Sunday, April 28, 2019

শতবর্ষের আলোকে মান্না দে >


শতবর্ষের আলোকে মান্না দে



বিংশ শতাব্দী ভারতীয় খেলাধুলা ও  সংস্কৃতি  জগতে এক বিস্ময়ের শতাব্দী, বলা যায় বহু নক্ষত্র সমাবেশের শতাব্দী। খেলাধুলার  জগতে,  সাহিত্য জগতে, অভিনয়ের  জগতে,  সংগীত জগতে এই শতাব্দী বিশ্বে তথা ভারতবর্ষে  অজস্র নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজ নিজ জগৎকে অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছিলেন। এই শতাব্দীতেই  ভারতীয়  সংগীত জগতে কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দের জন্ম হয়েছিল।  সংগীত জগতে  তাঁর  উজ্জ্বল পদার্পন ভারতীয় সংগীতকে এক উচ্চ আসনে বসিয়েছিল। তাঁর অধ্যাবসায় তাঁকে ভারতীয়  সংগীত জগতে এক নক্ষত্রে পরিণত করেছিল।   ২০১৯ সালের ১লা মে দেখতে দেখতে তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলল। দিকে দিকে তাঁর শতবর্ষই উদযাপন করা হচ্ছে। 

যখন আমার বারো - তেরো বছর বয়স তখন আমি  "বিনাকা সংগীতমালা" অনুষ্ঠানে ওনার গান শুনে আমি প্রথম এই কণ্ঠ মাধুর্যের সাথে পরিচিত হই। তারপর থেকে এই কণ্ঠ আমার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে  জড়িয়ে গেছে।  আমার কৈশোরের প্রথম প্রেমই এই গায়কীর সাথে। সেই প্রেম আজও আমায় সমানভাবে আকর্ষণ করে রেখেছে, হয়তো আমার জীবনের শেষ নিঃশাস পড়া অবধি এই প্রেমের বন্ধন অটুট থাকবে। কয়েকদিন  যদি এই কণ্ঠ  বা এই গায়কী না শুনি এখনো  আমার মনটা উতলা হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমি অন্তত খান তিরিশেক ওনার গানের  প্রোগ্রাম শুনেছি, তার মধ্যে ১৮টা একক প্রোগ্রাম ছিল, যা আমার স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ওনার গানের সাথে রাধাকান্ত নন্দীর যুগলবন্দী, পরবর্তীকালে রাধাকান্ত নন্দীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মানিক নন্দীর যুগলবন্দী কোনদিন ভুলতে পারবো না। গায়ক ও তবলচির কি অসাধারণ বোঝাপড়া ছিল যা চোখে না দেখলে বলে বোঝানো  যাবে না।

মান্না দে, আজ এই সুন্দর ভুবনের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ঠিকই। কিন্তু আজও সমগ্র ভারতবাসীকে তিনি তাঁর সুরমূর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছেন। তাই তো এখনকার পরিচিত গায়ক অঞ্জন দত্ত ভক্তদের মনের কথা বলেছেন " আর বিরহের কথা এলে, বুকের জ্বালা ভুলে, আজও মাঝে মাঝে গাই মান্না দের গান"। প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ , ভক্তি , বন্ধুত্ব, উন্মাদনা মানব জীবনের সব ধরণের অনুভূতির প্রকাশ মান্না দের গানে বার বার এসেছে। তাঁর  গায়কি  দিয়ে তিনি সমগ্র দেশবাসী তথা পৃথিবীর মানুষকে মন-মুগ্ধ করে রেখেছেন।  ক্ল্যাসিক্যাল, সেমি -  ক্ল্যাসিক্যাল, গজল, আধুনিক গানে শুধু নয়, রক এন্ড রোল গানেও তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ  তিনি রেখে গেছেন। বাংলা ও হিন্দি ছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় তিনি গান গেয়ে গেছেন। যার কণ্ঠে খেলা করতো সংগীতের সাত সুর।  তিনি সুরের চলনে সঞ্চার করতে পারতেন নাটক।  কঠিন গানকে কত সহজভাবে তিনি গাইতে পারতেন তার নমুনা বোধহয় "লাগা চুঁনড়ি মে দাগ" বা পড়াসন  চলচ্চিত্রের  "এক চতুর নার"। তাঁর এই ক্ষমতা অকল্পনীয় ছিল। বৈচিত্রের বিচারে সংগীতবোদ্ধাদের কাছে তিনি সর্বকালের সেরা গায়ক বলে বিবেচিত। তিনি বহু  ভাষায় বহু গান গেয়েছিলেন ঠিকই, তবে হিন্দি ও বাংলা গানে তাঁকে  কিংবদন্তি বলে ধরা হয়।

"ও কেন এত সুন্দরী হল" বা "এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি" গানের মাধ্যমে তিনি ব্যর্থ প্রেমিকের মনের  যন্ত্রনা যেমন ফুটিয়ে  তুলেছেন। তেমন  "সে আমার ছোট বোন" গানটিতে তিনি তাঁর  স্নেহ মায়া সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। "আমায় একটু জায়গা দাও,মায়ের মন্দিরে বসি" গানটিতে তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তিকে সুনিপুনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, যা  শুনলে যে কোনো শ্রোতার চোখ জলে ভিজে যায়। মান্না দের গানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার গানের পরিধি বাঙালি জীবনের প্রত্যেকটা  ধাপের সাথে মিশে আছে।  আমাদের সব অনুভূতি বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ তাঁর গানে গানে প্রকাশিত হয়েছে। তাই তো তিনি "সারা  জীবনের গান" বা " সারা বছরের  গান" গেয়ে  ছিলেন।

 একশো বছর পূর্বে অর্থাৎ  ১লা মে  ১৯১৯ সালে উত্তর কলকাতার ৯ নং মদন ঘোষ লেনের এক মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা  পূর্ণ চন্দ্র দে আর মাতা ছিলেন মহামায়া  দেবী। তিনি শৈশবে ইন্দু বাবুর পাঠশালায়, পরে  স্কটিশ চার্চ স্কুল ও স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হন। স্নাতক হওয়ার পর তাঁর পড়াশুনার পাঠ তিনি সাঙ্গ  করেন। তাঁর কাকা বিখ্যাত সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণ চন্দ্র দে তাঁকে সংগীতের প্রতি বরাবর অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতেন। মান্না দের  যেমন সংগীতের প্রতি আকর্ষণ ছিল তেমন কুস্তি, বক্সিংয়ের প্রতিও খুব আগ্রহ ছিল। তিনি নিয়মিত বক্সিং চর্চা করতেন এবং খুবই পারদর্শী ছিলেন এই সব খেলায়। পড়াশুনার পাঠ সাঙ্গ  করার পর তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের ছত্রছায়ায় সংগীত চর্চ্চা শুরু করেন। উস্তাদ  দাবির খাঁর কাছে তিনি সংগীতের তালিম নেওয়াও শুরু করেন। পরবর্তীকালে মুম্বাই যাওয়ার পর তিনি উস্তাদ আমন আলী খাঁ ও উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছে হিন্দুস্তানী সংগীতের তালিম নেন।

১৯৪২ সালে তিনি মুম্বাই পাড়ি দেন। প্রথমে তিনি কাকার সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তারপর শচীন দেববর্মন ও ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ ও অন্যান্য সুরকারদের অধীনে কাজ করেন।  কাজ করতে করতে তিনি স্বনামধন্য গীতিকারদের সংস্পর্শে আসেন। এইভাবে কিছুদিন চলার পর তিনি স্বাধীনভাবে সংগীত পরিচালনার কাজ শুরু করেন।

১৯৪৩ সালে "তামান্না" নামে একটা ছবিতে তাঁর কাকার সুরে প্রথম গায়ক হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে। "জাগো আই উষা" গানটি তিনি সুরাইয়ার সাথে দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন। এই গানটা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। ১৯৫০ সালে শচীন দেববর্মনের সুরে "মশাল" ছবিতে তিনি প্রথম এককভাবে গান গেয়েছিলেন।  এই গানটাও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গানটাই তাঁকে পাকাপোক্ত গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তীকালে  তিনি বহু সুরকারের সুরে বহু জনপ্রিয় গান গেয়ে গেছেন। ১৯৫৩ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় নিজের সুরে "কত  দূরে আর নিয়ে যাবে বল" ও  "হায় হায় গো , রাত যায় গো"  গান দুটি  তাঁর  গাওয়া প্রথম বাংলা গান। পুজোর সময় গান দুটি প্রকাশ হওয়ার পর সুপার হিট হয়।  ১৯৬৭ সালে এন্টনি ফিরিঙ্গি সিনেমায় উত্তমকুমারের লিপে গাওয়া সব কটা গান আজও বাঙালির হৃদয়কে মোহিত করে রাখে। তিনি যেমন আরতি  মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকরের সাথে দ্বৈত কণ্ঠে বাংলা সিনেমায় বেশ কিছু জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন। তেমন  অনিল বাগচী, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে বাংলা চলচ্চিত্রেও  অনেক গান আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। বাংলা আধুনিক গানে পুলক বন্দ্যোপাধ্যাযের লেখা ও নিজের সুরে গাওয়া গানগুলি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সুপর্ন কান্তি ঘোষের সুরে বেশ কিছু বিখ্যাত গান তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। তার মধ্যে কফি হাউসের গানটি তো চিরকালীন শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে।  তিনি সব ভাষা মিলে  প্রায়  হাজার চারেক গান গেয়েছেন।

মান্না দে শুধু গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না. তিনি একজন নামজাদা সংগীত পরিচালকও ছিলেন। ১৯৪০ সালে যখন তাঁর বয়স ২১ বছর তখন তিনি শৈলেশ রায়ের কথায় "ওগো দূরের ধ্যানে" ও "বালুকাবেলায় অলস খেলায়" এই দুটি গান সুপ্রীতি ঘোষকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন। রেকর্ডে অবশ্য সুরকার হিসেবে প্রবোধ চন্দ্র দের  নাম উল্লেখ করা আছে।  তখন তিনি মান্না নামটি মনে হয়  ব্যবহার করতেন না। এরপর তিনি বহু বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন।  তিনি নিজের সুরে নিজে যেমন গেয়েছেন তেমন প্রচুর নামি-অনামী শিল্পীদের দিয়েও গান গাইয়েছেন। তাঁর সুরের মধ্যে সবসময় শাস্ত্রীয় সংগীতের ছোঁয়া  প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। ছায়াছবি ছাড়াও প্রচুর নন ফিল্মি গানে তিনি সুর দিয়ে গেছেন। ১৯৭৬ সালে পুজোর সময় আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাইয়েছিলেন "আমি খাতার পাতায় লিখেছিলাম", ও সুমন কল্যাণপুরকে দিয়ে গাইয়েছিলেন "কাঁদে কেন মন আজ" এবং "শুধু স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলছে ", ১৯৭৮ সালে হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে  গাইয়েছিলেন  "আমার বলার কিছু ছিল না"। এছাড়া প্রতিবছর তিনি নিজের সুর করা গানগুলো নিজেই গেয়ে গেছেন।  সবকটা গানই জনপ্রিতার শীর্ষে পৌঁছেছিল। কণ্ঠ  অনুযায়ী আদর্শ সুর নির্বাচন করার ক্ষমতা তাঁর ছিল।

১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী ও ২০০৫ সালে পদ্মভূষণ খেতাব তিনি ভারত সরকারের থেকে লাভ করেন। ২০০৪ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট্ সম্মানে সম্মানিত হন।  ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ সম্মান প্রদান করে।  এছাড়া দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার, বহু প্রাদেশিক সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে বহু সম্মানে তিনি সম্মানিত হয়েছেন।

১৯৫৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তিনি কেরালার কন্যা সুলোচনা কুমারনকে বিবাহ করেন।  ১৯৫৬ সালের ১৯শে অক্টোবরে তাঁর প্রথম কন্যা সুরমা ও ১৯৫৮ সালের ২০শে  জানুয়ারী  তাঁর  কনিষ্ঠা  কন্যা সুমিতা জন্মগ্রহণ করে।  তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর মুম্বাইয়ে বসবাস করেন।  তবে কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে তিনি প্রায়ই যাতায়াত করতেন। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর শেষ জীবনটা তিনি তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা সুমিতার কাছে ব্যাঙ্গালোরে কাটান। ২০১৩ সালের ২৪শে অক্টোবর ব্যাঙ্গালোরে তাঁর  মৃত্যু হয়। "শেষ পাতা গো, শাখায় তুমি থাকো" শেষ পর্যন্ত সেই পাতা ঝড়েই গেছে, কিন্তু শ্রোতারা সব সময়ই তাঁর গাওয়া গানগুলোকে মনে মনে গুন্ গুন্ করবে। মুকুটটা পড়েই আছে, শুধু রাজা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।

নিয়ম, নিষ্ঠা, অধ্যাবসায়, শিক্ষা ও রেওয়াজে সাজানো যেন এক সংঙ্গীত মন্দির, যে মন্দিরে একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন মান্না দে। প্রবাদপ্রতিম এই সংগীতশিল্পী আজ আমাদের মধ্যে নেই ঠিকই, কিন্তু মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসা তার গানের অপেক্ষায় আমরা চিরকাল রয়ে যাবো।  কাগজ বা পাথরে তাঁর  নাম আমরা না লিখে আজও আমাদের হৃদয়ে  লিখে রেখেছি এবং তা রয়ে যাবে।




তারিখ :  ১লা মে, ২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




4 comments:

Sujit said...

Khub valo laglo, .....

All In One said...

Khub bhalo information pelam

Rocky said...

Khub Sundar

Rocky said...

Khub Sundar