনা, টেরাকোটার তৈরী ঘর সাজানোর জিনিস, পাটের তৈরী পুতুল ও জুতো, ডোকরার অলংকার, বাঁশি-ডুগডুগি-একতারা। এছাড়া বই, বস্ত্র ও চর্মজাত দ্রব্যের দোকানও ঝলমল করছে। বাঁশির সুরে দোল দিচ্ছে পিঠে-পুলিও। জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি বলে মনে হলো না। মেলার মধ্যে গ্রামীণ ও শহুরে জিনিসের সম্ভার সর্বত্রই বিরাজ করছে। মেলার একপ্রান্তে বাচ্ছাদের খেলার জন্য দু-তিনটে জায়গা করা আছে, সেখানে টিকিটের বিনিময়ে বাচ্ছারা কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে পারে। প্রাঙ্গণটির ঠিক মাঝখানে একটা জায়গা গোল করে ঘিরে রাখা আছে, জায়গাটি অপূর্ব ফুলে সজ্জিত রয়েছে। তবে ফুলগুলো সবই মেলার শোভাবর্ধনের জন্য, ক্রয় করা যাবে না। সবশেষে বলি মেলার মূল আকর্ষণ বাউল সংগীত হলেও খাবারের স্টলগুলো কম আকর্ষণের নয়। আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবেই। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বসে খাবার খেতে খেতে একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছে। গরম গরম জিলিপি, এগরোল, ঘুগনি, তেলেভাজা, বাদামভাজা, পাউরুটির কাটলেট, বিরিয়ানি কি নেই সেখানে। জিভে জল আনার পক্ষে যথেষ্ট। আমিও লোভ সামলাতে পারলাম না, একটা এগ রোলের অর্ডার দিয়েই ফেললাম। খেতে খেতে কিছুটা বিশ্রামও হয়ে গেলো।
কয়েকদিনের মেলা হলেও মেলাটিতে দেশীয়দের সাথে বহু বিদেশী পর্যটককেও ঘুরতে দেখছিলাম। কেনাকাটা বা বিকিকিনি বেশ ভালোই চলছে। মেলাটি যেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রনে গড়ে উঠেছে। হস্তশিল্প ও গ্রামীণ শিল্পীদের সম্ভার বিক্রিকে বিশ্বভারতী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ত্ব দেয়। হাড় হিম করা কড়া ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে লালমাটির শাতিনিকেতন কয়েক হাজার মানুষের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা হয়ে উঠেছে বাংলার ঐতিহ্যের মিলনস্থল।
বেড়েছে খরচ, বেড়েছে ব্যবস্থাপনার খরচও, বিশৃঙ্খলা ও বিন্যাসের প্রতুলতা ছাড়িয়ে গেছে বোলপুর থেকে শান্তিনিকেতন হয়ে খোয়াই পর্যন্ত। বেড়েছে হুল্লোড়ের ব্যাপ্তি, কমেছে ধর্মীয় পবিত্রতা ও শান্তশ্রী পরিবেশ। তবে টেরাকোটার কারুকাজ কেনা, বাউল গানের আসর, চেনা-অচেনা মানুষের মৈত্রী, কুয়াশাঘেরা বিষণ্ণতা আজও টিকে আছে। এ যেন গ্রামীণ কার্নিভ্যাল। বাঙালির সাধের পৌষমেলা আজ চিরাচরিত ঐতিহ্যকে ছাপিয়ে যেন হয়ে উঠেছে কর্পোরেট।
বর্তমানে পৌষ মেলার চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটেছে। মহর্ষির আদর্শ কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে। কয়েকদিন আগে একটা দৈনিক কাগজে পড়চ্ছিলাম এক প্রবীণ আশ্রমিক জানিয়েছিলেন "পৌষমেলা তার আদর্শ ও ঐতিহ্য থেকে সরে এসেছে। সেকালের পৌষমেলার সাথে আজকের মেলার অনেকটাই ফারাক ঘটে গেছে।" আমি আগে কখনো এখানকার মেলায় আসিনি, তাই এই সম্বন্ধে আমার কোনোরূপ ধারণা নেই। তবে মেলা প্রাঙ্গনে ও রাস্তায় বেশ কিছু বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন দেখছিলাম। যুগের পরিবর্তনের সাথে হয়তো গ্রামীণ চরিত্র হারিয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণেও বেশ কয়েকটি নামি-দামি সংস্থার স্টলও রয়েছে। যাইহোক, জনপ্রিয় মেলাটি দেখতে সুদূর কলকাতা থেকে এসে বেশ আনন্দই উপভোগ করলাম। বাঙালির জীবনের সংস্কৃতির সাথে মেলাটি এখনো নিবিড়ভাবেই জড়িয়ে আছে বলে আমার মনে হলো। সন্ধ্যের ট্রেন ধরে আমায় ফিরে আসতে হবে বলে আর সময় নষ্ট করলাম না। মেলা প্রাঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কিভাবে যাবেন :
হাওড়া থেকে গণদেবতা, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ও আরো অনেকগুলো ট্রেন রয়েছে যেগুলো সরাসরি বোলপুর যায়। শিয়ালদহ থেকেও মাতারা এক্সপ্রেসও বোলপুর যায়। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার মতো সময় লাগে। বোলপুর থেকে মেলাপ্রাঙ্গন মিনিট কুড়ি সময় লাগে।
কোথায় থাকবেন :
বোলপুরে ও শান্তিনিকেতনে প্রচুর বেসরকারি হোটেল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের একটা সুন্দর অতিথি নিবাস রয়েছে। মেলার সময় যেতে চাইলে অন্তত দু-তিন মাস আগে থেকে হোটেল বুক করতে হবে, নইলে জায়গা পাওয়া যাবে না।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ০২-০১-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
বছর দুয়েক আগে কলকাতা থেকে রওনা দিলাম পৌষের আমন্ত্রণে বোলপুরে। পৌঁছে গেলাম ঘন্টা তিনেকের মধ্যে। স্টেশনে নেমে দেখলাম লোকে লোকারণ্য। সবাই একটা গাড়ির জন্য ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ কিছু না পেয়ে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ভাগ্যক্রমে একটা সাইকেল রিক্সা পেয়ে গেলাম। আগে শুনেছিলাম স্টেশন থেকে মেলা প্রাঙ্গনের ভাড়া ৩০ টাকা, কিন্তু রিক্সাওয়ালা আমার কাছে ২০০ টাকা চাইলো। অনেক দরাদরি করার পর ১৫০ টাকায় সে রাজি হলো। অল্প সময়ের মধ্যে মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে গেলাম।
রিক্সা করে যেতে যেতে দেখছিলাম রাস্তার ধারে অনেক জায়গায় গ্রাম্য মহিলারা নানারকম পসরা সাজিয়ে বসে আছে। মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকে দেখলাম চারদিকে শুধু দোকান আর দোকান। বেশিরভাগই হস্তশিল্পের দোকান। প্রাঙ্গনটিতে নিরাপত্তার বেশ আঁটোসাঁটো ব্যবস্থা রয়েছে। সাদা পোশাকের মহিলা ও পুরুষ পুলিশ টহল দিচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ার ও সিসিটিভির মাধ্যমে অঞ্চলটির দেখভাল চলছে একটি কেন্দ্র থেকে। রয়েছে পুলিশের একটা সহাযতা কেন্দ্র। এছাড়া বিশ্বভারতীর বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষীও পর্যটকদের সহাযতা করছে। রিক্সাওয়ালার মুখে শুনছিলাম আগে আতসবাজির প্রদর্শনী হতো, বর্তমানে নিরাপত্তার কারণে তা বন্ধ রয়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাঙ্গনটিতে মাঝে মাঝে জল ছড়ানো ও ঝাড় দেওয়া হচ্ছে। মেলার এক ধারে একটা বিশাল মঞ্চ রয়েছে, রয়েছে মঞ্চটির পিছনে বাউলের আখড়া। মঞ্চটিতে সারাক্ষণই বাউল সংগীত পরিবেশন করা হচ্ছে। এই বাউল সংগীত মেলাটির অন্যতম আকর্ষণ।
মেলাটিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দপ্তরের স্টল রয়েছে, রয়েছে শান্তিনিকেতন ব্যাগ, কাঠের তৈরী বিভিন্ন খেলনা, টেরাকোটার তৈরী ঘর সাজানোর জিনিস, পাটের তৈরী পুতুল ও জুতো, ডোকরার অলংকার, বাঁশি-ডুগডুগি-একতারা। এছাড়া বই, বস্ত্র ও চর্মজাত দ্রব্যের দোকানও ঝলমল করছে। বাঁশির সুরে দোল দিচ্ছে পিঠে-পুলিও। জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি বলে মনে হলো না। মেলার মধ্যে গ্রামীণ ও শহুরে জিনিসের সম্ভার সর্বত্রই বিরাজ করছে। মেলার একপ্রান্তে বাচ্ছাদের খেলার জন্য দু-তিনটে জায়গা করা আছে, সেখানে টিকিটের বিনিময়ে বাচ্ছারা কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে পারে। প্রাঙ্গণটির ঠিক মাঝখানে একটা জায়গা গোল করে ঘিরে রাখা আছে, জায়গাটি অপূর্ব ফুলে সজ্জিত রয়েছে। তবে ফুলগুলো সবই মেলার শোভাবর্ধনের জন্য, ক্রয় করা যাবে না। সবশেষে বলি মেলার মূল আকর্ষণ বাউল সংগীত হলেও খাবারের স্টলগুলো কম আকর্ষণের নয়। আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবেই। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বসে খাবার খেতে খেতে একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছে। গরম গরম জিলিপি, এগরোল, ঘুগনি, তেলেভাজা, বাদামভাজা, পাউরুটির কাটলেট, বিরিয়ানি কি নেই সেখানে। জিভে জল আনার পক্ষে যথেষ্ট। আমিও লোভ সামলাতে পারলাম না, একটা এগ রোলের অর্ডার দিয়েই ফেললাম। খেতে খেতে কিছুটা বিশ্রামও হয়ে গেলো।
