Friday, January 13, 2023

গঙ্গাসাগরের ইতিহাস ও মাহাত্ম্য 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 



সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার।  এই প্রবাদটি  বর্তমানে অতীত। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন গঙ্গাসাগরে মানুষকে  বারে  বারে  যেতে দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে  অতিমারীর কথা মাথায় রেখে প্রশাসন একাধিক নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। সকলেই অঙ্গীকারবদ্ধ মেলাকে প্লাস্টিকবর্জিত, পরিবেশবান্ধব ও দূষণমুক্ত করে তুলতে। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি উৎসবের দিন। অতি প্রাচীন কাল থেকেই বহু মুনি-ঋষি ও সাধুসন্তরা এই বিশেষ দিনে সাগরদ্বীপে এসে গঙ্গাস্নান  করে পরম পুন্য ও তৃপ্তি লাভ করে চলেছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে গঙ্গাসাগর মেলা দ্বিতীয় বৃহত্তর মেলা হিসেবে পরিচিত।  কুম্ভ মেলাকে সর্ববৃহৎ মেলা হিসেবে গণ্য করা হয়। 

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ সীমান্তে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে রয়েছে  সুবিস্তৃত সুন্দরবন।  এই সুন্দরবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল সাগরদ্বীপ।  সাগরদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে সর্বজনের পরিচিত পুণ্যভূমি মহাতীর্থ গঙ্গাসাগর।  সম্মুখ ভাগে দিগন্তবিস্তৃত বিশাল সমুদ্র আর পশ্চাতে শ্যামল বনানী, উর্দ্ধে অনন্ত নীলাকাশ আর নিম্নে বালুকাবিস্তৃত বেলাভূমি।  প্রতি বৎসর  পৌষসংক্রান্তিতে এখানে মকর স্নানের মেলা বসে।  কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সর্বত্রই সারা পড়ে  যায়।  সাগরসঙ্গমে ছুটে আসতে  দেখা যায় দেশের পুন্যকামী মানুষদের। সারা বৎসর অবহেলায় পড়ে  থাকা বেলাভূমি এইসময় মুখরিত হয়ে ওঠে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর সমাগমে।  নির্জন বেলাভূমি পরিণত হয় মহামেলায়।  এই মহামেলার পশ্চাতে আছে এক পৌরাণিক কাহিনী।  

অতি প্রাচীনকালে ইক্ষাকুবংশে সগর নামে এক ধার্মিক রাজা অযোধ্যায় রাজত্ব করতেন। তাঁর দুই পত্নী ছিলেন - কেশননি ও সুমতী। কঠোর তপস্যার ফলে সগর রাজা মহাদেবের বরে কেশনির গর্ভে অসমঞ্জ আর সুমতীর গর্ভে ষাট হাজার সন্তান লাভ করেন। মহারাজ সগর একবার বশিষ্ঠাদি ঋষিগণের ব্যবস্থানুসারে এক অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করেন। প্রাচীনকালে সকল যজ্ঞের মধ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞই প্রধান ছিল।  ভারতের শ্রেষ্ঠ নৃপতিগণ সার্বভৌমত্ব  প্রতিষ্ঠার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ  করতেন। নিরানব্বইটি যজ্ঞ সুসম্পন্ন করার পর  অতি  সুলক্ষণ বিশিষ্ট একটি বিশেষ রঙের  অশ্বের  কপালে জয়পত্র বেঁধে তাকে ছেড়ে দেওয়া হত।  অশ্বটির  রক্ষণের জন্য নৃপতিগণ সসৈন্যে তাকে অনুসরণ করতো।  এক বৎসর পর অশ্বটি  যদি বিনা বাঁধায় ফিরে আসে তাহলে শাস্ত্রানুসারে তাকে বধ করে তার  মাংস খন্ড যজ্ঞে আহুতিরূপে প্রদান করা হত। তারপর অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হত।  সগররাজ যজ্ঞাশ্বটিকে  ছেড়ে দিলেন। অশ্বটির  রক্ষনাবেক্ষনের জন্য তাঁর ষাট হাজার সন্তানকে সাথে প্রেরণ করলেন।  প্রতাপশালী সন্তানগণ অশ্বসহ মহাসমারোহে ভারত ভ্রমণ করতে থাকেন।  সগর তনয়দের প্রতাপ দেখে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর ক্ষমতা হারানোর আশংকা করতে লাগলেন।  তিনি রাক্ষসের মূর্তি ধারণ করে যজ্ঞাশ্বটিকে অপহরণ করে সমাধিমগ্ন মহামুনি কপিলের আশ্রমের পিছনে বেঁধে রাখলেন।

মহামুনি কপিল ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ ঋষি।  প্রজাপতি কর্দমের ঔরসে ও দেবহুতির গর্ভে বিন্দুসরোবরের তীরে ইনি  জন্মগ্রহণ করেন।  ইনি পঞ্চবিংশতি তত্ত্বাত্মক সাংখ্যদর্শন প্রণেতা।  মাতার অনুমতি অনুসারে একাগ্র তপস্যার জন্য মুনিঋষি কপিল ভারতের নানা স্থানে ভ্রমণ করে সাগর উপকূলে এসে উপস্থিত হন। এখানে সমুদ্র তাঁকে অর্ঘ্যস্বরূপ বাসস্থানের ভূমি দান করলে তিনি মহাযোগে নিমগ্ন হলেন।  

এদিকে মহারাজ  তাঁর পুত্রগণ ফিরে আসছে না দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।    তিনি তাঁদের সন্ধানে  বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন দিকে পাঠালেন। খুঁজতে খুঁজতে মহারাজ সগরের পুত্র অসমঞ্জ-এর  পুত্র অংশুমান  সাগরদ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমে এসে জানতে পারলেন যে মহারাজ সগরের  ষাট  হাজার পুত্র মারা গেছেন। তিনি মহা ঋষি কপিলদেবকে সন্তুষ্ট করলেন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন। তিনি মুনির কাছে জানতে চাইলেন কিভাবে  তাদেরকে ফিরে পাবে।  মুনি তাঁকে বললেন তুমি যদি পতিতপাবনী  গঙ্গা দেবীকে  আনয়ন করতে পারো তাহলে গঙ্গার সংস্পর্শে তারা  উদ্ধার লাভ করবে। অংশুমান এই খবর নিয়ে  অযোধ্যায় ফিরে মহারাজ সগরের কাছে তাঁর বংশ ধ্বংসের বিবরণ ও উদ্ধারের উপায়স্বরূপ গঙ্গা আনয়নের বিবরণ দেন।  সগর সব শুনে তিনি গঙ্গাকে আনয়ন  করার জন্য নিজে  গেলেন এবং ব্যর্থ হলেন। তাঁর পৌত্র অংশুমান ও অংশুমানের পুত্র দিলীপ গিয়ে ব্যর্থ হলেন।  অবশেষে  ভগীরথ হিমালয়ে মহাদেবের তপস্যা  করতে লাগলেন। দিলীপের দুই পত্নী ছিল সুজাতা ও সুমতি। রাজার অভাবে  অযোধ্যায় অশান্তির সৃষ্টি হতে লাগলো।  সেইসময় মহাদেবের বরে দিলীপের স্ত্রী সুজাতা গর্ভবতী হন।  তাঁর প্রসবের পরে পুত্রের বদলে একটি মাংসপিন্ড পাওয়া যায়।  তিনি দুঃখে সরযূ নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিতে যান।  মহামুনি বশিষ্ঠের আদেশে    তিনি সেই মাংসপিন্ডটিকে সরযূ নদীতে শায়িত করে রাখেন।  অষ্টাবক্র মুনির আশীর্বাদে ওই মাংসপিন্ডটি একটি সুন্দর রাজপুরুষের আকার ধারণ করে। তাঁর  নাম হয় ভগীরথ। 

