কসবার গর্ব: ১১৬ বছরের প্রাচীন পাঠাগার
কসবা সাধারণ পাঠাগার
শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে মানব সভ্যতার সকল জ্ঞান জমা হয়ে আছে গ্রন্থের ভিতর। অন্তহীন জ্ঞানের ভান্ডারই হল গ্রন্থ। গ্রন্থগুলি আজকের পৃথিবীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে। এই গ্রন্থের আবাস্থল হল গ্রন্থাগার বা পাঠাগার। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে গ্রন্থাগারই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ তথ্যাদি সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে সেবা প্রদান করে আসছে। দক্ষিণ কলকাতার এক প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু অঞ্চল হল কসবা। এখানে ১১৬ বছর আগে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি পাঠাগার, যা আজও স্বমহিমায় বিরাজ করছে।
১৯০৪ সালে কসবার মত এক গ্রামে কয়েকজন উৎসাহী যুবক জুলাই মাসের ২৪ তারিখে স্বর্গীয় নবীনকৃষ্ণ ঘোষাল মহাশয়ের জমির এক পর্ণকুটিরে স্বদেশী আন্দোলনের পটভূতে "রেনু কুটির লাইব্রেরী" প্রতিষ্ঠা করে। যুবকদের মধ্যে সর্বশ্রী নিরঞ্জন ঘোষাল, ক্ষীরোদ প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, বঙ্কিমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যাযের নাম উল্লেখযোগ্য। পাঠাগারের উদ্বোধন সভায় বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক রায় সাহেব বিহারীলাল সরকার পৌরোহিত্য করেছিলেন। ১৯০৬ সালের ২৬শে জানুয়ারি সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের উপস্থিতিতে বসন্তউৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বছর চারেক চলার পর ১৯০৮ সালে পরিচালকদের মতপার্থক্যের কারণে সাময়িক অচলাবস্থা হয়েছিল। পরবর্তীকালে "শান্তি লাইব্রেরী" নামে স্থান পরিবর্তন করে বঙ্কিমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে চলে আসে। এই সময় পাঠাগারে শ্যামলাল চক্রবর্তী মহাশয় দুইশত বই এবং নিত্যগোপাল ঘোষাল মহাশয় ৫০ টাকা দান করেন।
১৯১৭ সালের ১৯শে অক্টোবর আবার নাম পরিবর্তন করে "কসবা পাবলিক লাইব্রেরী" করা হয়। মন্মথনাথ রায় মহাশয়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও আর্থিক সহাযতায় লাইব্রেরীটি রেজিস্ট্রিকৃত হয়। ১৯১৯ সালে বঙ্কু বিহারী চট্টোপাধ্যায় ও অমূল্য চট্টোপাধ্যায় পাঠাগারের বর্তমান জমিটি দান করেন।
পাঠাগারের প্রথম সারস্বত উৎসবে সভাপতি হিসেবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, এছাড়া পন্ডিত হরিদেব শাস্ত্রী ও বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার সি ভি রমন উপস্থিত ছিলেন। ১৯২২ সালে হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী ও গিরিশচন্দ্র চৌধুরী মহাশয়দের আর্থিক সাহায্যে পাঠাগারের গৃহনির্মাণের কাজ শুরু হয়। বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে গৃহনির্মাণ কার্য সুসম্পন্ন হয়। ১৯২৮ সালে ইংরেজ সরকারের ৫০ টাকা অনুদানে বিজলি বাতির সংযোগ করা হয়।
১৯৩১ সালে পাঠাগারের উন্নতিকল্পে এক বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, স্বনামধন্য কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী, নির্মল চন্দ্র চন্দ্র সহ আরো বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সেই দিনে বিদ্রোহী কবি স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন।
১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৮০০ টাকার পুস্তক এবং ১৯৫২ সালে ৫৫০ টাকার পুস্তক প্রদান করে। চিত্তরঞ্জন জাতীয় বিদ্যালয় সোসাইটি পাঠাগারের আসবাব কেনার জন্য ২০০ টাকা প্রদান করে।