কয়েকদিনের মেলা হলেও মেলাটিতে দেশীয়দের সাথে বহু বিদেশী পর্যটককেও ঘুরতে দেখছিলাম। কেনাকাটা বা বিকিকিনি বেশ ভালোই চলছে। মেলাটি যেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রনে গড়ে উঠেছে। হস্তশিল্প ও গ্রামীণ শিল্পীদের সম্ভার বিক্রিকে বিশ্বভারতী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ত্ব দেয়। হাড় হিম করা কড়া ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে লালমাটির শাতিনিকেতন কয়েক হাজার মানুষের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা হয়ে উঠেছে বাংলার ঐতিহ্যের মিলনস্থল।
বেড়েছে খরচ, বেড়েছে ব্যবস্থাপনার খরচও, বিশৃঙ্খলা ও বিন্যাসের প্রতুলতা ছাড়িয়ে গেছে বোলপুর থেকে শান্তিনিকেতন হয়ে খোয়াই পর্যন্ত। বেড়েছে হুল্লোড়ের ব্যাপ্তি, কমেছে ধর্মীয় পবিত্রতা ও শান্তশ্রী পরিবেশ। তবে টেরাকোটার কারুকাজ কেনা, বাউল গানের আসর, চেনা-অচেনা মানুষের মৈত্রী, কুয়াশাঘেরা বিষণ্ণতা আজও টিকে আছে। এ যেন গ্রামীণ কার্নিভ্যাল। বাঙালির সাধের পৌষমেলা আজ চিরাচরিত ঐতিহ্যকে ছাপিয়ে যেন হয়ে উঠেছে কর্পোরেট।
বর্তমানে পৌষ মেলার চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটেছে। মহর্ষির আদর্শ কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে। কয়েকদিন আগে একটা দৈনিক কাগজে পড়চ্ছিলাম এক প্রবীণ আশ্রমিক জানিয়েছিলেন "পৌষমেলা তার আদর্শ ও ঐতিহ্য থেকে সরে এসেছে। সেকালের পৌষমেলার সাথে আজকের মেলার অনেকটাই ফারাক ঘটে গেছে।" আমি আগে কখনো এখানকার মেলায় আসিনি, তাই এই সম্বন্ধে আমার কোনোরূপ ধারণা নেই। তবে মেলা প্রাঙ্গনে ও রাস্তায় বেশ কিছু বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন দেখছিলাম। যুগের পরিবর্তনের সাথে হয়তো গ্রামীণ চরিত্র হারিয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণেও বেশ কয়েকটি নামি-দামি সংস্থার স্টলও রয়েছে। যাইহোক, জনপ্রিয় মেলাটি দেখতে সুদূর কলকাতা থেকে এসে বেশ আনন্দই উপভোগ করলাম। বাঙালির জীবনের সংস্কৃতির সাথে মেলাটি এখনো নিবিড়ভাবেই জড়িয়ে আছে বলে আমার মনে হলো। সন্ধ্যের ট্রেন ধরে আমায় ফিরে আসতে হবে বলে আর সময় নষ্ট করলাম না। মেলা প্রাঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কিভাবে যাবেন :
হাওড়া থেকে গণদেবতা, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ও আরো অনেকগুলো ট্রেন রয়েছে যেগুলো সরাসরি বোলপুর যায়। শিয়ালদহ থেকেও মাতারা এক্সপ্রেসও বোলপুর যায়। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার মতো সময় লাগে। বোলপুর থেকে মেলাপ্রাঙ্গন মিনিট কুড়ি সময় লাগে।
কোথায় থাকবেন :
বোলপুরে ও শান্তিনিকেতনে প্রচুর বেসরকারি হোটেল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের একটা সুন্দর অতিথি নিবাস রয়েছে। মেলার সময় যেতে চাইলে অন্তত দু-তিন মাস আগে থেকে হোটেল বুক করতে হবে, নইলে জায়গা পাওয়া যাবে না।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ০২-০১-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment