Friday, November 5, 2021

কাঁকুলিয়া কালীবাড়ি>P

কাঁকুলিয়া কালীবাড়ি

-সুদীপ্ত মুখার্জী 








বালিগঞ্জ অঞ্চলটি খুবই বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। ১৮ শতকে এই অঞ্চলটিতে ইউরোপীয়দের বাগান বাড়ি ছিল। শহরতলির রেলপথের দক্ষিণ শাখা চালু হওয়ার  পর যখন বালিগঞ্জে  একটা রেলওয়ে স্টেশন তৈরী হয় তখন থেকে এই অঞ্চলটিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বসবাস শুরু হয়। এই বালিগঞ্জ অঞ্চলের  মধ্যেই পরবর্তীকালে কাঁকুলিয়া নামক আর একটা  অঞ্চল গড়ে ওঠে। এই অঞ্চলটিও মধ্যবিত্তের  পাড়া  হিসেবে পরিচিত হয়।  



এই কাঁকুলিয়া অঞ্চলে রয়েছে একটা ভগ্নপ্রায় মন্দির।  আনন্দময়ী কালী মন্দির। যেখানে বহুবছর ধরে  দেবী কালীর  আরাধনা করা হয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে তা আজ প্রায় ৮০ বছর  অতিক্রম করে গেছে। 


যোগীন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয়ের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। ১৯৩২ সাল নাগাদ তিনি ওখানে দেবী আনন্দময়ীর আরাধনা শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার মণিমোহন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই দাশগুপ্ত পরিবারের কুলগুরু। মণি বাবু ছিলেন দেবী আনন্দময়ীর নিত্য সেবক। ওপার বাংলায় যখন হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ শুরু হয়। ভারতে তখন স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় দাশগুপ্ত পরিবার তাঁদের কুলদেবী  আনন্দময়ীকে নিজ গৃহ রাখতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের কুলগুরু শ্রী মণিমোহন বাবুকে অনুরোধ করেন যে দেবীমূর্তিটিকে পদ্মার জলে বিসর্জন দিয়ে দিতে। বিসর্জন পর্বের পর তিনি যেন ওই স্থান ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। মণিমোহন বাবু কিন্তু যোগীন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্তর কথায় রাজি হলেন না।  তিনি বললেন যদি এপার  বাংলা থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতেই  হয় তাহলে তিনি দেবী আনন্দময়ীকে সাথে করে নিয়ে ফিরে যাবেন।  এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি মা আনন্দময়ীকে সাথে করে পশ্চিমবাংলায়  চলে আসেন। তিনি তাঁর দেশের বাড়ি বর্ধমানে প্রথমে গেলেন। তারপর তিনি দেবী আনন্দময়ীকে সাথে করে নিয়ে কলকাতায় এসে কাঁকুলিয়াতে আস্তানা গড়লেন। সেই সময় কাঁকুলিয়া অঞ্চলটি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের দ্বারা সরক্ষিত ছিল।  ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা প্রথমে দেবী আনন্দময়ীর জন্য একটি স্থান নির্দিষ্ট করে একটি কাঁচা ঘর নির্মাণ করে দিলেন। এই কাঁচা ঘরে মা আনন্দময়ী প্রতিষ্ঠিত হলেন। সালটা ছিল ১৯৪৮।তা আজ দেখতে দেখতে প্রায় ৮৪-৮৫ বছর হতে চললো। পরবর্তী সময় দাশগুপ্ত পরিবারের এক দৌহিত্র শ্রী অনিল দত্ত মহাশয় বর্তমান মন্দিরটিকে নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। পরে তিনি মন্দিরের ঠিক সামনে একটি নাটমন্দির ও পাশে একটি শিব মন্দির তৈরী করে দিয়েছিলেন। ১৯৬৫-৬৬ সাল নাগাদ পুরো নাটমন্দিরটি ও শিব মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায় তখন এই অঞ্চলের অধিবাসী শ্রী রঘুনাথ মুখার্জী, শ্রী হীরেন চন্দ্র ও আরো কয়েকজন নতুন করে নাটমন্দির ও শিমন্দিরটিকে পুনরায়  তৈরী করে দেন। শুধু নাটমন্দির বা শিব মন্দির নয় তার সাথে তারা মন্দিরের পিছনে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বসবাসের উপযুক্ত ঘরও  তৈরী করে দিয়েছিলেন। 




কষ্টিপাথরের বিগ্রহটি উচ্চতায় ২২ ফুট। দেবী এখানে চতুর্ভূজা ও দেবাদিদেব মহাদেবের উপর দন্ডায়মান।  আষাঢ় মাসের অমাবস্যার দিন এই মন্দিরটিতে দেবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  সেই জন্য ওই দিন এখানে প্রতিবছর নিয়ম করে বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা, চক্ষুদান ও ঘটস্থাপন সম্পন্ন হয়। প্রতিদিন নিত্যপূজা করা হয়ে থাকে। কালীপূজার দিন বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর কালীপূজার পূর্বে দেবীর অঙ্গরাগ সম্পন্ন হয়। এইদিন সকালে দেবীকে রাজবেশ পরানো হয়।  কালীপূজার দিন নিত্যপূজা অনুষ্ঠিত হলেও আমবস্যার সময় বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

এই বিশেষ দিনটিতে দেবীকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, লুচি, তরকারি, পায়েস, চাটনি এবং নানারকম ফল ও মিষ্টি ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করা হয়। এখানকার মন্দিরে যেহেতু শালগ্রাম শিলা রয়েছে তাই নিরামিষ ভোগ দেবীকে নিবেদন করা হয়।  পূর্বে এখানে বলিদান করা হত কিন্তু বহুকাল পূর্ব থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে।  পুরানো ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও  মন্দিরে পূজাপর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

মন্দিরের সেবায়েত জানালেন যে দক্ষিনেশ্বরের ভবতারিনীর বিগ্রহটিকে যে নবীন ভাস্কর নির্মাণ করেছিলেন তারই চৌহিত্র এখানকার দেবীর বিগ্রহটিকে তৈরী করে দিয়েছিলেন।  
 
কিভাবে যাবেন : 

শিয়ালদহ থেকে দক্ষিণ শাখার  যে কোনো ট্রেন ধরে বালিগঞ্জ এসে নামুন। স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই মন্দিরটিকে পেয়ে যাবেন। এছাড়া যে কোন বাসে করে এসে গড়িয়াহাটে নামুন।  গড়িয়াহাটে কাউকে জিজ্ঞাসা করে কাঁকুলিয়া রোড-এ আসুন। এই রাস্তার উপর আনন্দময়ীর মন্দিরটি অবস্থিত। 

মন্দিরের ঠিকানা : 

১৪৭ নং কাঁকুলিয়া রোড, কলকাতা - ৭০০০২৯


তারিখ :০২-১১-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


No comments: