প্রতিরূপ
![]() |
মূল মন্দির |
১৮৪৭ সালে রানী রাসমণি দাস-দাসী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে কাশী যাত্রা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কাশীর মাকে দর্শন করা ও ভক্তিভরে মায়ের পুজো দেওয়া। কিন্তু যাত্রাপথে একদিন রাতে রানী স্বপ্নাদেশ পান যে "কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ভাগীরথীর তীরে একটা মনোরম পরিবেশে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করে পুজো ও ভোগের ব্যবস্থা কর, আমি নিজে আবির্ভূত হয়ে তোর কাছ থেকে নিত্যপূজা গ্রহণ করব"। ভক্তিপরায়ণা রানী এইরূপ আদেশ লাভের পর তাঁর কাশীযাত্রা স্থগিত করে দেন। তাঁর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিনি ১৮৫৫ সালে দক্ষিনেশ্বরে মা ভবতারিনীর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ।
রানীর কনিষ্ঠ জামাতা মথুরনাথ বিশ্বাসেরও বহুকালের ইচ্ছা ছিল কাশীতে গিয়ে শ্রী শ্রী বিশ্বেশ্বর ও মা অন্নপূর্ণার দর্শন ও ষোড়শ প্রচারে পুজো দেওয়ার। রানীর কাশী যাত্রা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় মথুরবাবুর বাসনা পূর্ণ হয়নি। তখন থেকেই তিনি দক্ষিনেশ্বরের কাছে দেবী অন্নপূর্ণার একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য মনে মনে বাসনা পোষণ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করে যেতে পারেননি। রানীর চতুর্থ কন্যা অর্থাৎ মথুরবাবুর সহধর্মিনী জগদম্বাদেবী মথুরবাবুর ইচ্ছাপূরণের ব্যবস্থা করেন। তিনি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অনুমতি নিয়ে ১৮৭৫ সালে গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চল চানকে মা অন্নপূর্ণার এক বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। অতীতের চানকই বর্তমানের ব্যারাকপুর। ব্যারাকপুরের তালপুকুর অঞ্চলের এই মন্দিরটি ১৮৭৫ সালের ১২ই এপ্রিল উদ্বোধন করা হয়। মন্দিরটি দক্ষিনেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের অনুকরণে তৈরী, ঠিক যেন তারই অবিকল এক প্রতিরূপ। তবে এই মন্দিরটি দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরের থেকে উচ্চতায় সামান্য বেশি আর দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে কিছুটা কম। মন্দিরটির পোশাকি নাম "শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির"।
ব্যারাকপুরের মন্দিরটি বঙ্গীয় স্থাপত্য শৈলীতে তৈরী নবরত্ন ধারার মন্দির। এক বিরাট তোরণের ভিতর দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করার পর দেখলাম পাশাপাশি নাটমন্দির ও মূলমন্দিরটি রয়েছে। এছাড়া নহবতখানাও আছে। মন্দিরটির পশ্চিমদিকে কিন্নরেশ্বর, কল্যাণেশ্বর, কামেশ্বর, কৈলাসেশ্বর, কপিলেশ্বর, ও কেদারেশ্বর নামে ছয়টি আট চালাবিশিষ্ট শিব মন্দির রয়েছে। প্রত্যেকটি মন্দিরে তিন ফুট উচ্চতার কালো রঙের শিব মূর্তি বিরাজ করছে। এই শিব মন্দিরগুলির ঠিক মাঝখানে গঙ্গা ঘাটে যাওয়ার একটা ছোট্ট দ্বার রয়েছে। গঙ্গার ঘাটটির নাম "রাসমণি ঘাট"। ঘাটের পাশে মহিলাদের সাজ বদলের জন্য একটা ঘর রয়েছে।
![]() |
মন্দিরে পঙ্খের কাজ |
![]() |
মন্দিরে পঙ্খের কাজ |
![]() |
প্রবেশের তোরণ |
মূল মন্দিরটি ইঁটের তৈরী উঁচু বেদীর ওপর স্থাপিত। মন্দিরটিতে ওঠার জন্য তিনদিকে সিঁড়ি রয়েছে। মন্দিরটির স্তম্ভগুলি খুবই সুন্দর। মন্দিরটির গায়ে সুন্দর পঙ্খের কাজ করা আছে। মন্দিরটির দ্বিতল ও ত্রিতলে সুন্দর খাঁজকাটা দেওলাকৃত নয়টি রত্ন রয়েছে। গর্ভগৃহে শ্বেতপাথরের বেদীর উপরে সম্পূর্ণ রুপোর তৈরী সিংহাসনে বেনারসি শাড়ি পরিহিতা অষ্টধাতুতে তৈরী মায়ের মূর্তিটি বিরাজ করছে। এখানকার দেবী সোনার অলংকারে ভূষিতা। মূর্তিটির বাম হস্তে অন্নপাত্র আর ডান হস্তে দর্বী রয়েছে। মূর্তিটির ডানদিকে দন্ডায়মান রুপোর তৈরী মহাদেব রয়েছে। মহাদেবের হস্তে ত্রিশূল ও ভিক্ষাপাত্র আছে।
![]() |
তোরণের সেই বিখ্যাত সিংহের মূর্তিটি |
![]() |
নাট মন্দির |
মন্দিরটির ঠিক সামনে বেশ চাকচিক্যময় একটা বড় নাটমন্দির রয়েছে। এই নাটমন্দিরে প্রবেশ করার জন্য সাতটি প্রবেশপথ রয়েছে। গোলাকৃতি উঁচু থাম নাটমন্দিরটির চারদিকে আছে। পুরো মন্দির চত্বরটি ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আছে।
কথিত আছে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব চারবার এই মন্দির দর্শনে এসেছিলেন। ঠাকুর শেষবার ১৮৮২ সালের উল্টোরথের দিন মাহেশের রথ দেখে ফেরার পথে মনমোহন, লাটুবাবু, গিরীন্দ্র ও হৃদয়কে সাথে নিয়ে এই মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে রাসমণি ঘাটে এসে নেমেছিলেন। ঠাকুরের পদধুলিমাখা চানকের এই অন্নপূর্ণা মন্দিরটি খুবই ঐতিহ্যময় স্থান।
![]() |
রাসমণি ঘাট |
মন্দিরটিতে অন্নপূর্ণা পুজোর দিন বাৎসরিক পুজো খুব ঘটা করে হয়ে থাকে। এইদিন মাকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। এই দিন কুমারীপুজোও করা হয়। অন্নপূর্ণার পুজো ছাড়াও বিপত্তারিণী, জগদ্ধার্থী ও কালীপুজোও খুব আড়ম্বরের সাথে করা হয়ে থাকে। শিব মন্দিরগুলিতে নীলষষ্ঠী ও শিবরাত্রির দিনে পুজো হয়ে থাকে এইসব উৎসবের দিনগুলোতে ব্যারাকপুরের এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়।
![]() |
ছয়টির তিনটি শিবমন্দির |
![]() |
বাবা মহাদেব |
মন্দির দর্শনের সময় :
সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২.৩০ আর বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
কিভাবে যাবেন :
শ্যামবাজার থেকে ব্যারাকপুরগামী বাসে করে তালপুকুরে নামবেন। অথবা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে ব্যারাকপুর স্টেশনে নেমে অটো রিক্সা করে তালপুকুরে এসে নামতে হবে। তালপুকুর থেকে রিক্সা বা পায়ে হেঁটে সামান্য পথ গেলেই এই প্রতিরূপ মন্দিরটি দেখতে পাবেন। মন্দিরটি একদম রাস্তার ধরেই অবস্থিত।
তারিখ : ১৩-০৪-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
1 comment:
আমি বহুবছর ব্যারাকপুরে আছি, পঞ্চাশের দশকে রাসমনি ঘাটে রোজ স্নান করতাম। ঠিক ই লিখেছেন, ওখানকার পরিবেশ মন্দির মন্দির নয়। এটা একদিনে হয়নি। কতৃপক্ষের উদাসীনতা কিছুটা দায়ী, বাদবাকি শরিকি বিবাদ। আমরা তো স্থানীয় লোক, দেখে খুব কষ্ট হয়। সবশেষে বলি দক্ষিণথেকে বি টি রোড ধরে বাসে টিটাগড় নেমে পায়ে হেঁটে খুব অল্প সময়ে এখানে আসা যায়।
আমার নমস্কার জানবেন।
Post a Comment