Saturday, March 2, 2019

প্রিন্সেপ ঘাট এককথায় অসাধারণ (Princep Ghat) >

প্রিন্সেপ ঘাট - এক কথায় অসাধারণ 


জেমস প্রিন্সেসের স্মৃতিসৌধ 
শহর কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে কত ইতিহাস, কত স্থাপত্য, কত ঐতিহ্য  দেশি বিদেশী ঐতিহাসিকরা  প্রায়ই এখানে গবেষণার কাজে  আসেন।  আমাদের শহরের  ইতিহাসের গল্পতো ভারতের প্রাচীনতম ইতিহাসেরই একটা অংশ। তার খোঁজে তো ঐতিহাসিকরা ভিড় জমাবেনই। শুধু কি ইতিহাসের খোঁজ করেন তাঁরা, না সাথে এখানকার ঐতিহ্য যেমন দেখেন, তেমন এখানকার দর্শনীয় জায়গাগুলোও উপভোগ করেন। এইসব ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থানগুলোর টানে শুধু ঐতিহাসিকরা নন, পৃথিবীর বহু দেশ থেকে বহু পর্যটকও  ভিড় করেন এখানে। আমাদের দেশের পর্যটকরা তো  ধর্ম ও ইতিহাসের টানে বার বার এখানে আসেন। এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো আজ পুরোনো কলকাতার স্মৃতিকে  বহন করে চলেছে  গঙ্গার বুকে গড়ে ওঠা প্রিন্সেপ ঘাট তেমনই এক ঐতিহাসিক  নিদর্শন।



১৭৭৫ সালে প্রথম সাহেবি জাহাজ কলকাতার চাঁদপাল ঘাটে এসে ভিড়েছিল। সেই জাহাজে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ  বিচারপতি এসেছিলেন । এই কলকাতাই তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। এখানেই তখন ভারতের প্রথম বিচারালয়  তৈরী করা হয়েছিল। সেই বিচারালয়ে যোগদান করতেই বিচারপতিরা এখানে এসেছিলেন।তখন চাঁদপাল ঘাটেই সব জাহাজ এসে ভিড়তো। এই চাঁদপাল ঘাটটি বর্তমান বাবু  ঘাটের কিছুটা উত্তরদিকে আছে। যত বড়লাট, যত ব্রিটিশ সরকারের উর্ধতন ব্যক্তিত্ব সেই আমলে যাঁরা কলকাতায় আসতেন, সবাই এই চাঁদপাল ঘাটটিকে  ব্যবহার করতেন।

নৌকার সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে  

১৮২০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ইংল্যান্ড থেকে চাঁদপাল ঘাটেই এসে নেমেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ নামে এক যুবক। তিনি কলকাতার টাঁকশালে সহকারী ধাতু পরীক্ষক(Assey Master) হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।  তাই তাঁর এই  শহরে পদার্পন। এই পদে তিনি মাত্র এক বছর কলকাতায় ছিলেন। তারপর তিনি নতুন টাঁকশাল খোলার জন্য কাশীতে চলে যান। কাশীতে টাঁকশাল, একটা গির্জা ও একটা সেতু তাঁরই  হাতে তৈরী হয়। কাশীতে থাকাকালীন তিনি কাশী  উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য ও সম্পাদকও হয়েছিলেন। ১৮২২ সালে তাঁর নেতৃত্বে কাশীর উপর একটা সার্ভে করা হয়েছিল। সেই সময় তিনি এই সার্ভে  রিপোর্টের সাথে একটা মানচিত্র এঁকে দিয়েছিলেন। এই মানচিত্রটি ১৮৩০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল।  মানচিত্রটি প্রাচীন কাশীর একটা দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। গবেষকদের কাছে এই মানচিত্রটি খুবই উপযোগী। তিনি ডেপুটি এসে মাস্টার (Deputy Assey Master) হিসেবে আবার কলকাতার টাঁকশালে ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে এখানকার টাঁকশালেই তিনি আশে  মাস্টার (Assey Master)  হন। তিনি  "ভিউস এন্ড ইলাসস্ট্রেশনস অফ বেনারস" (Views and Illastrations of Benaras) নামে একটা বই লেখেন। "গ্ল্যানিংস অফ সায়েন্স" (Gleanings of Science) নামে একটা সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই সাময়িক পত্রিকাটিই পরবর্তীকালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩২ থেকে ১৮৩৮ সাল  পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক ছিলেন।  কলকাতার সার্কুলার খালটি তাঁরই তত্ত্বাবধানে কাটানো হয়েছিল। তিনি নানারকম বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর  জীবনের সর্বশেষ্ঠ কাজ হলো সম্রাট অশোকের প্রস্তর স্তম্ভে  ও পর্বতগাত্রে খোদিত লিপিগুলোর পাঠোদ্ধার করা। জেমস প্রিন্সেপ মাত্র ৪১ বছর বয়সে ২২শে এপ্রিল ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে  মারা যান।

গঙ্গার ধারের রাস্তা 
জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তদকালীন ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড  এডেনবরা ১৮৪১-৪২ সাল নাগাদ জেমস প্রিন্সেপের নামে একটি স্মৃতিসৌধ ও একটি  ঘাট তৈরী করেন। ব্রিটিশ যুগে তৈরী প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ঘাটটি কলকাতায় হুগলী  নদীর তীরে অবস্থিত। ঘাটের পাশেই  স্মৃতিসৌধ তৈরী রয়েছে।

বিশাল জায়গা নিয়ে স্মৃতিসৌধটি তৈরী করা হয়েছে। সৌধটির সামনে বেশ বড় খালি  জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা রয়েছে। এই জায়গাটিতে একটি মা ও বাচ্চা হাতির মূর্তি করে রাখা আছে।জেমস প্রিন্সেপের সমাধিসৌধ বা স্মৃতিসৌধটি একটি অসাধারন স্থাপত্যশৈলীর  সঙ্গে সৌন্দর্যের এক অপরূপ সংমিশ্রণ।  জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন। সৌধটির গা ঘেসেই  গড়ে উঠেছে ঝুলন্ত  বিদ্যাসাগর সেতু বা দ্বিতীয় হুগলী  সেতু। ১৯৯২ সালের ১০ই অক্টোবর এই সেতুটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই সেতুর তারগুলি স্মৃতি সৌধটিকে যেন একটা নতুন রূপ দিয়েছে। ব্রিটিশ স্থাপত্যের সাথে ভারতীয় স্থাপত্য মিলেমিশে এক হয়ে গেছে এখানে। এখান থেকে একটু এগেলেই একটা রেল লাইন পড়ে। এই  লাইনটিতে  চক্ররেল  চলাচল করে।

প্রিন্সেপ ঘাট স্টেশন 
পাশেই চক্র রেলের একটা স্টেশন আছে। স্টেশনটির নামও  "প্রিন্সেপ ঘাট"।  স্টেশনটি বেশ সুন্দর ও নিরিবিলি,  খুবই পরিষ্কার। চক্ররেলটি   সম্ভবত ১৯৮৪ সাল নাগাদ চালু করা হয়েছিল। ট্রেন লাইনটি পার হলেই হুগলী  নদীটি দেখা যায়।  এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল  লর্ড এডেনবরার তৈরী জেমস প্রিন্সেপের নামাঙ্কিত সেই ঘাটটি। ঘাটে অনেকগুলো নৌকো সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই নৌকোগুলো করেই মনোরম নৌবিহার করার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘাটটির সামনে বসার জন্য কয়েকটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। খুব হালকা আওয়াজে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে।  নদীকে সামনে রেখে এই বেঞ্চে বসে রবীন্দ্র সংগীত শোনার  অভিজ্ঞতা সারা জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত গড়ে তোলে।  নদীতে নামার ঘাটটি  খুব সুন্দর করে বাঁধানো আছে। আগের তুলনায় এখন প্রিন্সেপ ঘাটটিতে অনেক বদল ঘটে গেছে। এখানে সবুজায়ন ও সৌন্দর্য্যায়ন যেন হাতে হাত রেখেছে। নদীর ধারে কংক্রিটের রেলিং ও বাধাঁনো সুন্দর রাস্তা তৈরী করা হয়েছে।  পড়ন্ত  বিকেলে নদী তীরের সুন্দর বাঁধানো  রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটা খাবারের স্টল আছে।  এই স্টলগুলোতে বসে একটু খাবারের স্বাদ নিতেও মন্দ লাগে না।
সূর্যাস্তের দৃশ্য 

সন্ধ্যার মুখে যখন সূর্যটা সোনালী থালা হয়ে পশ্চিমপাড়ে হেলতে শুরু করে, তখন নদীর বুকে একটা মোহময়ী রূপ তৈরী  হতে  দেখা যায়। প্রিন্সেপ ঘাটের বেঞ্চে বসে এই মোহময়ী রূপ দেখা বেশ রোমাঞ্চকর। সন্ধ্যার পর আলোকিত সৌধটিকেও দেখতে ভারী সুন্দর লাগে।

দ্বীপ দীপাবলিতে ঘাট সাজানো হচ্ছে 
কার্তিক পূর্ণিমাতে বেনারসের ঘাটে যেমন  "দেব-দীপাবলী" উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তারই অনুকরণে গতবছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে প্রিন্সেপ ঘাটে কার্তিক পূর্ণিমার দিনেই প্রদীপ জ্বালিয়ে দেব-দীপাবলির প্রথম  অনুষ্ঠান করা হয়। কলকাতায় এই প্রথম এরকম গঙ্গা আরতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই দিন এই  ঘাটে  তিলধারণের জায়গা ছিল না। ঢাকের শব্দে, আলোকসজ্জায় ঘাটটাতে এক সুন্দর পরিবেশ তৈরী হয়েছিল। এখানে সেই দিন উত্তরপ্রদেশের বেনারসের দেব-দীপাবলির প্রতিচ্ছবি হয়ে যেন দেখা দিচ্ছিল। দেখছিলাম  এখানে প্রচুর লোক প্রদীপ জ্বালিয়ে শাল পাতার থালায় বসিয়ে নদীতে ভাসাচ্ছিল। ১০-১২টা নৌকোতে সেচ্ছাসেবক ও কিছু পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল। অনুষ্ঠানটার উদ্বোধন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী শ্রী শুভেন্দু অধিকারী মহাশয়। রাজনীতি, খেলাধুলা ও রুপোলি পর্দার কয়েকজন
নামিদামি ব্যক্তিত্বকে দেখছিলাম সমগ্র অনুষ্ঠানটা অতিথি আসনে বসে উপভোগ করছেন। উত্তরীয় দিয়ে কয়েকজন বিশেষ অতিথিকে বরণ করা হয়। ওই নৌকোগুলো থেকে মাঝে মাঝেই ফানুস ছাড়া হচ্ছিল। ঘাট চত্বরটা বেশ একটা উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল।

প্রিন্সেপ ঘাট ও স্মৃতিসৌধটি ঘুরলে আপনার জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরী করে রাখবে।  সারাদিনই এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত যুবক-যুবতী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই  এখানকার মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে আসে।  প্রিয় শহরের বুকেই রয়েছে গড়ে ওঠা  এমন একটি জায়গা যেখানে পৌঁছলে  সব ক্লান্তি দূর হতে বাধ্য।  নয়নাভিরাম দৃশ্যের সাথে এক ঝলক নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে চাইলে অবশ্যই চলে আসুন প্রিন্সেপ ঘাটে। 

কিভাবে যাবেন : 
ধর্মতলা থেকে বাবুঘাটগামী বাসে  করে বাবুঘাটে এসে নামুন। বাবুঘাট  থেকে পায়ে হেঁটে মাত্রা আট  মিনিটে পৌঁছে যাবেন।


তারিখ : ০২-০৩-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী



যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

2 comments:

Unknown said...

Amazing use of words!
Great work.

Koushik said...

Good information