শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসব
![]() |
লোকে লোকারণ্য উৎসব মাঠ |
![]() |
নৃত্যরত |
![]() |
আশ্রমিক কন্যারা |
দোলযাত্রা প্রধানত হিন্দু-বৈষ্ণবদের উৎসব বলেই খ্যাত। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই নানারকম পৌরাণিক উপাখ্যানে এই উৎসবের কথা বলা আছে। এই দোলপূর্ণিমার দিনেই উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীদের সাথে রঙের খেলায় মেতে উঠেছিলেন। এই দোল পূর্ণিমার তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভু নদীয়া জেলার শান্তিপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শান্তিপুরবাসিনীরা তাই এই দোল পূর্ণিমাকে "গুরুপূর্ণিমা" বলে থাকে। গ্রামে-গ্রামে, শহরে-শহরে আট থেকে আসি বছরের কেউ এই উৎসবে সামিল হতে বা নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে বাদ যায় না।
ভারতের নানাপ্রান্তেই এই উৎসব বেশ ঘটা করে পালিত হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই। বীরভূমের শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব ভারতের সবথেকে বড় ও প্রাণঢালা এক উৎসব বলে বিবেচিত হয়। সেই কবে ১৯০৭ সাল নাগাদ কবিগুরুর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর দুই বন্ধু "ঋতুরঙ্গ" নামে এক উৎসবের সূচনা করেছিলেন। তখন শান্তিনিকেতনের প্রাককুটীরের সামনে বেশ কয়েক বছর ধরে এই উৎসব উদযাপন করা হচ্ছিল। তিনি তাঁর পিতার লেখা গান "এ কি লাবণ্য পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে" গানটি নিজের গলায় গেয়ে উৎসবটির সূচনা করেছিলেন। এই প্রাককুঠিরই বর্তমানে শমীন্দ্র পাঠাগারে পরিণত হয়েছে। তাঁর অকাল মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত উৎসবটির প্রচলন করেন সম্ভবত ১৯১৫-১৬ সাল নাগাদ। সাধারণত আমারা দোল বা হোলিকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার অংশ বলেই জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই প্রথাকে ভেঙে ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানালেন তাঁর মতো করে। তিনি এই উপলক্ষ্যে লিখলেন "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" ও "আহা আজি এ বসন্তে". দুটি গান।
২০১৭ সালের দোলের দু-দিন আগের রাতে ফোন করে আমার এক বন্ধু শ্রী সুদীপ্ত মিত্র ওর সাথে শান্তিনিকেতনে ছবি তুলতে যেতে বলল। কিন্তু ও থাকার কোনো ব্যবস্থা করেনি বলে জানালো। বহু আগে থেকে ব্যবস্থা না করলে ওখানে এইসময় থাকার জন্য কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না, এটা আমার জানা ছিল।আমার এক দাদা শ্রী গৌতম সরকারের শান্তিনিকেতনের সীমান্তপল্লিতে একটা বাড়ি আছে। পরেরদিন সকালে তাঁকে ফোন করে জানতে চাইলাম ওনার বাড়িতে দুদিন থাকা যাবে কিনা? আমরা যাচ্ছি শুনে উনিও আমাদের সাথে যেতে চাইলেন। সেইদিন দুপুরে ওনার কলকাতার বাড়িতে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন ওনার
ছেলে গৌরবও আমাদের সাথে যেতে চাইলো। যাইহোক, আমরা চারজনে ওনার গাড়ি করে দুপুর তিনটে নাগাদ রওনা দিলাম, রাত আটটার সময় আমরা শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছলাম। মাঝে অবশ্য আমরা শক্তিগড়ে লাংচা ও চা খেয়ে নিয়েছিলাম। ওনার বাড়িতে পৌঁছনোর পর কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেতে আমরা বেরোলাম। একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল বলে বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট খাবার হোটেল খোলা পেলাম। ওখানে বসে গরম গরম আলুর পরোটা ও তরকারি খেয়ে নিলাম। খেয়ে এসে আমরা কিছুক্ষন গল্প করে শুয়ে পড়লাম।
পরেরদিন সকাল ৬টার সময় ঘুম থেকে উঠে ৭ টার মধ্যে তৈরী হয়ে হাতিপুকুর দিয়ে হেঁটে আশ্রম মাঠে এসে পৌঁছলাম। এতো সকালেই মাঠটাতে ভীড়ে ভীড়াক্কার। কিছুক্ষন পর আমি, গৌতামদা ও গৌরব একটু চা খাবার উদ্দেশ্যে মাঠের বাইরে বেরোলাম। লোকের ভীড় আমাদের ঠেলতে ঠেলতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে এসে ফেলল। এই ভীড়ের ধাক্কায় আমাদের চা খাওয়ার ইচ্ছে তখন হারিয়ে গেছে। আমরা আর এই ভীড় ঠেলে আশ্রম মাঠে ফিরে আসতেই পারলাম না। আমার বন্ধু সুদীপ্ত আশ্রম মাঠেই রয়ে গেলো। তার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কারোরই মুঠিফোন কাজ করছিলো না তখন। আমরা কালোবাড়ি অঞ্চলেই ঘুরে ঘুরে ঘন্টা চারেক সময় কাটালাম।
এখানে দেখছিলাম অনেকগুলো জায়গাতেই বেশ কয়েকজন একসাথে নাচে-গানে মেতে উঠেছে। বেশ কিছু বিদেশী আশ্রমিকও দেশী আশ্রমিকদের সাথে সমানভাবে অংশ নিচ্ছে। এইসব অনুষ্ঠানগুলো আমরা বেশ উপভোগ করছিলাম। মূল উৎসব মাঠের অবস্থাটাও এখান থেকে কিছুটা দেখা যাচ্ছিল। যদিও অনেক দূর থেকে আমরা দেখছিলাম তাই সবটা দেখা সম্ভবও হচ্ছিল না। অনুষ্ঠান মঞ্চটা এখান থেকে একদমই দেখা যাচ্ছিল না। শুধু লোকের মাথা ছাড়া বেশি কিছু দেখার কোনো উপায় ছিল না। এখানকার পুলিশ বেশ সতর্কভাবেই উৎসব মাঠটিকে ও সমগ্র শান্তিনিকেতনকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। মাঠের চারদিকে চারটি ওয়াচ টাওয়ার তৈরী করা হয়েছে। এইসব টাওয়ারগুলি থেকে কয়েকজন করে পুলিশ সারা মাঠটিকে লক্ষ্য রাখছে। মাঠের
মধ্যে আকাশে ড্রোন ক্যামেরা চক্কর কাটছে। পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য বাসন্তী রঙের টুপি পরা কয়েকশো বিশ্বভারতীর নিজস্ব সেচ্চাসেবকও রয়েছে দেখলাম। বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই উৎসবটি চলছিল। এরকম সুশৃঙ্খলভাবে কলকাতায় দোল উৎসব আমি কোনো দিন হতে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। বসন্ত উৎসব ও দোল বা হোলি উৎসবের তফাৎটা এখানে আসার পরই আমি ঠিকমত বুঝতে পারলাম। কলকাতার মতো এখানে কারোকে কোনো বেলেল্লাপনা বা অশালীন আচরণ করতে দেখলাম না। কত সুশৃঙ্খলভাবে এখানে সমগ্র অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করা হচ্ছিল, এখানে না আসলে সেটা বোঝা যায় না। তার জন্য এখানকার প্রশাসনের বিশেষ পুরস্কার পাওয়া উচিত। পর্যটক বা আশ্রমিক সবাই নিজেরা নিজেদের মত করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মেতে আছে। আশ্রমিক মেয়েরা বেশিরভাগই দেখলাম বাসন্তী রঙের শাড়ি আর ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে উৎসবটিতে সামিল হয়েছে।আদিবাসীদের তৈরী করা পলাশ ফুলে গাঁথা মালা গলায় পরে, মাথায় গোঁজা লাল-হলুদ পলাশফুল। সুন্দর সাজে সজ্জিত হয়ে এখানকার আশ্রমিক মেয়েদের রূপ যেন দ্বিগুনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এরকম সুন্দর পোশাক আর তার সাথে রঙিন ফাগের রঙে নিজেদের সাজিয়ে তারা এক মনমুগ্ধকর পরিবেশ উপহার দিচ্ছিল দর্শনার্থীদের। বেশিরভাগ পর্যটকরাই রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনকে ভালোবেসে কত দূর দূর থেকে এই উৎসবে সামিল হতে আসে। কবিগুরুর "গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ " এই দিন যেন আরো রাঙিয়ে উঠে।
অনেক ঘোরাঘুরি করার পর আমরা একটা বড় গাছের তলায় বিশ্রাম করার জন্য বসেছিলাম, সেই সময় দেখলাম কাঁধে বাঁক নিয়ে একজন মধ্যবয়সী "দই চাই, দই লাগবে নাকি" বলে ঘুরে ঘুরে দই বিক্রি করছে। এই দৃশ্য দেখে আমায় কবিগুরুর সেই বিখ্যাত "অমল ও দইওয়ালা" কাহিনীটা মনে করিয়ে দিল। আমরা এক ভার করে দই কিনে খেলাম, গরমে একটু শান্তি পেলাম।
একজন বাচ্চাকে দেখলাম শিব সেজে দুটো পয়সা রোজগারের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দৃশ্যটা দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিল। ভাবছিলাম যখন সবাই এখানে রঙের খেলায় মেতে উঠেছে, তখন এইটুকু বাচ্চা ছেলেটা তাতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছেকে গোপন করে দুটো পয়সা রোজগারের জন্য ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। তার এই রোজগারে হয়তো পরিবারের অন্নসংস্থান হচ্ছে, পরিবারের দীনতা কিছুটা হলেও হয়তো ঘুচছে, হয়তো তার কোন ছোট ভাই বা বোনের পড়াশুনার খরচা ওই যোগাচ্ছে। এই আনন্দের মধ্যেও মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তাকে ডেকে আমি ১০০ টাকা আর গৌতাম্দা ১০০ টাকা দিলাম। এই টাকাটা পায়ে সে বেশ খুশি হয়ে চলে গেল।
এখানে সারাদিনই নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যেবেলাতে শান্তিনিকেতনের বেশ কয়েক জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গান ও নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও আবার রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যও পরিবেশন করা হয়।
এখানকার এক অধ্যাপকের সাথে আলাপচারিতায় জানলাম কবিগুরু ১৯৪০ সালে অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর আগের বছর শেষবার শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪১ সালে তাঁর অসুস্থতার কারণে তিনি এখানে আসতে পারেননি।
এখানে নাচের তালে তালে, গানের সুরে সুরে যেন আকাশে ওড়ে ফাগুয়ার রং। রঙিন মনে তখন শুধুই আনন্দের ফোয়ারা ওঠে। সবমিলিয়ে শান্তিনিকেতনের দোল দেখার জন্য বাঙালি কেন বারে বারে এখানে ছুটে আসে তা এই দিনে এখানে না আসলে বুঝতে পারতাম না। তাই দেশী পর্যটকদের সাথে বহু বিদেশী পর্যটক কত সুদূর পথ পেড়িয়ে এখানে আসেন। তারা উপভোগ করে যান কবিগুরুর বসন্তউৎসবের মেজাজটাকে। মনে খুশীর হিল্লোল, আনন্দের প্রাপ্তি যেন ফুটে উঠছে সকল আশ্রমিক ও পর্যটদের মুখে। এ যেন এক বসন্তের পরম পাওনা, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই ডিজিটাল যুগেও এখানে রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষজন তা সে এখানকার আশ্রমিক ছাত্র-ছাত্রী হোক বা অধ্যাপক হোক, একবারের জন্য কেউ রবীন্দ্রনাথের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন না। এখানে বসন্ত উৎসব তাই আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এই উৎসব যেন এক ভালোবাসার পরশ ও উপলব্ধির মেলবন্ধন। বর্তমানে এই ধরণের মেলবন্ধনের উৎসব খুব প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হয়।
কিভাবে যাবেন :
হাওড়া স্টেশন থেকে গণদেবতা, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ও আরো অনেকগুলো ট্রেন রয়েছে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকেও মাতারা এক্সপ্রেস ও আরো কয়েকটি ট্রেন রয়েছে। এইসব ট্রেনে করে বোলপুর স্টেশনে এসে নামুন। সময় মোটামুটি ঘন্টা তিনেকের মতো লাগবে। বোলপুর স্টেশন থেকে অটো বা রিক্সা করে আশ্রম মাঠে আসুন।
কোথায় থাকবেন :
বোলপুর, শান্তিনিকেতনে অনেকগুলো বেসরকারি লজ রয়েছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের একটা সুন্দর অতিথি নিবাস রয়েছে। এইসব লজ বা অতিথি নিবাসে এইসময় এসে থাকতে চাইলে অন্তত তিন-চার মাস আগে থেকে বুকিং করতে হবে।
![]() |
দর্শনার্থী |
পরেরদিন সকাল ৬টার সময় ঘুম থেকে উঠে ৭ টার মধ্যে তৈরী হয়ে হাতিপুকুর দিয়ে হেঁটে আশ্রম মাঠে এসে পৌঁছলাম। এতো সকালেই মাঠটাতে ভীড়ে ভীড়াক্কার। কিছুক্ষন পর আমি, গৌতামদা ও গৌরব একটু চা খাবার উদ্দেশ্যে মাঠের বাইরে বেরোলাম। লোকের ভীড় আমাদের ঠেলতে ঠেলতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে এসে ফেলল। এই ভীড়ের ধাক্কায় আমাদের চা খাওয়ার ইচ্ছে তখন হারিয়ে গেছে। আমরা আর এই ভীড় ঠেলে আশ্রম মাঠে ফিরে আসতেই পারলাম না। আমার বন্ধু সুদীপ্ত আশ্রম মাঠেই রয়ে গেলো। তার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কারোরই মুঠিফোন কাজ করছিলো না তখন। আমরা কালোবাড়ি অঞ্চলেই ঘুরে ঘুরে ঘন্টা চারেক সময় কাটালাম।
![]() |
নৃত্যে ব্যস্ত আশ্রমিকরা |
এখানে দেখছিলাম অনেকগুলো জায়গাতেই বেশ কয়েকজন একসাথে নাচে-গানে মেতে উঠেছে। বেশ কিছু বিদেশী আশ্রমিকও দেশী আশ্রমিকদের সাথে সমানভাবে অংশ নিচ্ছে। এইসব অনুষ্ঠানগুলো আমরা বেশ উপভোগ করছিলাম। মূল উৎসব মাঠের অবস্থাটাও এখান থেকে কিছুটা দেখা যাচ্ছিল। যদিও অনেক দূর থেকে আমরা দেখছিলাম তাই সবটা দেখা সম্ভবও হচ্ছিল না। অনুষ্ঠান মঞ্চটা এখান থেকে একদমই দেখা যাচ্ছিল না। শুধু লোকের মাথা ছাড়া বেশি কিছু দেখার কোনো উপায় ছিল না। এখানকার পুলিশ বেশ সতর্কভাবেই উৎসব মাঠটিকে ও সমগ্র শান্তিনিকেতনকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। মাঠের চারদিকে চারটি ওয়াচ টাওয়ার তৈরী করা হয়েছে। এইসব টাওয়ারগুলি থেকে কয়েকজন করে পুলিশ সারা মাঠটিকে লক্ষ্য রাখছে। মাঠের
মধ্যে আকাশে ড্রোন ক্যামেরা চক্কর কাটছে। পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য বাসন্তী রঙের টুপি পরা কয়েকশো বিশ্বভারতীর নিজস্ব সেচ্চাসেবকও রয়েছে দেখলাম। বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই উৎসবটি চলছিল। এরকম সুশৃঙ্খলভাবে কলকাতায় দোল উৎসব আমি কোনো দিন হতে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। বসন্ত উৎসব ও দোল বা হোলি উৎসবের তফাৎটা এখানে আসার পরই আমি ঠিকমত বুঝতে পারলাম। কলকাতার মতো এখানে কারোকে কোনো বেলেল্লাপনা বা অশালীন আচরণ করতে দেখলাম না। কত সুশৃঙ্খলভাবে এখানে সমগ্র অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করা হচ্ছিল, এখানে না আসলে সেটা বোঝা যায় না। তার জন্য এখানকার প্রশাসনের বিশেষ পুরস্কার পাওয়া উচিত। পর্যটক বা আশ্রমিক সবাই নিজেরা নিজেদের মত করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মেতে আছে। আশ্রমিক মেয়েরা বেশিরভাগই দেখলাম বাসন্তী রঙের শাড়ি আর ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে উৎসবটিতে সামিল হয়েছে।আদিবাসীদের তৈরী করা পলাশ ফুলে গাঁথা মালা গলায় পরে, মাথায় গোঁজা লাল-হলুদ পলাশফুল। সুন্দর সাজে সজ্জিত হয়ে এখানকার আশ্রমিক মেয়েদের রূপ যেন দ্বিগুনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এরকম সুন্দর পোশাক আর তার সাথে রঙিন ফাগের রঙে নিজেদের সাজিয়ে তারা এক মনমুগ্ধকর পরিবেশ উপহার দিচ্ছিল দর্শনার্থীদের। বেশিরভাগ পর্যটকরাই রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনকে ভালোবেসে কত দূর দূর থেকে এই উৎসবে সামিল হতে আসে। কবিগুরুর "গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ " এই দিন যেন আরো রাঙিয়ে উঠে।
![]() |
দইওয়ালা |
![]() |
বাচ্চা শিব |
এখানে সারাদিনই নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যেবেলাতে শান্তিনিকেতনের বেশ কয়েক জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গান ও নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও আবার রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যও পরিবেশন করা হয়।
এখানকার এক অধ্যাপকের সাথে আলাপচারিতায় জানলাম কবিগুরু ১৯৪০ সালে অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর আগের বছর শেষবার শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪১ সালে তাঁর অসুস্থতার কারণে তিনি এখানে আসতে পারেননি।
![]() |
কালো বাড়ির সামনে আমি ও গৌতমদা |
এখানে নাচের তালে তালে, গানের সুরে সুরে যেন আকাশে ওড়ে ফাগুয়ার রং। রঙিন মনে তখন শুধুই আনন্দের ফোয়ারা ওঠে। সবমিলিয়ে শান্তিনিকেতনের দোল দেখার জন্য বাঙালি কেন বারে বারে এখানে ছুটে আসে তা এই দিনে এখানে না আসলে বুঝতে পারতাম না। তাই দেশী পর্যটকদের সাথে বহু বিদেশী পর্যটক কত সুদূর পথ পেড়িয়ে এখানে আসেন। তারা উপভোগ করে যান কবিগুরুর বসন্তউৎসবের মেজাজটাকে। মনে খুশীর হিল্লোল, আনন্দের প্রাপ্তি যেন ফুটে উঠছে সকল আশ্রমিক ও পর্যটদের মুখে। এ যেন এক বসন্তের পরম পাওনা, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই ডিজিটাল যুগেও এখানে রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষজন তা সে এখানকার আশ্রমিক ছাত্র-ছাত্রী হোক বা অধ্যাপক হোক, একবারের জন্য কেউ রবীন্দ্রনাথের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন না। এখানে বসন্ত উৎসব তাই আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এই উৎসব যেন এক ভালোবাসার পরশ ও উপলব্ধির মেলবন্ধন। বর্তমানে এই ধরণের মেলবন্ধনের উৎসব খুব প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হয়।
কিভাবে যাবেন :
হাওড়া স্টেশন থেকে গণদেবতা, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ও আরো অনেকগুলো ট্রেন রয়েছে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকেও মাতারা এক্সপ্রেস ও আরো কয়েকটি ট্রেন রয়েছে। এইসব ট্রেনে করে বোলপুর স্টেশনে এসে নামুন। সময় মোটামুটি ঘন্টা তিনেকের মতো লাগবে। বোলপুর স্টেশন থেকে অটো বা রিক্সা করে আশ্রম মাঠে আসুন।
কোথায় থাকবেন :
বোলপুর, শান্তিনিকেতনে অনেকগুলো বেসরকারি লজ রয়েছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের একটা সুন্দর অতিথি নিবাস রয়েছে। এইসব লজ বা অতিথি নিবাসে এইসময় এসে থাকতে চাইলে অন্তত তিন-চার মাস আগে থেকে বুকিং করতে হবে।
তারিখ : ১৫-০৩-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
1 comment:
Fantastic writeup
Post a Comment