Sunday, March 3, 2019

সংস্কৃতির সূতিকাগার Coffee House >

সাংস্কৃতির  সূতিকাগার 



দোতলার নিওসাইন বোর্ড 

"গল্প হচ্ছে মনের ম্যাসাজ, চিত্তের দলাই  মালাই, পড়লে মেজাজ চাঙ্গা হয়" 

উপরিউক্ত কথাগুলো বিখ্যাত  বাঙালি লেখক  রাজশেখর বসু তাঁর  একটা লেখায় বলেছিলেন। গল্প সম্পর্কে লেখক তাঁর মনের অভিব্যক্তি এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তিনি গল্পের বই পড়া সম্বন্ধেই এই উক্তিটি করেছিলেন, কিন্তু গল্প করার ক্ষেত্রেও উক্তিটি সমানভাবেই প্রযোজ্য বলেই  আমার মনে হয়।  সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একটু গল্প করলে বা একটু আড্ডা মারলে  ক্লান্ত মনের অবসন্নতা কিছুটা হলেও শিথিল হয়, মনটাও একটু ফুরফুরে হয়ে ওঠে।  আনন্দে আত্মহারা কিংবা  কষ্টে যখন কাতর হয়ে ওঠে মন, তখন মনও চায় বন্ধুদের সাথে মনের অভিব্যাক্তিটাকে একটু ভাগ করে নিতে। আড্ডাটা বাঙালি মননের অনিবার্য চাহিদা বা তৃষ্ণা। বাঙালি জীবনে আড্ডা মানে শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা বা  সমালোচনার ঝড় বওয়া। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে হোক বা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে হোক আড্ডার ভূমিকা বর্ণনাতীত। সেই প্রাচীনকাল থেকেই  আড্ডাপ্রিয় বাঙালির জীবনে আড্ডা একটা বিশাল ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে।  
ঢোকার মুখের বোর্ড 

এই আড্ডার সাথে যদি একটু চা-কফি বা মুড়ি-তেলেভাজার ব্যবস্থা থাকে তবে তো আড্ডাটা সর্বতোভাবে জমে উঠবেই। আজ আমি ও আমার এক বন্ধু শ্যামল তেমনি এক আড্ডারস্থলে গিয়েছিলাম কিছুটা সময় ব্যয় করার জন্য। যে আড্ডার জায়গা কত লেখকের বা কত কবির মনে কত বিচিত্র সব লেখার জন্ম দিয়েছে। আমি প্রায়দিনই কাজের জন্য শিয়ালদহ অঞ্চলে যাই। গত ২০ তারিখে আমার বন্ধু শ্যামল বই কিনতে কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ায় এসেছিল। আমায় ফোন করে কফি হাউসে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। কলেজ স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের গলিতেই বাঙালির প্রিয় কফি হাউসটি অবস্থিত। যার পোশাকি নাম "ইন্ডিয়ান কফি হাউস"। এখন অবশ্য অনেকে এটাকে মান্না দের কফি হাউসেও বলে থাকে। 
সিঁড়ির গাত্রে পোড়ামাটির টাইলস 


আমাদের শহরে বেশ কয়েকটি কফি হাউস আছে। কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউতে, কলেজ স্ট্রিটে, যাদবপুরে কফি হাউস আছে। এছাড়া দক্ষিণ কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলের সাথে আর একটা কফি হাউস তৈরী হয়েছিল, সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। যে বছর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, অর্থাৎ সেই ১৯৪১ সালেই সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের কফি হাউসটি তৈরী করা হয়েছিল। বর্তমানেও এটি সচল রয়েছে।  এটাই কলকাতার প্রথম কফি হাউস। এই কফি হাউসের কিছুদিন পরেই "ইন্ডিয়ান কফি বোর্ড" কলেজ স্ট্রিটের পাশে ১৫ নম্বর বঙ্কিম  চ্যাটার্জী স্ট্রীটের অ্যালবার্ট হলে এই   কফি হাউসটি খোলে। দীর্ঘদিন তারা এটা চালিয়েছে। ১৯৫৭ সালে কফি বোর্ডের  আওতা থেকে অ্যালবার্ট হলের এই কফি হাউসটি বেরিয়ে আসে। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৫৭ সাল থেকেই এখানকার কর্মচারীদের সমবায়ের  তত্ত্বাবধানে এটা চলে আসছে।  কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি স্কুল-কলেজ থাকায় সব সময়ই এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড় লেগেই থাকে। কলেজ স্ট্রিটেই  কলকাতার সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার থাকায় বইপ্রেমীদেরও এখানে দেখা মেলে। কলেজে স্ট্রিটের কফি হাউসটি কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি হাউস।
তিন তলা থেকে নেওয়া দোতলার হলটি 


এই অ্যালবার্ট হলটি বহু লেখক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, গায়ক, দেশি-বিদেশী পর্যটকদের আড্ডা দেওয়ার জায়গা। বহু ঐতিহাসিক জমায়েতের সাক্ষীও এই হলটি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও আরো কত কৃতী ব্যক্তিত্বরা এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়েছেন। আজ প্রায় ৭৫ বছরের পুরোনো এই কফি হাউসটি সব সময়েই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার স্থল হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। 


নিচের হল ঘরটি 
যথাসময়ে    কফি  হাউসের   সেই  পুরাতন  জরাজীর্ণ  ভবনটির   সামনে  এসে  দাঁড়ালাম।    শ্যামল আমার জন্য অপেক্ষা  করছিল।  প্রবেশদ্বারের ওপরে ইংরাজি হরফে "ইন্ডিয়ান কফি হাউস"  কথাটি  লেখা দুটি বোর্ড রয়েছে।  বন্ধুর  আহ্বানে কর্মস্থল  থেকে  হঠাৎ এসেছি বলে,  আজ আর আমার সাথে ক্যামেরাটা নেই, তাই চলমান ফোনে কয়েকটা  ছবি  তুললাম।  দুজনে   সিঁড়ি   বেয়ে  দোতলায়  উঠে দেখলাম একটা  নিওসাইন  বোর্ডে  বাংলা হরফে  লেখা  "কফি হাউস" কথাটি জ্বল জ্বল করছে।  তার পাশেই   আরো  একটা  বোর্ড  রয়েছে, তাতে  লেখা  আছে  খোলা-বন্ধের  সময়।  সিঁড়ির দেওয়ালটার  সামান্য অংশ ছাড়া নানারকম বিজ্ঞাপনে ভর্তি রয়েছে। এগুলো দেখে মনটা খুব খারাপ লাগল। এতো প্রাচীন  ঐতিহ্যশালী ভবনটি এরকমভাবে দৃশ্যদূষণ করা রয়েছে। এইসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা দুজনে ওপরে উঠে আসলাম। ওপরের একদিকের দেওয়ালে অবশ্য খুব সুন্দর পোড়ামাটির কাজ করা টাইলস লাগানো রয়েছে, এটা  দেখে  মনটা একটু  হলেও  খুশি  হল।  কফি  হাউসের
ঐতিহ্য 
ঐতিহ্যের সাথে গুলো  বেশ  মানিয়েছে    বলে  আমার  মনে  হল।    দরজা  দিয়ে  ভিতরে   ঢুকে  দেখলাম  লোকে লোকারণ্য।    সবাই   নিজেদের   মধ্যে গল্পে-আড্ডায় বেশ  মত্ত  হয়ে আছে।   তারা  নিজেদের মধ্যে গল্পে  এতটাই মোহিত  হয়ে আছে যে  কে ভিতরে  ঢুকচ্ছে, কে  ভিতর  থেকে বাইরে  আসছে  তাতে  তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। 
হল ঘরটির পিছন দিকের দেওয়ালে সুন্দর একটা  যুবক বয়সের বিশ্বকবি  রবীন্দ্রনাথের চিত্র  বাঁধিয়ে  রাখা  আছে।  এছাড়া বাকি  তিনদিকের দেওয়ালগুলিতেও  প্রায় দশ-বারোটার মতন  নানারকম অঙ্কনের চিত্র বাঁধিয়ে  রাখা আছে।  ডানদিকে খাবার তৈরির ঘর, তার পাশে  বেশ  বড়  একটা  কাউন্টার  করা  আছে।   এই  কাউন্টারের পাশে পুরুষদের একটা শৌচালয় আছে।  পুরো হল  ঘরটিতে  চার  বর্গফুটের  প্রচুর টেবিল পাতা রয়েছে। এই টেবিলগুলোর চার পাশে কোনোটায় তিনটে  আবার  কোনোটায়  চারটে  করে চেয়ার  পাতা আছে।  প্রত্যেকটা টেবিলে একটা করে রঙিন মেনু কার্ড রাখা আছে। এখানে  বসার কোনো  জায়গা  খালি  নেই, তাই আমরা  অপেক্ষা  করছিলাম।  একজন  ওয়েটার  এসে  বলল তিনতলায়  চলে যান ওখানে দু-তিনটি টেবিল খালি আছে। আমরা আবার সিঁড়ি ভেঙে  তিনতলায় উঠে আসলাম।  ভিতরে  ঢুকে  দেখলাম  একটা  ছোট্ট হল ঘর। ঘরটি  বেশ  সুন্দর  করে   সাজানো,  তবে  নীচের ঘরটির   মতো  এত আলোকিত নয়।  এখানকার  দেয়ালগুলোতেও   বেশ কয়েকটি  অঙ্কণ বাঁধিয়ে রাখা আছে।  এই  ঘরটির  বেশ  কিছুটা  অংশ  অর্ধগোলাকারে  কাটা  রয়েছে, যেখান থেকে নীচের হল  ঘরটির বেশিভাগ অংশই দেখা যাচ্ছে। এখানে  আমরা বসার একটা  জায়গা 
ওয়েটার গিরি 
পেয়েও  
গেলাম।  আমরা   বসতেই  সাদা  ইউনিফর্ম  ও  মাথায়  সুন্দর  রাজসিক  একটা পাকড়ী  পরা একজন  বয়স্ক  লোক  এসে  কি  খাব       তা    জানতে  চাইল।   আমরা   সামান্য   স্ন্যাকস   ও    দুকাপ  কফি  আনতে   বললাম।   সে  জানাতে চাইলো  কি কফি আমরা  নেব সে  আরো বলল  এখানে কয়েকরকম  কফি পাওয়া যায়। সে  আমাদের মেনু  কার্ডটা  একবার দেখে  নিতে বললো। আমরা  সাধারণ  গরম  কফি খেতে  চাইলাম  আর  সাথে বাটার টোস্ট নিয়ে আসতে বললাম।   সে আমাদের থেকে খাবারের কথা  জেনে নীচে নেমে গেলো, সম্ভবতঃ রান্নাঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর আমাদের কাঙ্খিত খাবার  নিয়ে এলো। এই অপেক্ষার সময় নীচের হলটির পরিবেশটা একটু চাক্ষুষ করছিলাম।  দেখলাম প্রচুর অল্প  বয়সী ছেলে-মেয়ে বেশিরভাগ টেবিলগুলোতে শোরগোল তুলছে।  একটা টেবিলে জনা দুয়েক  বিদেশিকেও দেখলাম  নিজেদের  মধ্যে গল্পে ব্যস্ত রয়েছে।  কয়েকজনকে আবার দেখলাম  মুঠি ফোনে নিজের ছবি তুলছে।  সামনের  একটা  টেবিলে  কয়েকজন  যুবক  রাজনীতি  নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি করছিল। যাইহোক,  খাবার এসে  যাওয়ায়  আমরা খেতে  আরম্ভ করলাম। শ্যামলকে দেখলাম নিজের মুঠি ফোনে  কারো  সাথে কথা  বলছে। খেতে খেতে আমি মান্না দের সেই  কিংবদন্তি  গানটার কথা ভাবছিলাম।  তিনি গেয়ে  গিয়েছিলেন   সাতটা  টেবিল  আজও আছে,  কফির  সাতটা  পেয়ালাও  ঠিক রয়েছে,  কিন্তু  তাঁর সেই  ছয়  বন্ধু  মইদুল, অমল,  ডিসুজা,  রমা রায়, নিখিলেশ  স্যান্যাল ও  সুজাতা আজ আর নেই। মান্না দেও কিছুদিন হল আমাদের  ছেড়ে  চলে গেছেন। তাঁরা এরকমই কোনো টেবিলে সাতজন  বসে  তিন  চার  ঘন্টা কতরকম  তর্ক  করে কাটাতেন।  গানটির  শেষ  ছত্রে  গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তুলে ধরেছিলেন অসাধারন কিছু সত্য কথা। 

" সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবুও আছে। 
সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই 
একই সেই বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি 
শুধু সেই সেদিনের মালি নেই 
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে 
কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায় 
কতজন এলো গেল কতজনই আসবে 
কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।" 

সত্যি কথা কত গুণীজনের পদধূলি মাখা এই কফি হাউসটি।  তাঁদের বেশিরভাগই আজ পৃথিবীর মায়া  ত্যাগ করে  চলে গেছেন।  নতুন নতুন কত বুদ্ধিজীবী বা গুণীজন রোজ  এখানে এসে আড্ডায় যোগ দিচ্ছেন, রোজ চলছে কত নতুন নতুন বিষয় নিয়ে কত নতুন নতুন মানুষের আড্ডা। জন্ম নিচ্ছে হয়তো আরো কত কবিতার বা উপনাস্যের খসড়া, তৈরী হচ্ছে হয়তো আরো কত নতুন গানের মুখরা। কিন্তু পুরানো আড্ডপ্রেমীরা বলেন কফি হাউসে এখন আর সেই সব সোনালী বিকেল আর নেই। তাঁরা এখানে আসলে পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান, পুরোনো মাধুর্যকে  খুঁজে পেতে চান। এভাবেই  নস্টালজিয়া ও আধুনিকতার লড়াই সারাক্ষণই চলতে থাকবে কফি হাউসে। আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলো। খাবারের দাম মিটিয়ে আমরা নীচে নেমে এলাম।  





তারিখ : ০৩-০৩-২০১৯
 লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
 আমার এই লেখাটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 






2 comments:

Tilak basu said...

Ramu Baad diyey coffee house hoi na.ramu Albert hall o Jadavpur er sobcheye sreshto waiter chilo.ekta video gaan eh taar chobi achhey

Tilak basu said...

Ramu Baad diyey coffee house hoi na.ramu Albert hall o Jadavpur er sobcheye sreshto waiter chilo.ekta video gaan eh taar chobi achhey