Sunday, March 24, 2019

গেঁওখালী ভ্রমণ Geokhali >


ত্রিবেণী সঙ্গম 



ত্রিবেণী অর্থাৎ তিনটি নদীর মিলনস্থল। ত্রিবেণী সঙ্গম বলতে আমরা প্রথমেই বুঝি এলাহাবাদ বা প্রয়াগরাজের ত্রিবেণী সঙ্গমকে।  এখানে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এই তিনটি  নদীর মিলন ঘটেছে।  হিন্দু ধর্মে এই জায়গাটা খুবই পবিত্র। এটা এক তীর্থস্থান। কিন্তু আমাদের কলকাতার খুব কাছেই আর একটা
গেঁওখালীতে গঙ্গার দৃশ্য 
ত্রিবেণী সঙ্গম রয়েছে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা ও তিনটি নদীর মিলনস্থলই  হল এই ত্রিবেণী সঙ্গম। হাওড়ার দিক থেকে আসা রূপনারায়ণ নদী, মেদিনীপুরের দিক থেকে আসা হুগলী নদী  আর ঝাড়খন্ড থেকে আসা হুগলি জেলা হয়ে  দামোদর নদ এই স্থানেই এসে মিলিত হয়েছে। এই তিনটি নদী এক হয়ে হুগলী নদী নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এই মিলনস্থলের তিন দিকে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা অবস্থিত। এই তিনটি  জেলা হল পূর্বদিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ দিকে হাওড়া ও পশ্চিম দিকে পূর্ব মেদিনীপুর। এই মিলন স্থলের দুই পাড়ে  দুইটি সুন্দর বেড়ানোর জায়গা রয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের পাড়ে গেঁওখালী আর হাওড়ার পাড়ে গাদিয়ারা। এ যেন একই মায়ের পেট থেকে বেড়োনো যমজ সন্তান। আজ আমি শুধু পূর্ব মেদিনীপুরের গেঁওখালীর কথাই  আপনাদের বলব।  


পূর্ব  মেদিনীপুর হল পশ্চিমবঙ্গের এক সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক জেলা। এই জেলার পর্যটন ও পুরাতত্ত্বের কথা বহু বইয়ের বহু পাতায়  স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।  এই জেলায় যেমন সমুদ্র রয়েছে, তেমন প্রত্নতত্বের সম্ভারও রয়েছে। জেলার মহিষাদল ব্লকের একটা ছোট্ট গ্রাম হল গেঁওখালী। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই দেখার মত। প্রাচীনকালে বিদেশ  থেকে কলকাতা বা উড়িষ্যা আসতে  গেলে এই গেঁওখালীর কাছের  তাম্রলিপ্ত বন্দরকে ব্যবহার করতে হত। শোনা যায় ১৮৮৮ সালে খ্রিস্টান ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরী সাহেব এই গেঁওখালীতে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন। ইতিহাসবিদরা বলেন বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারত ভ্রমণের সময়ে এই অঞ্চলেরই তাম্রলিপ্ত বন্দরকেই ব্যবহার করেছিলেন। গত রবিবার  আমি ও বিনীতদা (শ্রী বিনিতেন্দ্র চৌধুরী) দুজনে ছবি তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে  গেঁওখালী পর্যটনে গিয়েছিলাম।

গেঁওখালী ফেরী ঘাটের পথে লঞ্চ 

অন্যান্য ভ্রমণ স্থানগুলোর মত গেঁওখালীতে সেরকম দর্শনীয়  হয়তো কিছু দেখতে পাবেন না। তবে এখানকার শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ আপনার মন কেড়ে নেবে।  গঙ্গার পাড় বরাবর রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনটাও আপনার স্নিগ্ধ হয়ে উঠবে। প্রভাতের সূর্যোদযের  মনভোলানো  দৃশ্য এখানকার  সবথেকে আকর্ষণীয়।শীতের সময় শীতের রুক্ষ পরিবেশের মধ্যে এখানে নদীর ধারে তৈরী করা চেয়ারগুলোতে বসে সূর্যোদয়ের মোহময়ী রূপ দেখতে খুবই ভালো লাগবে। নদীর ধারের সারিবদ্ধভাবে বড় বড় গাছগুলির ফাঁক দিয়ে কুয়াশায়  আবছাভাবে দেখতে পাওয়া পালতোলা ডিঙি নৌকো ও তার মাঝিদের দাঁড় বওয়ার  দৃশ্য দেখা  যেন এক পরম পাওয়া। 



গেঁওখালীতে গঙ্গার দৃশ্য
একটু বেলা বাড়লে সূর্যের আলোয় নদীর বুকে রোদ ঝিলমিল খেলা দেখতেও বেশ ভালো লাগে। শীতের সময় ভোরবেলায় টাটকা খেজুরের রস খাওয়া এক নতুন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে এই অঞ্চলটা একটু ঘুরে দেখতেও মন্দ লাগে না। দিগন্ত বৃস্তিত জলরাশি বয়ে চলেছে সাগরের পানে। কলকাতা থেকে মুহুর মুহুর আধুনিক জাহাজের  সমুদ্র যাত্রা  বা পাল তোলা নৌকোর যাতায়াত দেখতেও মন্দ লাগে না। শীতের সময় আপনার উরু উরু মনটাকে এখানে নিয়ে আসলে আশাকরি  ভরিয়ে তুলতে  পারবেন।