  ভগীরথের  কঠোর তপস্যায় দেবাদিদেব মহাদেব সন্তুষ্ট হলেন। তাঁর নির্দেশে ও ব্রহ্মর আশীর্বাদে ভগীরথ গঙ্গার সন্ধান পান।  গঙ্গা ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মলোক থেকে তাঁকে অনুগমন করেন।  কৈলাশ পর্বত থেকে ভূপৃষ্ঠে অবতরণকালে দেবাদিদেব মহাদেব গঙ্গার প্রবল ধারা তাঁর  জটার মধ্যে ধারণ করলেন। ভগীরথের তপস্যায় প্রীত হয়ে মহাদেব গঙ্গাকে জটমুক্ত করেন।  গঙ্গা প্রবাহিত হতে  লাগলো। তাঁর তীরে বিভিন্ন তীর্থস্থান গড়ে উঠতে লাগলো। অগ্রসর হতে হতে অবশেষে পতিতপাবনী গঙ্গা সাগরসঙ্গমে মহামুনি কপিলের অশ্রমের নিকট উপস্থিত হলে  তাঁর পবিত্র সলিল স্পর্শে  সগর বংশ  সাপ মুক্ত হয়। পরবর্তীকালে এখানে কপিল মুনির মন্দিরটি গড়ে ওঠে।  মন্দিরটি নদীগর্ভে বহুবার তলিয়ে গেছে।  বর্তমান মন্দিরটি ১৯৭৩ সালে নতুন করে নির্মিত হয়। 

 গঙ্গা হল ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গঙ্গা পতিতপাবনী।  মুক্তিদাত্রী। মানুষ যে কোনো  পাপ করুক অন্তিম সময়ে গঙ্গাস্নানে সমস্ত পাপ বিদূরিত হয় বলে  বিশ্বাস। দেহান্তে তার আত্মা স্বর্গগামী হয়।  এই মহাতীর্থে পৌষ সংক্রাতির দিনে স্নান করলে সর্বপাপ ক্ষয় হয়।

 বর্তমানে গঙ্গাসাগর দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩০০ বর্গ  কিলোমিটার। যাত্রাপথ পূর্বের মতো একদমই দুর্গম নয়, বেশ সুগম। লক্ষ লক্ষ সাধু-সন্ত ও তীর্থযাত্রী বছরের পর বছর মেলার সময় ছুতে আসেন। তবে এখন সারাবছর সাগরদ্বীপে পর্যটকদের একটা সমাহার দেখা যায়।   সাগরসঙ্গমে পুণ্যার্থী যাত্রীগণ স্নান-তর্পনের পর কপিলমুনি, সগররাজা, পতিতপাবনী গঙ্গা ও রাজপুরুষ ভগীরথের  বিগ্রহ দর্শন এবং অর্ঘ্য ও অঞ্জলি দেওয়ার জন্য তীর্থযাত্রীরা  কাতারে কাতারে মন্দির প্রাঙ্গনে জড়ো  হন। এই সময় সারা দেশ থেকে প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ্য পুণ্যার্থীর সমাগম হয়ে থাকে। তাদের জন্য সরকার প্রচুর পরিমাণে  অস্থায়ী আস্তানা তৈরী করে দেয়। হোগলার তৈরী যে অস্থায়ী আস্তানাগুলো গড়ে ওঠে তাতে অগ্নিনিরোধক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। মেলা প্রাঙ্গণ  জুড়ে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। মেলার পূর্বে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সব কিছুর আয়োজন করা হয়।  এই সময় সাগরদ্বীপে বেশ বড়  মেলা বসে, বিভিন্ন স্থানে সারা রাত  ধরে নানারকম ভক্তিমূলক গান পরিবেশন করা হয়। কোথাও কোথাও আবার ভক্তিমূলক চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। 

কুম্ভমেলা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।  ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্বে গঙ্গাসাগর মেলা অভিনব। যদিও এই মেলাটি এখনো জাতীয় মেলার স্বীকৃতি পায়নি। মেলার ঐতিহ্য, প্রাচীনত্ব এবং বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী ও পর্যটককে হাতিয়ার করে কলকাতার দুর্গাপুজোর মতো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে ইনট্যানজিবল হেরিটেজের তকমা পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।  ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি জুটলে সাগরদ্বীপের পর্যটন কলকাতার দুর্গাপুজোর মত আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে।

তারিখ :-১৪-১০-২০২৩

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 







No comments: