রত্নাবলী রায়
তিনি বলেছেন "মনোসামাজিক অক্ষমতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই অপমানিত হন এবং নীরব থাকতে বাধ্য হন, কিন্তু আমি তা অস্বীকার করি। আমার কাজ হল মানুষজনকে তাদের মানবিকতা পুনরুদ্ধার করতে সহাযতা করা"। যারা নানাভাবে সামাজিক বলি হয়েছেন, তাদের নিয়ে ও সামাজিক উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় "ভালো আছি, ভালো থেকো" বলে একটা অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন।
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
আজ ৮ই মার্চ। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বের নারীরা আজকের দিনটা গত ৪৫ বছর ধরে তাদের দিন হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিনটি উদযাপনের পিছনে বহু নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে দিনটি ঘোষণা করেছিল।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই গোয়ালিয়রের মহারানী অহল্যাবাঈ বা অন্যান্য মহারানীরা সামাজিক উন্নতিকল্পে বহু অর্থ ব্যয় করেছিলেন। ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিটিশ বিরোধী সিপাহী বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজত্বকালে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি সমাজ সংস্কারক নারী জাতির উন্নয়নের জন্য লড়াই করেছিলেন। আজ রাজনীতি, খেলাধুলা, শিক্ষা, ব্যবসা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতের নারীরা পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করছেন। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিটি গ্রামে বা শহরে মহাসমারোহে এই দিনটি উদযাপন করা হয়।
আজ আমি এক অসামান্যা নারীর কথা বলব, যিনি সামনে থেকে প্রায় তিরিশ বছর ধরে মানসিক রোগীদের উন্নয়নের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। ২০০৪ সালে বিশিষ্ঠ মানসিক চিকিৎসক স্বর্গীয় ডাক্তার কে. এল. নারায়ণন আমায় প্রথম রত্নাদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কাজের সূত্রে আমি বহুবার ওনার কাঁকুলিয়ার বাড়িতে গিয়েছি। সেই সব সময় আমি সামনে থেকে তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও মানসিক রোগীদের নিয়ে তাঁর উদবিঘ্নের কথা জেনেছিলাম।
রত্নাবলী রায়, এমনি এক নারী যিনি হাজার হাজার মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মুখ বুজে কাজ করে চলেছেন আজ প্রায় দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি হিউমেন রাইটস ওয়াচ নামে এক বিদেশী সংগঠন থেকে ২০১৬ সালে "আলিয়েন ডেজ ফোর্জেস" পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। এই কাজের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি যেমন সম্মানিত হয়েছেন, তেমন অসম্মান, বৈষম্য হুমকিরও সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে।
কলকাতার এক শিক্ষিত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার পরিবারকে সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে থাকতে তিনি দেখে এসেছেন। মা-দিদিমাদের কাছে আসা বিশিষ্ঠ সমাজকর্মীদের সংস্পর্শে তিনি বহুবার এসেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি যথেষ্ট ডানপিটে ছিলেন। তাঁর ছোটবেলা যে বাড়িতে কেটেছে, সেই বাড়ির চারপাশে বস্তি অঞ্চল ছিল। পড়াশুনার সাথে তিনি সেই বস্তির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গুলি খেলা ও নানারকম খেলাধুলা করে কাটাতেন। সেই সময় ওই অঞ্চলে জলের খুব অভাব ছিল, তাই কর্পোরেশনের গাড়ি এসে জল দিত অঞ্চলবাসীদের। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সেই জল বালতি করে নিয়ে আসতেন। একবার এইসব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একটা অঙ্কন প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রদর্শনী দেখতে মাত্র একজন দর্শক এসেছিলেন। তাঁর বাবা - মা বা বাড়ির বড়রা কেউ তাঁর দস্যিপনায় কখনো বাঁধা দেয়নি। তাই তিনি খুব স্বাধীনভাবেই বড় হয়েছেন।
এইভাবে আনন্দে-উল্লাসের মধ্য দিয়েই সাউথ পয়েন্ট স্কুলে তাঁর স্কুলজীবন কেটেছিল। তিনি কলকাতার বিখ্যাত গোখেল কলেজে মনস্তত্ব নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর মনস্তত্ব নিয়ে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। এরপর তিনি হাভার্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ শিক্ষা নিয়ে আসেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে এসেছেন তাঁর দুই পিসিকে, যাঁরা মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। পিসিদের দেখেই তিনি এই বিষয় পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই বিষয়ের বইয়ের পাতায় তিনি যত ঢুকেছেন, তত তাঁর পিসিদের কথা মনে পড়ত।
পড়াশুনা শেষ করার পর প্রথমে কলকাতার এক বিখ্যাত হাসপাতালের মানসিক বিভাগে যোগ দেন। সেই হাসপাতালের উর্দ্ধতন কর্মীরা তাঁর পূর্ব পরিচয় অর্থাৎ তাঁর পিসিদের কথা জানার পর থেকে তাঁকে নানারকম ব্যঙ্গতিতে অতিষ্ঠ করতেন। কেউ বলতেন "আমেরিকান স্পাই", কেউ বলতেন "ফ্রুট এন্ড নাট" বা কেউ বলতেন "হাইপোমোনিক"। এখানে এত অপমান তাঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি একদিন চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি হয়তো অধ্যাপনা বা কোনো চেম্বার খুলে বসতে পারতেন। কিন্তু তিনি বরাবরই খুব স্বাধীনচেতা, তাই তিনি ঐসব সুখের জীবনে পা না বাড়িয়ে এক অসামান্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য এগিয়ে গেলেন।
তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে চলেছেন। ২০০০ সালে তিনি "অঞ্জলি" নামে এক সংস্থা তৈরী করেন। এই সংস্থা সরকারি মানসিক হাসপাতালগুলিতে যেসব মানসিক রুগী ভর্তি রয়েছেন, তাদের নানারকম কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়। এছাড়া মনোসামাজিক অক্ষমতায় আক্রান্ত নারী ও তাদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মুখ্য অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এই সংস্থা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্যাভলভ মেন্টাল হাসপাতাল, লুম্বিনীপার্ক মেন্টাল হাসপাতাল ও বহরমপুর মেন্টাল হাসপাতাল এই তিনটি সরকারি হাসপাতালকে নিয়ে কাজ করছে। এইসব হাসপাতালের রুগীরা যারা প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে, তারা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে তার জন্য সবসময়ই এরা সচেষ্ট থাকে।
তিনি বলেছেন "মনোসামাজিক অক্ষমতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই অপমানিত হন এবং নীরব থাকতে বাধ্য হন, কিন্তু আমি তা অস্বীকার করি। আমার কাজ হল মানুষজনকে তাদের মানবিকতা পুনরুদ্ধার করতে সহাযতা করা"। যারা নানাভাবে সামাজিক বলি হয়েছেন, তাদের নিয়ে ও সামাজিক উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় "ভালো আছি, ভালো থেকো" বলে একটা অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন।
তারিখ : ০৮-০৩-২০১৯
লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
➧ আমার এই লেখাটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
1 comment:
Darun Darun Darun..... Khub valo laglo.....
Post a Comment