খাঁড়িতে মাঝি জাল বুনছে 

ফেরি ঘাটের পাশে একটা খাঁড়িতে  দেখলাম একজন মাঝি নৌকোতে বসে জাল বুনছে। এই দৃশ্যটা আমার কাছে একটা উপরি পাওনা হল।  প্রতি সোমবার ও শুক্রবার সকালে এখানে একটা হাট বসে। আমাদের মত  শহুরে লোকদের  কাছে এই গ্রামীণ হাট বেশ উপভোগ করার মত।  ফেরি ঘাটের কাছে নদীর চড়ে অনেকগুলো জাহাজের ভগ্নাবশেষও দেখতে পেলাম। গেঁওখালী থেকে দু-তিন  কিলোমিটার দূরে মীরপুর বলে একটা জায়গায়  একটা ফিরিঙ্গি পাড়া রয়েছে। এখনো সেখানে কয়েকটা ফিরিঙ্গি  পরিবার বসবাস করে। এই পাড়াতে একটা গির্জাও রয়েছে। এই গির্জার পাশে  বেশ সুন্দর একটা ফুলের বাগানও দেখতে পেলাম। আমাদের  রিক্সাওয়ালা অনন্ত বলল মহিষাদলের রাজারাই এখানে ফিরিঙ্গিদের জমি দান করেছিলেন। অনন্ত   আমাদের  বড়দিনের সময় এই ফিরিঙ্গি পাড়াতে একবার আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। সে বলছিল ওই সময় এখানকার  গির্জাটি ও পুরো পাড়াটিকে  খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। 

মহিষাদল রাজবাড়ী 

গেঁওখালী ঘুরে আপনি একটা টোটো গাড়ি ঠিক করে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে মহিষাদল রাজবাড়ী দেখে আসতে পারেন। গেঁওখালী থেকে মহিষাদল রাজবাড়ী যেতে মিনিট কুড়ি সময় লাগবে। রাজবাড়ীটি বেশ সুন্দর। এখানে দুটি রাজবাড়ী রয়েছে।  একটি হল ফুলবাগ রাজবাড়ী আর একটা হল ভগ্নপ্রায় রঙ্গীবসান রাজবাড়ী। ফুলবাগ রাজবাড়ীটি বেশ সুন্দর। এই বাড়িটির  এক  তলায় একটা সুন্দর সংগ্রহশালা রয়েছে। এই সংগ্রহশালাটি ও রঙ্গীবসান রাজবাড়ীটি  দেখে পাশেই  অবস্থিত গোপাল জীউ শিব মন্দিরগুলো দেখে নেবেন। আমার মহিষাদল রাজবাড়ী লেখায় এখানকার বিস্তারিত তথ্য পাবেন। এই রাজবাড়ীর  কিছুটা  দূরে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজরিত একটি কুটির রয়েছে। এই কুটিরটিও পারলে দেখে নেবেন। যদিও আমরা সময়ের অভাবে এই কুটিরটি দেখতে যাইনি। গেঁওখালী ও মহিষাদল ঘুরে আপনার হাতে যদি সময় থাকে তাহলে আপনি তমলুক শহরটিও একবার ঘুরে আসতে পারেন। বাসে আধ ঘন্টার মত সময় লাগবে গেঁওখালী থেকে তমলুক পৌঁছতে। তমলুকে আপনি রাজবাড়ী, তমলুক সংগ্রহশালা ও সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ বর্গভীমা মন্দিরটি দেখেতে পারেন।
 
নূরপুর ঘাট থেকে  নেওয়া
সূর্যাস্তের ছবি
 
   

আপনি ইচ্ছে করলে একদিনেই গেঁওখালী ঘুরে কলকাতায়  ফিরে  আসতে পারেন। এখানে রাত্রি যাপনের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। খুব সকালের বাস ধরতে পারলে সব কিছু দেখে রাতের মধ্যেই কলকাতায় ফিরে আসা যায়। আপনি যদি তমলুক ঘুরতে যান তাহলে আপনি তমলুক স্টেশন থেকেও খুব সহজেই ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশনে আসতে পারবেন। এই পথে অবশ্য ট্রেন একটু  কম  চলাচল করে। যাওয়ার আগে ট্রেনের সময়গুলো একটু জেনে গেলে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।  আপনার যাত্রাটাও বেশ সুখকর হবে।


কিভাবে যাবেন :
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাসে  করে ৬০ কিলোমিটার দূরে নূরপুর ফেরি ঘাটে এসে পৌঁছান। বাসে মোটামুটি ঘন্টা তিনেকের মতো সময় লাগবে। ওখান  থেকে লঞ্চে করে নদী পার হলেই গেঁওখালীতে পৌঁছানো যাবে। ফেরি সার্ভিস মোটামুটি  পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা অন্তর।নূরপুরের ঠিক উল্টোদিকে গেঁওখালী গ্রাম। এছাড়া আপনি হাওড়া স্টেশন থেকে হলদিয়াগামী ট্রেন ধরে সতীশ সামন্ত হল্ট স্টেশনে নেমে বাস বা অটো রিক্সা করে গেঁওখালী যেতে পারবেন। সতীশ সামন্ত স্টেশন থেকে গেঁওখালীর দূরত্ব ৮ কিলোমিটার।

কোথায় থাকবেন :
গেঁওখালীর কাছে রূপনারায়ণ নদীর ধারে সেচ দপ্তরের  একটা সুন্দর বাংলো আছে। এছাড়া হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের "ত্রিবেণী সঙ্গম টুরিস্ট কমপ্লেক্স" নামে একটা থাকার ব্যবস্থা আছে। এই দুটো জায়গাতেই রাত্রিবাসের সুবিধা রয়েছে।


তারিখ : ২৮-০৩-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


No comments: