রাখী পূর্ণিমা ও উৎসব
বাঙালি বরাবরই উৎসব প্রিয় জাতি। তাদের রন্ধে রন্ধে বিভিন্ন উৎসব জড়িয়ে রয়েছে। কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। শ্রাবণ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে ঝুলন পূর্ণিমার উৎসব। ঝুলন সাজিয়ে ছোটরা এই উৎসবে সামিল হয়ে থাকে। ঝুলনযাত্রা পাঁচ দিন ব্যাপী চলে। এটা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের উৎসব। এই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে রাখী উৎসবের মধ্য দিয়ে। এই উৎসবের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, ও সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। এই উৎসব কবে কিভাবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কিছু গল্পও প্রচলিত রয়েছে।
এই উৎসবটা সাধারণভাবে সর্বভারতেই উদযাপিত হয়ে থাকে। হিন্দু জৈন ও শিখরা এই উৎসবে সামিল হয়। এটি ভাই বোনের ভালোবাসা ও শুভ কামনার উৎসব। এই দিন দিদি বা বোনেরা দাদা বা ভাইদের হাতে রাখী নামে পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। এই সুতোর মাধ্যমে তারা একে ওপরের কাছে সারা জীবন রক্ষা নিজেদের করার শপথ গ্রহণ করে।
মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে যে কোন এক যুদ্ধে কৃষ্ণের হাতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হয়, সেই সময় পাণ্ডবদের স্ত্রী দৌপদী তার শাড়ির আঁচলের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেয়। এই ঘটনায় কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে দৌপদীকে তার ভগ্নি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তিনি তাকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বহু বছর পর যখন কৌরবরা দৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ তার সম্মান রক্ষা করেন। এইভাবেই রাখীবন্ধনের প্রচলন হয়।
কথিত রয়েছে, দৈত্যরাজা বলি বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন। বিষ্ণু বৈকুন্ঠ ছেড়ে বলি রাজ্য রক্ষা করতে আসেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী তার স্বামীকেফিরে পাওয়ার জন্য সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজার কাছে আসেন এবং তাঁকে তার স্বামী নিরুদ্দেশ বলে জানান। তার স্বামী যতদিন না ফিরে আসবেন ততদিন তিনি রাজার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাজা তার প্রার্থনা মনজুর করেন। এই শ্রাবন পূর্ণিমার শুভ তিথিতে তিনি রাজার হাতে পবিত্র রাখী বেঁধে দেন। রাজা এই রাখী বাঁধার কারণ জানতে চাইলে তিনি রাজাকে সব খুলে বলেন। রাজা তার কথায় মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে আবার বৈকুন্ঠে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই থেকে রাখীবন্ধনের উৎসব পালিত হয়।
চিতোরের রানী কর্ণবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ূনকে রাখী পাঠান। সালটা ছিল ১৫৩৫। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানী ভয় পেয়ে যান এবং খুব অসহায় বোধ করেন। সেই সময় তিনি সম্রাট কাছে সাহায্য প্রার্থী হন এবং তাকে একটি রাখী পাঠান। রানীর পাঠানো রাখী দেখে সম্রাট অভিভূত হয়ে যান এবং তিনি চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য পাঠান। তবে সম্রাট সৈন্য পাঠাতে দেরি করায় বাহাদুর শাহ চিতোরের দুর্গ জয় করেন। ১৫৩৫ সালের ৮ই মার্চ রানী তার সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য জোহর ব্রত পালন করেনা এবং নিজেকে আগুনে আত্মহুতি দেন। এটি মধ্য সপ্তদশ শতকের লোকগাথা হিসেবে প্রচলিত আছে।
বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের কারণে ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ রাখী উৎসবটি প্রচলন করেছিলেন। উনিশ শতকে বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায় পৌঁছেছিল। ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার সিন্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৯ শে জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময় সারা ভারতের সব নেতা এই সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান ভাই ও বোনকে আহ্বান করেছিলেন। এই আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে তিনি একে ওপরের হাতে রাখী পরিয়ে দিতে বলেন। প্রতিবাদস্বরূপ উৎসব পালন করেন। তিনি তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই দিন প্রতিবাদস্বরূপ কোনো বাড়িতে উনুন জ্বালানো হয়নি।
রাখীবন্ধন একটি জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। দামি, কম দামি, রঙিন রাখীর নিচে ঢাকা পড়ে যায় আমাদের দীনতা, আমাদের লজ্জাবোধ। একটা সুতোর মারফত আমরা আমাদের সব কিছু ঢেকে সৌভাতৃত্বকে সামনে তুলে আনতে চেষ্টা করি। গড়ে তুলি সৌহার্দ্যের বন্ধন।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ০২-০৮-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
তারিখ : ০২-০৮-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment