ভারতের চীনাদের স্মৃতিচিহ্ন
![]() |
মূল মন্দিরের প্রবেশদ্বার |
আপনি কি জানেন বাংলায় "চিনি" কথাটি কিভাবে এসেছিল? সেটা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ২৪০ বছর আগের এক ঘটনায়। বাংলায় তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ব্যবসা রমরমিয়ে চালাচ্ছে। বাংলার বড়লাট তখন ওয়ারেন হেস্টিংস। ১৭৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলার গভর্নর হিসেবে মনোনীত করে। পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য সমগ্র ভারতের গভর্নরও হয়েছিলেন। বাংলার গভর্নর হওয়ার পর তিনি কোম্পানির শাসন প্রণালীর যেমন সংস্কার করেছিলেন তেমন কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলেই ১৭৭৮ সাল নাগাদ চীন দেশ থেকে টং আছি নামে একজন চীনা ভদ্রলোক ব্যবসা করার উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতার খুব কাছে বজবজে তাঁর জাহাজ ভেড়ান। আমরা জানি হিউয়েন স্যাং বা ফা হিয়েন বহুকাল আগে চীন দেশ থেকেই ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তাঁরা শুধু ভ্রমণ করার উদ্দেশেই এই দেশে পা.দিয়েছিলেন। তাঁদের জাহাজও কিন্তু সেই আমলে বাংলার বুকে তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসে .ভিড়েছিল। তাঁরা পায়ে হেঁটেই ভারতের রূপ-রস উপভোগ করেছিলেন। কিন্তু টং আছি এই দেশে ভ্রমণ করতে আসেননি, তিনি ব্যবসা করতেই এসেছিলেন। তিনিই প্রথম চীনা ব্যবসায়ী যিনি ব্যবসায়ী হিসেবেই চীন দেশ থেকে ভারতের বুকে পা রেখেছিলেন।
তিনি চীনের ক্যান্টন নিবাসী একজন চায়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি কয়েকজন চীনা শ্রমিককেও সাথে করে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। টং আছি চীন দেশের একজন বিখ্যাত ইংরেজ
ব্যবসায়ী জেমস ফিল্টন সাহেবের কাছ থেকে একটা সুপারিশপত্র নিয়ে এসেছিলেন। বজবজে নেমে এখানকার নদীর ধারের জায়গাটা তাঁর বেশ মনে ধরল। এখানে আসার পর তিনি একদিন কলকাতায় এসে তদকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সাথে দেখা করলেন। তিনি মহামান্য গভর্নরকে জেমস ফিল্টনের সুপারিশপত্রটা দিলেন। তিনি নানারকম ব্যাবসায়িক আলোচনা করার সাথে সাথে হেস্টিংস সাহেবকে চায়ের গন্ধ ও স্বাদের কথা বললেন। তিনি হেস্টিংস সাহেবকেও জানালেন যে তিনি এখানে কোন চায়ের ব্যবসা করার জন্য আসেননি। তিনি বজবজে নদীর ধারে একটা সুগার কারখানা করতে চান। হেস্টিংস সাহেব তাঁর সাথে আলোচনা করে খুবই সন্তুষ্ট হলেন। চীনা ব্যবসায়ীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে হেস্টিংস সাহেব তাঁকে বজবজে নদীর ধারে ৬৫০ বিঘা জমির পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পাট্টা দেওয়া জমিটির খাজনা হিসেবে ৪৫ টাকা ধার্য করলেন। টং আছি সব কিছুতেই রাজি হয়ে গেলেন। সেই সময় ওই অঞ্চলের জমির মালিকানা ছিল বর্ধমানের মহারাজাদের হাতে। তদকালীন বর্ধমান মহারাজ গভর্নর হেস্টিংসের আদেশ অনুসারে ৬৫০ বিঘা জমির টঙের নামে লেখাপড়া করে দিলেন। টং তো বেজায় খুশি। সেই সময় বজবজের নদীর ধারটা জলা -জঙ্গলে ভর্তি ছিল। সেই জঙ্গল পরিষ্কার করার পরই তাঁর পক্ষে সুগার কারখানা তৈরী করা সম্ভব হবে। তিনি আবার তাঁর দেশে ফিরে গেলেন। সেখান থেকে প্রায় ১১০ জন চীনা শ্রমিককে নিয়ে আবার বজবজে আসলেন। এই চীনা শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করে জঙ্গল পরিষ্কার করলেন। তারপর টং আছি এখানে তাঁর সাধের সুগার কারখানা স্থাপন করলেন। এই কারখানা তৈরী করতে প্রায় তিন তিনটে বছর অতিক্রম করে গেল। অবশেষে ১৭৮১ সালে কারখানা চালু করা হলো। এই সুগার কারখানাটি থেকেই ভারতবর্ষের প্রথম চিনি উৎপাদন শুরু হলো। চীনা মালিকের তৈরী প্রথম সুগার কারখানা বলে "চিনি" শব্দটা লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। সেই থেকেই বাংলা ভাষায় "চিনি" শব্দটার প্রচলন হতে আরম্ভ করলো। এই চিনি কল স্থাপনের মাত্র তিন বছর পর টং আছি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সালটা ছিল ১৭৮৩। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সাধের চিনি কলটি বন্ধ হয়ে গেলো। এখানকার চীনা শ্রমিকরা নতুন কাজের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা ও তার আস -পাশের অঞ্চলগুলোতে। ১৮০০ সালের প্রথমদিকে ইংরেজ সরকার এই অঞ্চলের সমস্ত জমি নিলাম করে বিক্রি করে দিলেন। তারা কিন্তু আছির তৈরী করা চীনা মন্দিরটি ও তাঁর সমাধির জায়গাটিকে বিক্রি করেনি। তারা আছির সম্মানে এই অঞ্চলের নাম আছির নামে "আছিপুর" নামাঙ্কিত করল।
টং আছিই ভারতবর্ষের বুকে প্রথম চীনা ব্যাবসায়ী ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর দেখানো পথ ধরে চীন দেশের বহু প্রদেশ থেকে বহু চীনা ব্যবসায়ী ও শ্রমিক এখানে আসতে আরম্ভ করল। তাঁরা কলকাতার এক একটা জায়গায় একসাথে বেশ কয়েকজন করে থাকতে আরম্ভ করলেন। এই সব জায়গাগুলোতে তাঁরা তাঁদের মহল্লা বানাতে লাগলেন। চীনা মন্দির বানালেন বেশ কয়েক জায়গায়। এইভাবেই ভারতের বুকে চীনা উপনিবেশ গড়ে উঠতে লাগল।
আছিপুরের মন্দির ও টং আছির সমাধির স্থান সেই আমলে প্রবাসী চীনাদের একমাত্র পূজা করার জায়গা ছিল। বর্তমানে টেরিটি বাজার অঞ্চলের চীনারা নিজেদের উপার্জিত অর্থে এখানকার সংস্কার ও রক্ষণবেক্ষণ করে থাকে। আমরা প্রথমেই মন্দিরটির সামনে এসে পৌঁছলাম। বেশ সুন্দর ও বড় একটা প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারটি চীনা স্থাপত্যের এক নিদর্শন। প্রবেশদ্বারটি সবুজ ও লাল রঙে রাঙানো। এই প্রবেশদ্বারের ওপরের দিকে লেখা আছে কলকাতার "গি হিং চার্চ এন্ড ক্লাব" তারাই এই মন্দিরটির দেখভাল করে। এটি মন্দিরটির একমাত্র প্রবেশ পথ। প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার পর দেখলাম বিশাল একটা খালি জায়গা রয়েছে। এই খালি জায়গাটিকে হলুদ ও লাল রঙের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। খালি জায়গাটির ডানদিকে একটা ছোট চীনা মন্দির আর বাঁদিকে একটা ঘেরা পুস্করিণী আছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা দুপুর বেলায় গিয়েছিলাম বলে মূল মন্দিরটি খোলা পাইনি। মন্দিরটি সকাল ও বিকেলে খোলা হয় মাঝে দুপুরবেলায় বন্ধ থাকে। মূল প্রবেশদ্বারের পাশে একজন বয়স্ক লোক বসে বিড়ি বাঁধছিলেন। তার কাছ থেকে শুনলাম মন্দিরটি দেখাশুনা করেন গোপাল নামে একজন যুবক। তিনি ওই যুবকের ফোন নাম্বার দিলেন আমরা তাকে ফোন করে অনুরোধ করলাম একবার যদি উনি এসে আমাদের মন্দিরটি দেখার ব্যবস্থা করে দেন। ওনাকে জানালাম আমরা কলকাতা থেকে এসেছি শুধু এই মন্দিরটি দেখার জন্য। উনি কিছুতেই রাজি হলেন না। আমাদের সব অনুরোধ বৃথা গেল। যাইহোক, কিছু করার ছিল না। বন্ধ মন্দিরটির প্রবেশের দরজার থেকে ভিতরের অংশে যা আছে তা দেখার চেষ্টা করলাম। সেরকম কিছুই দেখতে পেলাম না।
পাশের ওই বয়স্ক ভদ্রলোকটির কাছে এখানকার সব কিছু জানার চেষ্টা করলাম। উনি আমাদের বললেন মন্দিরটির ভিতরের স্তম্ভগুলোতে খুব সুন্দর কাঠের কাজ করা আছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে একজোড়া চীনা দেব-দেবী প্রতিষ্ঠিত আছে। এই দেব-দেবী নাকি টং নিজে চীন দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তবে এখানকার জনগণের কাছে এই দেব-দেবী "খুদা-খুদি" নামে পরিচিত। এই দেব-দেবীকে প্রসাদ হিসেবে নানারকম ফল দেওয়া হয়। ফলের সাথে ভাজা চিকেনও দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় পূজা করা হয়। পূজার সময় চীনা ধুপ জ্বালান হয়। এই ধুপ নাকি চীন দেশ থেকে কলকাতা হয়ে এখানে আনা হয়। তিনি বললেন তাঁর ছোটবেলায় তিনি এই অঞ্চলে বেশ কিছু চীনা পরিবারকে বসবাস করতে দেখেছেন। এখন কোনো চীনা পরিবার আর এই অঞ্চলে থাকে না। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী মাসে এখানে মেলা বসে। সেই সময় এখানে রবিবারে বা ছুটির দিনগুলোতে কলকাতা থেকে প্রচুর চীনা পরিবার এখনও পুজো দিতে আসে। মন্দিরের সামনের রাস্তাটি তখন গাড়িতে ভর্তি হয়ে যায়।
তাঁর ছোট বেলায় তিনি এইসব দিনগুলোতে প্রায় এক-দেড় হাজার লোককে এখানে আসতে দেখেছেন। বর্তমানে একশো-দেড়শোর মত লোক আসে। তিনি বললেন ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে চীনা নববর্ষের সময় এখানে মেলা বসে। সেই সময় এখানে বেশ ঘটা করে কালী পুজো করা হয়ে থাকে। সেইদিনও এখানে প্রচুর চীনা পরিবারের সমাগম হয়। তিনি আমাদের ওই সময় একবার এখানে আসতে বললেন। তিনি এও বললেন ওই সময় আসলে আসল আছিপুরকে দেখতে পাওয়া যাবে।
তিনি আমাদের দক্ষিণরায়ের মন্দির ও গঙ্গার পাড়ে টং আছির সমাধিস্থলটি দেখে আসতে বললেন। কিন্তু প্রথম থেকেই ভাগ্য আমাদের সহায়তা করছিল না। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। এখন আকাশ কালো করে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলো। আমদের বাধ্য হয়েই ওখান থেকে ফিরে আসতে হল। পরে আবার একবার আসবো বলে মনে মনে ভেবে রাখলাম। ঝড়-বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা স্টেশনের পথ ধরলাম।
আছিপুর দেখে অটো করে বজবজ স্টেশনে নেমে একটু হেঁটে চলে আসুন বজবজ ফেরি ঘাটে। এই সেই ঘাট যেখানে ১৮৯৭ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগো থেকে এসে নেমেছিলেন। এই ঘাটের ধারে একটা সুন্দর কালী মন্দির আছে। ওই মন্দিরটি অবশ্যই দেখে নেবেন। ঘাটের কাছেই একটা বিখ্যাত শহীদ স্তম্ভও আছে। স্তম্ভটিকে "কমাগাতামারু শহীদ স্তম্ভ" বলা হয়। এটা একটা ঐতিহাসিক স্তম্ভ। এই স্তম্ভের ইতিহাসটা পরে কোনো এক সময় বলা যাবে। বর্তমানে বজবজ স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে "কোমাগাথামারু" স্টেশন করা হয়েছে।
আছিপুর গ্রামটি আজও বেঁচে আছে টং আছির স্মৃতিকে বুকে নিয়ে। পশ্চিমবাংলার বুকে প্রথম চীনাদের না হওয়া এক উপনিবেশের গল্পে। বেঁচে আছে আজও ভারতের চায়না টাউনের সেই স্থপতির কাহিনীতে।
কিভাবে যাবেন : শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রতিঘন্টায় একটা করে বজবজ লোকাল ছাড়ে।ওই ট্রেনে করে বজবজ স্টেশনে এসে নামুন। স্টেশনের বাইরে থেকে অটো রিক্সা পাওয়া যাবে। ওই অটো করে খুব সহজেই আছিপুর পৌঁছানো যায়। ট্রেনে এক ঘন্টার মতো সময় লাগবে আর অটোতে মিনিট কুড়ি সময় লাগবে।
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
ব্যবসায়ী জেমস ফিল্টন সাহেবের কাছ থেকে একটা সুপারিশপত্র নিয়ে এসেছিলেন। বজবজে নেমে এখানকার নদীর ধারের জায়গাটা তাঁর বেশ মনে ধরল। এখানে আসার পর তিনি একদিন কলকাতায় এসে তদকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সাথে দেখা করলেন। তিনি মহামান্য গভর্নরকে জেমস ফিল্টনের সুপারিশপত্রটা দিলেন। তিনি নানারকম ব্যাবসায়িক আলোচনা করার সাথে সাথে হেস্টিংস সাহেবকে চায়ের গন্ধ ও স্বাদের কথা বললেন। তিনি হেস্টিংস সাহেবকেও জানালেন যে তিনি এখানে কোন চায়ের ব্যবসা করার জন্য আসেননি। তিনি বজবজে নদীর ধারে একটা সুগার কারখানা করতে চান। হেস্টিংস সাহেব তাঁর সাথে আলোচনা করে খুবই সন্তুষ্ট হলেন। চীনা ব্যবসায়ীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে হেস্টিংস সাহেব তাঁকে বজবজে নদীর ধারে ৬৫০ বিঘা জমির পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পাট্টা দেওয়া জমিটির খাজনা হিসেবে ৪৫ টাকা ধার্য করলেন। টং আছি সব কিছুতেই রাজি হয়ে গেলেন। সেই সময় ওই অঞ্চলের জমির মালিকানা ছিল বর্ধমানের মহারাজাদের হাতে। তদকালীন বর্ধমান মহারাজ গভর্নর হেস্টিংসের আদেশ অনুসারে ৬৫০ বিঘা জমির টঙের নামে লেখাপড়া করে দিলেন। টং তো বেজায় খুশি। সেই সময় বজবজের নদীর ধারটা জলা -জঙ্গলে ভর্তি ছিল। সেই জঙ্গল পরিষ্কার করার পরই তাঁর পক্ষে সুগার কারখানা তৈরী করা সম্ভব হবে। তিনি আবার তাঁর দেশে ফিরে গেলেন। সেখান থেকে প্রায় ১১০ জন চীনা শ্রমিককে নিয়ে আবার বজবজে আসলেন। এই চীনা শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করে জঙ্গল পরিষ্কার করলেন। তারপর টং আছি এখানে তাঁর সাধের সুগার কারখানা স্থাপন করলেন। এই কারখানা তৈরী করতে প্রায় তিন তিনটে বছর অতিক্রম করে গেল। অবশেষে ১৭৮১ সালে কারখানা চালু করা হলো। এই সুগার কারখানাটি থেকেই ভারতবর্ষের প্রথম চিনি উৎপাদন শুরু হলো। চীনা মালিকের তৈরী প্রথম সুগার কারখানা বলে "চিনি" শব্দটা লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। সেই থেকেই বাংলা ভাষায় "চিনি" শব্দটার প্রচলন হতে আরম্ভ করলো। এই চিনি কল স্থাপনের মাত্র তিন বছর পর টং আছি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সালটা ছিল ১৭৮৩। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সাধের চিনি কলটি বন্ধ হয়ে গেলো। এখানকার চীনা শ্রমিকরা নতুন কাজের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা ও তার আস -পাশের অঞ্চলগুলোতে। ১৮০০ সালের প্রথমদিকে ইংরেজ সরকার এই অঞ্চলের সমস্ত জমি নিলাম করে বিক্রি করে দিলেন। তারা কিন্তু আছির তৈরী করা চীনা মন্দিরটি ও তাঁর সমাধির জায়গাটিকে বিক্রি করেনি। তারা আছির সম্মানে এই অঞ্চলের নাম আছির নামে "আছিপুর" নামাঙ্কিত করল।
![]() |
মন্দিরের বন্ধ দরজা |
টং আছিই ভারতবর্ষের বুকে প্রথম চীনা ব্যাবসায়ী ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর দেখানো পথ ধরে চীন দেশের বহু প্রদেশ থেকে বহু চীনা ব্যবসায়ী ও শ্রমিক এখানে আসতে আরম্ভ করল। তাঁরা কলকাতার এক একটা জায়গায় একসাথে বেশ কয়েকজন করে থাকতে আরম্ভ করলেন। এই সব জায়গাগুলোতে তাঁরা তাঁদের মহল্লা বানাতে লাগলেন। চীনা মন্দির বানালেন বেশ কয়েক জায়গায়। এইভাবেই ভারতের বুকে চীনা উপনিবেশ গড়ে উঠতে লাগল।
![]() |
আছিপুরের গঙ্গা |
![]() |
আছিপুরের ফেরি ঘাট |
পাশের ওই বয়স্ক ভদ্রলোকটির কাছে এখানকার সব কিছু জানার চেষ্টা করলাম। উনি আমাদের বললেন মন্দিরটির ভিতরের স্তম্ভগুলোতে খুব সুন্দর কাঠের কাজ করা আছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে একজোড়া চীনা দেব-দেবী প্রতিষ্ঠিত আছে। এই দেব-দেবী নাকি টং নিজে চীন দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তবে এখানকার জনগণের কাছে এই দেব-দেবী "খুদা-খুদি" নামে পরিচিত। এই দেব-দেবীকে প্রসাদ হিসেবে নানারকম ফল দেওয়া হয়। ফলের সাথে ভাজা চিকেনও দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় পূজা করা হয়। পূজার সময় চীনা ধুপ জ্বালান হয়। এই ধুপ নাকি চীন দেশ থেকে কলকাতা হয়ে এখানে আনা হয়। তিনি বললেন তাঁর ছোটবেলায় তিনি এই অঞ্চলে বেশ কিছু চীনা পরিবারকে বসবাস করতে দেখেছেন। এখন কোনো চীনা পরিবার আর এই অঞ্চলে থাকে না। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী মাসে এখানে মেলা বসে। সেই সময় এখানে রবিবারে বা ছুটির দিনগুলোতে কলকাতা থেকে প্রচুর চীনা পরিবার এখনও পুজো দিতে আসে। মন্দিরের সামনের রাস্তাটি তখন গাড়িতে ভর্তি হয়ে যায়।
![]() |
মন্দিরের পুস্করিণী |
তিনি আমাদের দক্ষিণরায়ের মন্দির ও গঙ্গার পাড়ে টং আছির সমাধিস্থলটি দেখে আসতে বললেন। কিন্তু প্রথম থেকেই ভাগ্য আমাদের সহায়তা করছিল না। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। এখন আকাশ কালো করে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলো। আমদের বাধ্য হয়েই ওখান থেকে ফিরে আসতে হল। পরে আবার একবার আসবো বলে মনে মনে ভেবে রাখলাম। ঝড়-বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা স্টেশনের পথ ধরলাম।
আছিপুর দেখে অটো করে বজবজ স্টেশনে নেমে একটু হেঁটে চলে আসুন বজবজ ফেরি ঘাটে। এই সেই ঘাট যেখানে ১৮৯৭ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগো থেকে এসে নেমেছিলেন। এই ঘাটের ধারে একটা সুন্দর কালী মন্দির আছে। ওই মন্দিরটি অবশ্যই দেখে নেবেন। ঘাটের কাছেই একটা বিখ্যাত শহীদ স্তম্ভও আছে। স্তম্ভটিকে "কমাগাতামারু শহীদ স্তম্ভ" বলা হয়। এটা একটা ঐতিহাসিক স্তম্ভ। এই স্তম্ভের ইতিহাসটা পরে কোনো এক সময় বলা যাবে। বর্তমানে বজবজ স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে "কোমাগাথামারু" স্টেশন করা হয়েছে।
আছিপুর গ্রামটি আজও বেঁচে আছে টং আছির স্মৃতিকে বুকে নিয়ে। পশ্চিমবাংলার বুকে প্রথম চীনাদের না হওয়া এক উপনিবেশের গল্পে। বেঁচে আছে আজও ভারতের চায়না টাউনের সেই স্থপতির কাহিনীতে।
কিভাবে যাবেন : শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রতিঘন্টায় একটা করে বজবজ লোকাল ছাড়ে।ওই ট্রেনে করে বজবজ স্টেশনে এসে নামুন। স্টেশনের বাইরে থেকে অটো রিক্সা পাওয়া যাবে। ওই অটো করে খুব সহজেই আছিপুর পৌঁছানো যায়। ট্রেনে এক ঘন্টার মতো সময় লাগবে আর অটোতে মিনিট কুড়ি সময় লাগবে।
তারিখ : ২০-০৩-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment