Saturday, October 1, 2022

অকালবোধন>P

                               অকালবোধন 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 





দেবী দূর্গা  হলেন হিন্দুদের খুবই জনপ্রিয় দেবী। হিন্দুরা তাঁকে শক্তির দেবী হিসেবে মনে করলেও মাতৃজ্ঞানে  সম্মান করে।  পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের পত্নী পার্বতী। দেবী আবির্ভূত হন শক্তিরূপে। মহাশক্তি দূর্গা মহাবিশ্বের অধীশ্বরী। সুপ্রাচীন কাল থেকেই মায়ের মৃন্ময়ী রূপকে চিন্ময়ী জ্ঞানে আমরা আরাধনা করে আসছি। 

দেবীপূজার মহাক্ষণ আসন্ন।  দশপ্রহরণধারিনী দেবী একাধারে  আমাদের জননী আবার কন্যাও।  দেবীকে নিয়ে আমাদের কত মান-অভিমান। পরমাশক্তি দেবী দূর্গা একদিকে রণরঙ্গিনী ও ভয়ঙ্করী এবং অন্যদিকে প্রসন্ন ও বরদায়িনী। একাধারে রনংদেহি মূর্তি ফুটে ওঠে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমায় আবার অন্যধারে তাঁর চোখ থেকে বর্ষিত হয় করুণাধারা।  পূরাণের পাতা ওল্টালে দেখা যায় যেমন তত্ত্বের বর্ণচ্ছটায় দেবী মাহাত্বের কথা তেমন ইতিহাসের পাতায়  বর্ণিত আছে উৎসবের পরম্পরায় তাঁর আরাধনার কথা। ভারত তথা বিশ্বে  বৎসরান্তে হয় তাঁর আগমন, আগমনী গানে তাঁর পূজার আয়োজন। আমাদের জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। 

বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ পার্বণ হল শরৎকালের দুর্গাপূজা। এতো শুধু পূজা নয় - এতো মহাযজ্ঞ। আমাদের দেশে বছরে দুই বার দুর্গাপূজা করা হয়। একবার শীতের পর বসন্তকালের চৈত্র মাসে আর একবার বর্ষার অন্তে শরৎকালের আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষে।  রাজা সুরথ বসন্তকালে  প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। শ্রী শ্রী চন্ডীতে রাজা সুরথের নাম  মর্ত্যে  দেবী দুর্গার প্রথম পূজারী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। বসন্তকালে যে পূজা করা হয় তাকে দুর্গাপূজা না বলে 'বাসন্তী পূজা' নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এই পূজা অনেক জায়গায় বারোয়ারি পূজা হিসেবে করা হয়। অল্প কিছু  বাড়িতেও বাসন্তী পূজা করার চল রয়েছে।  

শরৎকালে দূর্গা মায়ের আরাধনাকে দুর্গাপূজা বলা হয়।  যেহেতু পূজাটি শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় তাই অনেকে 'শারদোৎসব' বলে থাকে। শরৎকালের এই পূজাটি সমাজে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি  লাভ করেছে।  পূজাটিকে অকালবোধন বলা হয়।  রাবণ বধের পূর্বে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে অর্থাৎ অ-কালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন। 

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভে অকালবোধন  অনুষ্ঠিত হয়।  বোধন শব্দটির অর্থ হল জাগরণ বা জাগানো।  বিখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় অতুল সুর মহাশয় বলে গেছেন - 'দুর্গাপূজাই বাঙালির সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। শরৎকালে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় বলে একে শারদীয়া পূজা বলা  হয়।  আষাঢ়  থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত দেবতাদের নিদ্রাকাল এবং এই অসময়ে দেবীর পূজা করা হলে বোধন করা  হয় বলে একে অকালবোধনও বলা হয়। কথিত যে, পুরাণ অনুযায়ী রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় রামের প্রতি দেবীর অনুগ্রহ আকর্ষণ করবার উদ্দেশ্যে  ব্রহ্মা দেবীর বোধন করেছিলেন।  কৃত্তিবাসী  রামায়ণ অনুযায়ী রাম নিজেই যুদ্ধের পূর্বে দেবীর বোধন করেছিলেন, বাল্মীকির রামায়ণে কিন্তু এসব কথা কিছু নেই। মহর্ষি  বাল্মীকি তাঁর রচিত সংস্কৃত রামায়ণে সূর্য্য ও অন্যান্য দেবতাদের পূজার কথা বলেছিলেন।  ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা বাল্মীকি রামায়ণের অনুকরণে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁর রচিত রামায়ণে শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের দেবীপূজার কথা উল্লেখ রয়েছে।  বাংলা রামায়ণে কবি কৃত্তিবাস শ্রীরামচন্দ্রের দেবীপূজা সম্বন্ধে বলেছেন - 

                                               "বিধাতা কহেন প্রভু এক কর্ম কর বিভু 
                                                          তবে হবে রাবণ-সংহার। 
                                               অকালবোধন করি পূজা দেবী মহেশ্বরী 
                                                         করিবে হে ঐ  দুঃখ-পাথর।"

কবিচিত্তের কল্পনায় বীর হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করলেন, কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র একে একে ১০৭ টি পদ্ম মাতৃচরণে অঞ্জলি দিলেন। কিন্তু দেবী ছলনা করে একটি পদ্ম সরিয়ে রাখলেন। শ্রীরামচন্দ্র যখন ধনুর্বান দিয়ে নিজের একটি চক্ষু উৎপাটন করে মাতৃচরণে অঞ্জলি দিতে উদ্যত হলেন  ঠিক সেই সময় দেবী সহাস্যে তাঁকে  নিবৃত্ত করলেন। দেবীপূজা সমাপ্ত হল এবং শ্রীরামচন্দ্র দশাননকে  বধ করলেন। তবে প্রজাপতি ব্রহ্মার পরামর্শে ও সাহায্যেই তিনি দেবীকে ঘুম থেকে তুলে পূজা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি শরৎকালে দেবীকে জাগরণ পূর্বক তাঁর পূজা সম্পন্ন করে রাবণ বধে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বীয় পত্নীকেও লাভ করেছিলেন। 

বাংলা সনাতন বর্ষপঞ্জি অনুসারে একটি বছরকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটির একটি হল উত্তরায়ণ আর অপরটি হল দক্ষিণায়ন।  সূর্য যখন পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে উত্তরায়ণ কাল বলা হয় আর সূর্য যখন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে উত্তরায়ণ কাল বলা হয়। আর সূর্য যখন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে দক্ষিণায়ন কাল বলা হয়। মহাকবি কৃত্তিবাস তাঁর রচিত রামায়ণে বলে গেছেন বাংলা বর্ষপঞ্জির মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এবং  আষাঢ় এই ছয় মাস হলো উত্তরায়ণ কালের অন্তর্গত।  বাকি ছয় মাস হল দক্ষিণায়ন কালের অন্তর্গত। এই ছয় মাস হল শ্রাবণ, ভাদ্র, অশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, ও পৌষ। 

উত্তরায়ণ কালে দেব-দেবীরা  জাগ্রত থাকেন।  এই সময়টাই দেবী আরাধনার প্রকৃত সময়।  তাই উত্তরায়ণ কালে দেবী আরাধনা করা হলে দেবীকে জাগাতে হয় না।  রাজা সুরথ বসন্ত কালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন, যা বাসন্তী পূজা হিসেবে পরিচিত। তাই বাসন্তী পূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।  অপরদিকে দক্ষিণায়ন কালের সময় দেব-দেবীদের নিদ্রার সময়। এই সময় পূজা করা হলে দেব-দেবীদের প্রথমে বোধন অর্থাৎ জাগ্রত করতে হয়। তারপর মূল পূজা শুরু হয়।  

শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের কথা শুধু কৃত্তিবাসী রামায়ণের পাওয়া যায় তা নয়, অকালে দশভূজার আবির্ভাবের  বিবরণ কয়েকটি পুরাণে পাওয়া যায়।  অকালবোধনই বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। শরতে প্রকৃতির মনোমোহিনী রূপের মধ্যে আগমন ঘটে মা দুর্গার।  দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, পাড়ায় পাড়ায়  শুরু হয় দেবীর অকালবোধন। হানাহানি, রেষারেষি ভুলে সবাই উৎসবের মেতে ওঠে। 




তারিখ :-০১-১০-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।