১৯৫৪ সালের ১৪ই নভেম্বর উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পাঠাগারের ৫০ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হয়। ৫০ বছরের গৌরবময় তথ্যসম্বলিত পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এই সময় কৃষ্ণচন্দ্র পাল মহাশয় একখণ্ড জমি দান করেন। পাঠাগারের গৃহকে দ্বিতল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৮ সালে পাঠ্যপুস্তক বিভাগটি খোলা হয়। ১৯৫৯ সালের ৪ঠা অক্টোবর পাঠাগারের দ্বিতল গৃহটি উদ্বোধন করেন তদকালীন পৌরপ্রধান শ্রী বিজয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। এই বছরেই পাঠাগার শিশু বিদ্যালয় "আলোর পরশ"-র পরিচালনভার গ্রহণ করে।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঠাগারের ৭৫তম বর্ষ পূর্তির উৎসব পালন করা হয়। ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৭৫০০ টাকা, ১৯৮৭ সালে স্বর্গীয় ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়ের জন্মদিনে তাঁর পুত্রগণ ৫০০০ টাকা দান করেন। ১৯৯৬ সালে ডি এন ঘোষ জনকল্যাণ ট্রাস্টের আর্থিক সহায়তায় পাঠাগারের ত্রিতল কক্ষ নির্মাণ শুরু হয়। এই সময় উচ্চশিক্ষার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আলাদা পাঠ্যপুস্তক বিভাগ খোলা হয়। ২০০৪ সালে মহা সাড়ম্বরে শতবর্ষ অনুষ্ঠান পালন করা হয়। শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এম পি ল্যাড থেকে ৯৯,৫০০ টাকা, শ্রী দীনেশ ত্রিবেদীর এম পি ল্যাড থেকে ৫৬,০০০ টাকা এবং বিধায়ক শ্রী রবিন দেবের কাছ থেকে ১,০০,০০০ টাকা পাওয়া যায়। উক্ত টাকায় পাঠাগারের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়।
আজকের যুগে সমস্ত তথ্যই কম্পিউটারের সাহায্যে পাওয়ার জন্য মানুষের বই পড়ার আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে, তা সত্ত্বেও এখানে প্রায় শতিনেক পাঠক-পাঠিকা ও হাজার তিরিশেক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। বর্তমান পরিচালকদের নিরলস চেষ্টায় দিন কয়েক আগে বেশ ঘটা করে ১১৬তম বর্ষ পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কলকাতার নামী দুজন প্রকাশনা সংস্থাকে নিয়ে একটা বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। আমি এই মেলায় উপস্থিত থেকে দেখেছি এখনো বইয়ের প্রতি মানুষের একটা আগ্রহ রয়েছে, তা মেলার ভীড় দেখে বুঝেছিলাম।
পাঠাগারের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সরণি বেয়ে ও কর্মীদের নিরলস চেষ্টায় এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় শতাব্দী পেরোনো এই পাঠাগার আজও যেন যৌবনের ছটায় উজ্জ্বল। পাঠাগারটি কসবার গর্ব, এলাকাবাসীর কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। আশাকরি সকলের যে উদ্দ্যমে আজ পাঠাগারের এই বাড়বাড়ন্ত, তা যেন কোনদিন থেমে না যায়। আমি সবার কাছে আবেদন রাখছি পাঠাগারের উন্নতির জন্য গরিব ছাত্র ছাত্রীদের কথা ভেবে পুস্তক ও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্য। কসবার এই গর্বকে আরো গৌরবের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ০৫-০৮-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
১৯১৭ সালের ১৯শে অক্টোবর আবার নাম পরিবর্তন করে "কসবা পাবলিক লাইব্রেরী" করা হয়। মন্মথনাথ রায় মহাশয়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও আর্থিক সহাযতায় লাইব্রেরীটি রেজিস্ট্রিকৃত হয়। ১৯১৯ সালে বঙ্কু বিহারী চট্টোপাধ্যায় ও অমূল্য চট্টোপাধ্যায় পাঠাগারের বর্তমান জমিটি দান করেন।
পাঠাগারের প্রথম সারস্বত উৎসবে সভাপতি হিসেবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, এছাড়া পন্ডিত হরিদেব শাস্ত্রী ও বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার সি ভি রমন উপস্থিত ছিলেন। ১৯২২ সালে হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী ও গিরিশচন্দ্র চৌধুরী মহাশয়দের আর্থিক সাহায্যে পাঠাগারের গৃহনির্মাণের কাজ শুরু হয়। বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে গৃহনির্মাণ কার্য সুসম্পন্ন হয়। ১৯২৮ সালে ইংরেজ সরকারের ৫০ টাকা অনুদানে বিজলি বাতির সংযোগ করা হয়।
১৯৩১ সালে পাঠাগারের উন্নতিকল্পে এক বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, স্বনামধন্য কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী, নির্মল চন্দ্র চন্দ্র সহ আরো বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সেই দিনে বিদ্রোহী কবি স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন।
১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৮০০ টাকার পুস্তক এবং ১৯৫২ সালে ৫৫০ টাকার পুস্তক প্রদান করে। চিত্তরঞ্জন জাতীয় বিদ্যালয় সোসাইটি পাঠাগারের আসবাব কেনার জন্য ২০০ টাকা প্রদান করে।
১৯৫৪ সালের ১৪ই নভেম্বর উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পাঠাগারের ৫০ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হয়। ৫০ বছরের গৌরবময় তথ্যসম্বলিত পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এই সময় কৃষ্ণচন্দ্র পাল মহাশয় একখণ্ড জমি দান করেন। পাঠাগারের গৃহকে দ্বিতল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৮ সালে পাঠ্যপুস্তক বিভাগটি খোলা হয়। ১৯৫৯ সালের ৪ঠা অক্টোবর পাঠাগারের দ্বিতল গৃহটি উদ্বোধন করেন তদকালীন পৌরপ্রধান শ্রী বিজয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। এই বছরেই পাঠাগার শিশু বিদ্যালয় "আলোর পরশ"-র পরিচালনভার গ্রহণ করে।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঠাগারের ৭৫তম বর্ষ পূর্তির উৎসব পালন করা হয়। ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৭৫০০ টাকা, ১৯৮৭ সালে স্বর্গীয় ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়ের জন্মদিনে তাঁর পুত্রগণ ৫০০০ টাকা দান করেন। ১৯৯৬ সালে ডি এন ঘোষ জনকল্যাণ ট্রাস্টের আর্থিক সহায়তায় পাঠাগারের ত্রিতল কক্ষ নির্মাণ শুরু হয়। এই সময় উচ্চশিক্ষার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আলাদা পাঠ্যপুস্তক বিভাগ খোলা হয়। ২০০৪ সালে মহা সাড়ম্বরে শতবর্ষ অনুষ্ঠান পালন করা হয়। শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এম পি ল্যাড থেকে ৯৯,৫০০ টাকা, শ্রী দীনেশ ত্রিবেদীর এম পি ল্যাড থেকে ৫৬,০০০ টাকা এবং বিধায়ক শ্রী রবিন দেবের কাছ থেকে ১,০০,০০০ টাকা পাওয়া যায়। উক্ত টাকায় পাঠাগারের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়।
আজকের যুগে সমস্ত তথ্যই কম্পিউটারের সাহায্যে পাওয়ার জন্য মানুষের বই পড়ার আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে, তা সত্ত্বেও এখানে প্রায় শতিনেক পাঠক-পাঠিকা ও হাজার তিরিশেক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। বর্তমান পরিচালকদের নিরলস চেষ্টায় দিন কয়েক আগে বেশ ঘটা করে ১১৬তম বর্ষ পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কলকাতার নামী দুজন প্রকাশনা সংস্থাকে নিয়ে একটা বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। আমি এই মেলায় উপস্থিত থেকে দেখেছি এখনো বইয়ের প্রতি মানুষের একটা আগ্রহ রয়েছে, তা মেলার ভীড় দেখে বুঝেছিলাম।
পাঠাগারের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সরণি বেয়ে ও কর্মীদের নিরলস চেষ্টায় এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় শতাব্দী পেরোনো এই পাঠাগার আজও যেন যৌবনের ছটায় উজ্জ্বল। পাঠাগারটি কসবার গর্ব, এলাকাবাসীর কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। আশাকরি সকলের যে উদ্দ্যমে আজ পাঠাগারের এই বাড়বাড়ন্ত, তা যেন কোনদিন থেমে না যায়। আমি সবার কাছে আবেদন রাখছি পাঠাগারের উন্নতির জন্য গরিব ছাত্র ছাত্রীদের কথা ভেবে পুস্তক ও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্য। কসবার এই গর্বকে আরো গৌরবের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ০৫-০৮-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment