প্রিন্সেপ ঘাট - এক কথায় অসাধারণ
![]() |
জেমস প্রিন্সেসের স্মৃতিসৌধ |
১৭৭৫ সালে প্রথম সাহেবি জাহাজ কলকাতার চাঁদপাল ঘাটে এসে ভিড়েছিল। সেই জাহাজে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ বিচারপতি এসেছিলেন । এই কলকাতাই তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। এখানেই তখন ভারতের প্রথম বিচারালয় তৈরী করা হয়েছিল। সেই বিচারালয়ে যোগদান করতেই বিচারপতিরা এখানে এসেছিলেন।তখন চাঁদপাল ঘাটেই সব জাহাজ এসে ভিড়তো। এই চাঁদপাল ঘাটটি বর্তমান বাবু ঘাটের কিছুটা উত্তরদিকে আছে। যত বড়লাট, যত ব্রিটিশ সরকারের উর্ধতন ব্যক্তিত্ব সেই আমলে যাঁরা কলকাতায় আসতেন, সবাই এই চাঁদপাল ঘাটটিকে ব্যবহার করতেন।
![]() |
নৌকার সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে |
১৮২০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ইংল্যান্ড থেকে চাঁদপাল ঘাটেই এসে নেমেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ নামে এক যুবক। তিনি কলকাতার টাঁকশালে সহকারী ধাতু পরীক্ষক(Assey Master) হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁর এই শহরে পদার্পন। এই পদে তিনি মাত্র এক বছর কলকাতায় ছিলেন। তারপর তিনি নতুন টাঁকশাল খোলার জন্য কাশীতে চলে যান। কাশীতে টাঁকশাল, একটা গির্জা ও একটা সেতু তাঁরই হাতে তৈরী হয়। কাশীতে থাকাকালীন তিনি কাশী উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য ও সম্পাদকও হয়েছিলেন। ১৮২২ সালে তাঁর নেতৃত্বে কাশীর উপর একটা সার্ভে করা হয়েছিল। সেই সময় তিনি এই সার্ভে রিপোর্টের সাথে একটা মানচিত্র এঁকে দিয়েছিলেন। এই মানচিত্রটি ১৮৩০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল। মানচিত্রটি প্রাচীন কাশীর একটা দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। গবেষকদের কাছে এই মানচিত্রটি খুবই উপযোগী। তিনি ডেপুটি এসে মাস্টার (Deputy Assey Master) হিসেবে আবার কলকাতার টাঁকশালে ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে এখানকার টাঁকশালেই তিনি আশে মাস্টার (Assey Master) হন। তিনি "ভিউস এন্ড ইলাসস্ট্রেশনস অফ বেনারস" (Views and Illastrations of Benaras) নামে একটা বই লেখেন। "গ্ল্যানিংস অফ সায়েন্স" (Gleanings of Science) নামে একটা সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই সাময়িক পত্রিকাটিই পরবর্তীকালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩২ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক ছিলেন। কলকাতার সার্কুলার খালটি তাঁরই তত্ত্বাবধানে কাটানো হয়েছিল। তিনি নানারকম বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর জীবনের সর্বশেষ্ঠ কাজ হলো সম্রাট অশোকের প্রস্তর স্তম্ভে ও পর্বতগাত্রে খোদিত লিপিগুলোর পাঠোদ্ধার করা। জেমস প্রিন্সেপ মাত্র ৪১ বছর বয়সে ২২শে এপ্রিল ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে মারা যান।
![]() |
গঙ্গার ধারের রাস্তা |
বিশাল জায়গা নিয়ে স্মৃতিসৌধটি তৈরী করা হয়েছে। সৌধটির সামনে বেশ বড় খালি জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা রয়েছে। এই জায়গাটিতে একটি মা ও বাচ্চা হাতির মূর্তি করে রাখা আছে।জেমস প্রিন্সেপের সমাধিসৌধ বা স্মৃতিসৌধটি একটি অসাধারন স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে সৌন্দর্যের এক অপরূপ সংমিশ্রণ। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন। সৌধটির গা ঘেসেই গড়ে উঠেছে ঝুলন্ত বিদ্যাসাগর সেতু বা দ্বিতীয় হুগলী সেতু। ১৯৯২ সালের ১০ই অক্টোবর এই সেতুটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই সেতুর তারগুলি স্মৃতি সৌধটিকে যেন একটা নতুন রূপ দিয়েছে। ব্রিটিশ স্থাপত্যের সাথে ভারতীয় স্থাপত্য মিলেমিশে এক হয়ে গেছে এখানে। এখান থেকে একটু এগেলেই একটা রেল লাইন পড়ে। এই লাইনটিতে চক্ররেল চলাচল করে।
![]() |
প্রিন্সেপ ঘাট স্টেশন |
![]() |
সূর্যাস্তের দৃশ্য |
সন্ধ্যার মুখে যখন সূর্যটা সোনালী থালা হয়ে পশ্চিমপাড়ে হেলতে শুরু করে, তখন নদীর বুকে একটা মোহময়ী রূপ তৈরী হতে দেখা যায়। প্রিন্সেপ ঘাটের বেঞ্চে বসে এই মোহময়ী রূপ দেখা বেশ রোমাঞ্চকর। সন্ধ্যার পর আলোকিত সৌধটিকেও দেখতে ভারী সুন্দর লাগে।
![]() |
দ্বীপ দীপাবলিতে ঘাট সাজানো হচ্ছে |
নামিদামি ব্যক্তিত্বকে দেখছিলাম সমগ্র অনুষ্ঠানটা অতিথি আসনে বসে উপভোগ করছেন। উত্তরীয় দিয়ে কয়েকজন বিশেষ অতিথিকে বরণ করা হয়। ওই নৌকোগুলো থেকে মাঝে মাঝেই ফানুস ছাড়া হচ্ছিল। ঘাট চত্বরটা বেশ একটা উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল।
প্রিন্সেপ ঘাট ও স্মৃতিসৌধটি ঘুরলে আপনার জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরী করে রাখবে। সারাদিনই এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত যুবক-যুবতী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই এখানকার মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে আসে। প্রিয় শহরের বুকেই রয়েছে গড়ে ওঠা এমন একটি জায়গা যেখানে পৌঁছলে সব ক্লান্তি দূর হতে বাধ্য। নয়নাভিরাম দৃশ্যের সাথে এক ঝলক নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে চাইলে অবশ্যই চলে আসুন প্রিন্সেপ ঘাটে।
কিভাবে যাবেন :
ধর্মতলা থেকে বাবুঘাটগামী বাসে করে বাবুঘাটে এসে নামুন। বাবুঘাট থেকে পায়ে হেঁটে মাত্রা আট মিনিটে পৌঁছে যাবেন।
তারিখ : ০২-০৩-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
2 comments:
Amazing use of words!
Great work.
Good information
Post a Comment