Monday, March 14, 2022

বইমেলা ও নতুন লেখক

বইমেলা ও নতুন লেখক 


সুদীপ্ত মুখার্জী 





মেলা কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল মিলনোৎসব। বহু শতক ধরে সভ্যতার ঐতিহ্যকে  বহন করে চলেছে  মেলা । মেলাতে মানুষ একে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করে থাকে। বইমেলা হল বইয়ের মহোৎসব।বইমেলা একটা স্বতন্ত্র প্রকৃতির মেলা যা বইকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক মিলন ক্ষেত্র।  যেটা  প্রকাশক, পাঠক ও লেখকদের মিলনোৎসব। বইমেলাতে পরস্পরের অর্থাৎ প্রকাশক, পাঠক ও লেখকের যোগাযোগ স্থাপন ও ভাব বিনিময় হয় বইয়ের মাধ্যমে। প্রকাশকরা তাদের প্রকাশিত নতুন ও পুরানো বইযের সম্ভার নিয়ে এখানে দোকান সাজিয়ে তোলেন। পাঠকরা নানা রকম বইয়ের সম্ভার থেকে  পছন্দের বইটা সংগ্রহ করে নেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  বলে গিয়েছিলেন 'বই হলো অতীত ও বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো'।  বই ছাড়া শিক্ষিত জ্ঞান পিপাসু মানুষের জীবন প্রায় অচল বলা চলে। বই মানুষের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার নির্ভরযোগ্য উপাদান বলা চলে। ইরানের বিখ্যাত  কবি ওমর খৈয়াম বলেছিলেন  'রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে,  বই, সেতো অনন্ত যৌবনা'। এই অনন্ত যৌবনা বইগুলোর সন্ধান বইযের মহোৎসবেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। বইমেলা আজ আমাদের ঐতিহ্যের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বইযের এই উৎসবেই যেন বাঙালি অবগাহন করে পুণ্যস্নানে। 

গত ৮ই নভেম্বর ২০২১ সরকারের তরফ থেকে  ২০২২ সালের 'কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা' হবে বলে জানানো হয়। তবে অবশ্যই যাবতীয় বিধি মেনে। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে মেলাটি করা হবে।করোনা অতিমারীর কারণে গতবার মেলার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তাই বইপ্রেমীদের মন একদম ভালো ছিল না। শুধু বইপ্রেমী কেন প্রকাশকদের ও লেখকদের মনও ভালো ছিল না। প্রকাশকরা আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। তাই প্রকাশক, লেখক ও পাঠক সকলেই এই খবরে খুবই উল্লসিত হয়ে ওঠে। অনেক আক্ষেপ, অনেক হতাশা, অনেক অপেক্ষার যেন অবসান হল। 

আমরা জানি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন বইমেলাটি  প্রতিবছর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কলকাতার মেলাটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা বলা হয়।  প্রতিবছর আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও 'অমর একুশ গ্রন্থমেলা' বলে একটা বইমেলার আয়োজন করা হয়। আমাদের তিলোত্তমার মেলাটি  প্রায় ৫০ বছরের একটা মেলা।  প্রতি বছর মেলাটি সুবিশাল আকারে আয়োজিত হয়। মেলাটা প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের গন্ডী ছাড়িয়ে আজ একটা সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। 


কলকাতা শহরে প্রতিবছর নিয়ম করে পাবলিশার্স ও বুক সেলার্স গিল্ড আয়োজন করে থাকে একটা  আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই মেলাটি সর্বপথম ১৯৭৬ সালের ৫ই মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা ময়দান এলাকাতে। তখন অবশ্য নাম ছিল 'কলকাতা পুস্তকমেলা'। বিশিষ্ট প্রকাশকরা মেলাটির আয়োজনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। সেই সময় মেলাটি অবশ্য আন্তর্জাতিক মেলায় পরিণত হয়নি। ১৯৮৪ সালে মেলাটি প্রথম আন্তর্জাতিক মেলায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে যেমন মেলার আয়তন বৃদ্ধি পায়  তেমন জনসমাগমও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭৮ সালে আয়োজিত তৃতীয় বইমেলা থেকে মেলাটি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি ১৯৮৩ সালের মেলায় একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এসে একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের প্রাক্তন সম্পাদক অশোক কুমার সরকার মহাশয় মেলা প্রাঙ্গনেই অসুস্থ হয়ে প্রয়াত হন। ১৯৮৪ সাল থেকে প্রতিবছর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে 'অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তিতা'র আয়োজন করা হয়। এই বছরেই মেলাটি জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স এসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে বইমেলার আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে স্থান করে নেয়। ১৯৯৭ সাল কলকাতা পুস্তক মেলার একটা স্মরণীয় বছর হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এই বছর  মেলার থিম ছিল 'ফ্রান্স'। তারপর থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের নামে থিম করা হয়ে থাকে। সেই বছরই এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুরো মেলাটি অগ্নিদগ্ধ হয়ে যায়। প্রচুর ক্ষতি হয় ও কয়েকজন দর্শনার্থীর মৃত্যুও হয়। ২০০১ সালে 'কলিকাতা পুস্তকমেলা' নামটি পরিবর্তন করে 'ক্যালকাটা বুক ফেয়ার'  রাখা হয়। পরিবেশের কারণে ২০০৭ সালে মেলাটি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে,  ২০০৮ সালে পার্ক সার্কাস ময়দানে ও ২০০৯ সালে মিলনমেলা প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। এই বছর থেকে 'কলিকাতা বুক ফেয়ার' নামটি আবার পৰিবৰ্তন করে করা হয় 'আন্তর্জাতিক কলিকাতা বইমেলা'। মিলনমেলা প্রাঙ্গনটি মেরামত করার জন্য বর্তমানে মেলাটি বিধানগরের সেন্ট্রাল পার্কে আয়োজিত হচ্ছে। এই মেলায় গ্রন্থসম্ভারের পাশাপাশি চিত্রশিল্পী, খাবার, তথ্য প্রযুক্তি ও লিটিল ম্যাগাজিনের জন্য আলাদা স্থানের ব্যবস্থা করা হয়।  

কলকাতা বইমেলায় বই ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠান। বইমেলাতে প্রতিবছর নিয়ম করে বহু লেখকের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বই প্রকাশে বেশিরভাগ প্রকাশক প্রাধান্য দিয়ে থাকেন পুরানো ও খ্যাতনামা লেখকদের। পরিচিতির আড়ালে থাকা স্বগুণ থাকা স্বত্তেও বহু নতুন লেখক বা কবি আড়ালেই থেকে যান । লক্ষ্য করলে দেখা যায় খ্যাতনামা পরিচিত লেখকের বা কবির বই এই ধরনের মেলায় হু হু করে বিক্রি হয় কিন্তু নতুনদের পরিচিতি না থাকায় তাদের লেখা বইয়ের বিক্রী সেরকম হয় না। তাই প্রকাশকরা নতুনদের লেখা যতই ভালো হোক তাঁদের কাছে নতুনদের  সেরকম কোনো গুরুত্ব থাকে না। নতুন লেখকদের মধ্যে  অনেকের  ভালো ভালো লেখা শুধুই তাঁদের খাতায় বন্দী হয়ে রয়ে যায়।  প্রকাশকের অভাবে পাঠকের কাছে তা আর পৌঁছতে পারেনা। খ্যাতনামা পরিচিত লেখকদের ভিড়ে হারিয়ে যায় অপরিচিত খ্যাতিহীন লেখকরা। কালের গর্ভে  ধীরে ধীরে বিলীন  হয়ে যায় তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা। থেমে যায় এইসব নবীনদের কলম। তাঁদের মেধা ও মনন দিয়ে যে ভাবনার জন্ম তাঁরা দিয়েছেন তা আর পৌঁছয় না পাঠক মহলে। 



বইমেলা যেমন খ্যাতনামা লেখকদের সঙ্গে প্রকাশক ও পাঠকের গাঁটছড়া বাঁধতে সহায়তা করে তেমন নবীন লেখকদের সাথেও প্রকাশকদের ঐকান্তিক চেষ্টায় পাঠকদের মিলনক্ষেত্র হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রকাশকদের লাভের অংশ একটু কম হবে। লাভের অংশ একটু কমিয়ে দিয়ে প্রতি বছর তাঁদের কয়েকজন নতুন লেখক ও কবির লেখাকে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করা উচিত। তবে অবশ্যই তা ভালো বিষয় ও  ভালো লেখা হতে হবে।

আজকাল আবার শোনা যায় নামী-অনামী বহু প্রকাশকের প্রবণতা নাকি নতুন লেখক অর্থাৎ অনামী লেখকদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে বই প্রকাশের কথা। এই ধরণের ঘটনা ঘটে কিনা আমার ঠিক জানা নেই। তবে এই ধরণের ঘটনা যদি সত্যি ঘটে থাকে সেটা অবশ্যই কাম্য নয়। অর্থের বিনিময়ে বই প্রকাশের এই সংস্কৃতি পাঠকদের কাছ থেকে নতুন লেখককে দূরে সরিয়ে দেবে। একজন লেখক হলেন মেধার পরিবেশক। তাই প্রকাশকদের লেখককে গুরুত্ব না দিয়ে অবশ্যই লেখাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নতুন লেখকদের কাছে সবটাই হতাশা নয়, কিছু প্রকাশক ভালো লেখাকে নিশ্চয় প্রাধান্য দিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কোনো লেখক যদি সত্যি ভালো লিখে থাকেন তাহলে সেই প্রতিভা কখনোই চাপা থাকবে না, একদিন তা পাঠকদের হাতে নিশ্চিতভাবে পৌঁছবে। খ্যাতনামা লেখকদের পাশাপাশি নতুন বা অপেক্ষাকৃত নতুন লেখকরা কতটা উঠে আসতে পারছে সেইদিকে সরকার ও মেলা কর্তৃপক্ষেরও  তীক্ষ্ণ নজর রাখা উচিত। 



কিছু লোকের ধারণা নতুন প্রজন্মের বইয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।  তারা তাদের অবসর সময়টা ফেসবুকে ও হোয়াটস্যাপে কাটাতে নাকি বেশি ব্যস্ত থাকে। একথা কিছুটা মেনে নিলেও লক্ষ্য করলে বহুক্ষেত্রে দেখা যায় এটা সঠিক নয়। নতুন প্রজন্ম টেক সেবি।  তারা এখন সব কিছুই অনলাইনে কিনতে অভ্যস্থ। তাদের বেশিরভাগের হাতে অত সময় থাকেনা যে তারা কলেজে স্ট্রীটে গিয়ে বা অন্য কোনো জায়গায় গিয়ে বই কেনার। তাই তাদের জন্যই গড়ে উঠেছে ভার্চুয়াল বইমেলা। শুধু নতুন প্রজন্ম নয় আজকাল  বয়স্করাও অনলাইনে বই কিনতে ধীরে ধীরে অভস্থ্য  হয়ে পড়ছে।  কচিগুলো আবার এখন বাংলা পড়ে  না, তারা সব ইংরেজিতে পড়তে অভ্যস্থ। ইংরেজিতে পড়লেও তারা হ্যারি পটার বা টিনটিনের ইংলিশ ভার্সান মোবাইলে পড়ে বেশি আনন্দে পায়। পূর্বের মতো ক্ষীরের পুতুল, নীলকমল-লালকমল আর তাদের টানে না। এছাড়া রহস্য, ভিনগ্রহের প্রাণী, অলৌকিকতা সম্বন্ধীয় বই যুবক-যুবতীদের বরাবরই টানতো। এখনো এই ধরণের বইয়ের বেশ ভালো বিক্রি আছে।  বইয়ের চাহিদা  হয়ত কিছুটা কমলেও বিক্রি কিন্তু বেশ ভালোই হচ্ছে। যদি সেরকম বিক্রি না হতো তাহলে যেমন  নতুন নতুন প্রকাশক গজিয়ে উঠতনা তেমন নতুন নতুন অনলাইন বিক্রেতাও আসতো না।  

এবছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবর্ষ। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর এবং ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর সুবর্ণজয়ন্তীর কথা মাথায় রেখে এবারের মেলার থিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে মনোনীত করা হয়েছে।  আশাকরি  করোনা অতিমারী পর্ব পেরিয়ে এবছরের আয়োজিত বইমেলা তার  নিজস্ব ছন্দ ফিরে পাবে। তার পুরানো ঐতিহ্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে। তবে অবশ্যই সবাইকে  গিল্ডের ও সরকারের দেওয়া করোনাবিধিকে মেনে চলতে হবে।   
 



তারিখ :১৪-০৩-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




No comments: