এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ শিব লিঙ্গ
সুদীপ্ত মুখার্জী
কলকাতা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে নদীয়া জেলায় মাজদিয়া নামে একটা ছোট্ট গ্রাম রয়েছে। গ্রামটির পরিচয় বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে অজানা। এই গ্রামে গেলে দেখা মিলবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ শিবলিঙ্গের। শিবনিবাস বাংলার ইতিহাস খ্যাত ও পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এক প্রাচীন স্থান। কেউ কেউ শিবনিবাসকে পশ্চিমবঙ্গের কাশী বলে থাকে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় এই অঞ্চলে বহু প্রাচীনকালে নসরৎ খাঁ নামে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত বাস করতো। সেই ডাকাতের নাম থেকেই অঞ্চলটির নাম হয়েছিল নসরৎ বেড়। নসরৎ ডাকাতের উৎপাতে অঞ্চলের সকলেই অত্যাচারিত হত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই ডাকাতকে দমন করার জন্য মাজদিয়ার জঙ্গলে উপস্থিত হন। সেই ডাকাতকে দমন করার পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র পরদিন সকালে নিকটবর্তী নদীতে মুখ ধুতে গেলে নদীর স্রোতে ভেসে আসা একটা রুই মাছ লাফিয়ে মহারাজার পায়ের ওপর এসে পড়ে। এই ঘটনায় মহারাজার এক আত্মীয়ের কাছে ঘটনাটা খুব শুভ বলে মনে হয়েছিল। বাংলায় যখন বর্গী আক্রমণ ঘটেছিল সেই সময় মহারাজ সাময়িকভাবে তাঁর রাজধানীকে মাজদিয়ায় সরিয়ে নিয়ে আসেন। কেউ কেউ বলে থাকেন মহারাজ তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরকে বর্গীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। মহারাজ এই স্থানে একটি শিব মন্দির স্থাপন করেন। তিনি মন্দিরে কষ্টিপাথরের নির্মিত একটা সুবিশাল শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা করেন।
১৭৫৪ সালে অর্থাৎ ১৬৭৬ শকাব্দে মাজদিয়ায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি রাজ রাজেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত হয়। কথিত রয়েছে, মহারাজ তাঁর প্রথম স্ত্রীর জন্য নাকি এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
মন্দিরটি একটা উঁচু ভিত্তিবেদীর ওপর স্থাপিত। মন্দিরটি আটকোনা। খাড়া দেওয়ালের প্রতি কোনায় মিনার ধরণের আটটি থাম রয়েছে। মিনার বিশিষ্ট এই মন্দিরটির চূড়া সমেত উচ্চতা ১২০ ফুট। মন্দিরের সুউচ্চ চূঁড়াটি নদীর ঘাট থেকে দেখতে পাওয়া যায়। প্রবেশদ্বারে খিলান ও অবশিষ্ট দেওয়ালে একই আকৃতির ভরাট করা নকল খিলান পরিলক্ষিত হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ যার উচ্চতা ৯ফুট এবং প্রস্থ ২১ ফুটের মতো। এই সুউচ্চ শিবলিঙ্গের নাম রাজ্ রাজেশ্বর। গর্ভগৃহে ঢুকে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তবে দেবাদিদেব মহাদেবের মাথায় জল বা দুধ ঢালা যায়। ভক্তরা একদিকের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে জল বা দুধ ঢালে আর অন্যদিকের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেবমুর্তিকে প্রদক্ষীণ করে থাকে। গ্রামবাসীরা অবশ্য এই মন্দিরটিকে বুড়ো শিব মন্দির বলে থাকে। এই মন্দিরের ছাদ ঢালু এবং গম্বুজ রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী বাঙালি কাঠামো অনুসরণ করে এটা নির্মিত না। এই মন্দিরে যেমন রয়েছে পোড়ামাটির কাজ তেমন রয়েছে ইসলামিক ও গোথিক কাজের নিদর্শন।
এই অঞ্চলে মহারাজ সেই সময় নাকি ১০৮টি শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যা কালের গর্ভে আজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে পাশাপাশি তিনটি মন্দির দেখা যায় রয়েছে। রাজ্ রাজেশ্বর মন্দিরের পূর্ব দিকে রয়েছে চার চালা বিশিষ্ট একটি (দ্বিতীয়) মন্দির। মন্দিরটির নাম রাঙ্গীশ্বর মন্দির। এই মন্দিরটির উচ্চতা ৬০ ফুট। এই মন্দিরটির ভিতরে রয়েছে ৭ ফুট উচ্চতার শিবলিঙ্গ। এই মন্দিরটির পাশে দেখা যায় রাম-সীতার মন্দির। এই মন্দিরটিও ১৭৪৩ সালে মহারাজ তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেছিলেন। পশ্চিমমুখী মন্দিরটি ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। এই মন্দিরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কালো কষ্টিপাথরের রামচন্দ্র, অষ্টধাতুর নির্মিত দেবী সীতা ও শ্রীরামচন্দ্রের অনুজ লক্ষণ।
এখানে সারাবছর দর্শনার্থীদের দেখা মিললেও শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার এখানকার শিবলিঙ্গে জল ঢালার জন্য লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয়। প্রতি বছর ভীম একাদশীতে এখানে মেলা বসে এবং তা চলে শিবরাত্রি পর্যন্ত। শিবনিবাস মন্দিরে যাওয়ার জন্য পথে পরে চূর্ণী নদী। চূর্ণী নদীর উপর বাঁশের তৈরী একটা সাঁকো রয়েছে। সাঁকোটা পার হয়ে মন্দিরে যেতে হয়। এই সাঁকো ও তার আশপাশ অঞ্চলটি খুবই মনোরম। ছবি তোলার জন্য খুবই আদর্শ।
পূর্বেই বলেছি শিবনিবাসকে বাংলার কাশী বলা হয়, যদিও এখানে কাশীর মতো গঙ্গা নদী বয়ে যায় না, এখানে মন্দিরের পাশ দিয়ে চূর্ণী নদী প্রবাহিত হয়।
কিভাবে যাবেন : শিয়ালদহ থেকে গেদে লোকাল ধরে মাজদিয়া স্টেশানে পৌঁছান। সময় লাগবে আড়াই ঘন্টা। স্টেশান থেকে টুকটুকি (টোটো) গাড়ি করে শিবনিবাস গ্রামে চলে আসুন । ভাড়া নেবে ১০ থেকে ১৫ টাকা।এখান থেকে পায়ে হেঁটে একটা বাসের সাঁকো পার হয়ে যেতে হবে। এই সাঁকো পার হওয়ার জন্য যাওয়া ও আসার ভাড়া জন প্রতি ৪ টাকা লাগবে।
তারিখ :-২৭-০৪-২০২২
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
2 comments:
Mondirtarsombhomdhe jantam na jene khub bhalo laglo
Very informative.
Post a Comment