এক রূপকথার গল্প
ধুলায় মিশে যাওয়া জীবনকে কি করে সম্মানের আসনে বসাতে হয়, তা বোধহয় একমাত্র বাঙালি মেয়ে বেবীই জানে। বাবুর বাড়ি বাসন মেজে যার জীবন চলতো আজ তার লেখা বই বেস্ট সেলার হয়। নাম তার বেবী হালদার। জীবন যুদ্ধে অমানুষিক লড়াই চালিয়ে আজ সে সব কিছুকে হারিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধে তাকে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে। চলার পথের অলিতে-গলিতে কাঁকর বিছানো পথে তাকে বার বার হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়েছে। এই পড়া থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করে আবার চলা শুরু করেছে, নিজেকে পরিপক্ক করে তুলেছে। তার জীবন সংগ্রাম যেন এক রূপকথার গল্প।
বেবী ১৯৭৩ সালে কাশ্মীর উপতক্যায় জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা সেনাকর্মী ছিলেন। মদ্যপ অবস্থায় বাবা তার মার ওপর অত্যাচার করতো। এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার মা তাকে ও তার বোনকে নিয়ে মুর্শিদাবাদে তাদের মামার বাড়িতে চলে আসে। এখানে তার মা দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ছোট্ট বেবীর জীবন সৎ বাবার সংসারে ভালোই চলছিল। যখন সে ক্লাস সিক্সে পড়ে সেই সময় তার বাবা তাকে বিবাহ দিয়ে দেয়, হারিয়ে যায় তার স্বাদের লেখাপড়া, হারিয়ে যায় তার শৈশব। বিবাহের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর আর তার স্বামীর বয়স ছিল ২৬। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়। তার স্বামী তাকে রান্না করা আর সন্তান ধারণ করা ছাড়া আর কিছু ভাবতো না। এই ভাবেই বাঙালি মেয়েটি তার জীবন অত্যাচারের মাধ্যমেই ধারণ করতে লাগলো। তার বয়স যখন বছর কুড়ি তখন সে তিন তিনটি সন্তানের মাতা। ১৯৯৯ সাল তার বয়স যখন বছর পঁচিশ তখন সে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দিল্লিগামী ট্রেনে উঠে পরে। তার সন্তানদের পিতৃপরিচয়ের কথা তোয়াক্কা না করে স্বামীর বাড়ির চৌকাঠ ছেড়ে চলে আসে। নিজের পরিচয় সন্তানদের বড় করার ব্যাপারে মনস্থির করে নেয়। কোথায় যাবে কি করবে কিছুই তার জানা নেই, সে চায় না তার মতো তার সন্তানদের জীবন যেন না হয়। সে তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চায়।
দিল্লিতে এসে পরিচারিকার কাজ নেয়। বেশ কয়েকটি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে লাগলো। অল্প বয়সের যুবতী নানা রকম কুপ্রস্তাবও আস্তে লাগলো। এখানে সে ঘর ঝাড় দিয়েছে, বাসন মেজেছে অর্থাৎ একজন পরিচারিকার যা কাজ সবটাই করেছে। বহুজনের কাছ থেকে ভালো ও খারাব দুরকম ব্যবহার সে পেয়েছে।সন্তানদের কথা ভেবে কোনোদিন সেভাবে প্রতিবাদ করেনি, সব কিছু মেনে নিয়েছে। সে তার কর্তব্যে স্থির থেকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এই ভাবে চলতে চলতে সে একদিন অধ্যাপক প্রবোধ কুমারের বাড়িতে কাজ পেলো। বেবি তাদের বাড়িতে থেকে সব কাজ করে দেবে। বেবির সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে প্রবোধ বাবু রাজি হলেন। প্রবোধবাবু মুন্সি প্রেমচাঁদের নাতি ও অধ্যাপক হওয়ায় পড়াশোনার ব্যাপারে তার অগাধ আগ্রহ ছিল। তার বাড়িতে বহু রকমের বই ছিল তিনি ধীরে ধীরে বেবীকে নিজের মেয়ের মতো ভালো বাসতে লাগলেন। বেবীও তাঁকে পিতার মতো সম্মান করতে লাগলো। তাঁকে তাতুস বলে ডাকতো। তাতুস শব্দের অর্হ পিতা। প্রবোধবাবুর বাড়িতে কাজে ঢোকার পর বেবীর গতানুগতিক জীবন একটু অন্য দিকে বাঁক নেয়। জীবনের কানা গলি থেকে বেরিয়ে যেন এবার সে সঠিক গলির সন্ধান পেল।
বেবী বইয়ের তাক ঝাড়পোছ করতে করতে মাঝে মাঝে কোনো বই নিয়ে পাতা ওল্টাতো। বইয়ের কিছুটা অংশ পড়তো, আবার যথাস্থানে বইটা রেখে দিতো। এই দৃশ্য গৃহকর্তা প্রবোধবাবুর দৃষ্টি এড়ায় নি। একদিন বইয়ের তাক ঝাড়তে গিয়ে সে তসলিমা নাসরিনের "আমার মেয়েবেলা" বইটা পায়। তিনি বেশ আগ্রহের সাথে বইটা পড়তে লাগল। এ যেন তারই জীবন কাহিনী লেখা রয়েছে। প্রমথবাবু বেবীকে খাতা ও পেন্সিল এনে দিয়ে বলেন রোজ এক দু পাতা করে লিখতে। বেবী জানতে চায় কি লিখবো। তিনি বলেন তার যা মনে হয় তাই লিখতে বা তার জীবনের কাহিনীটাও লিখতে পারে।
কাজের অবসরে বেবী রোজ এক পাতা দু পাতা করে লিখতে শুরু করে। ধীরে ধীরে লিখলো তার শৈশবের কথা, তার বিবাহের কথা, তার সন্তান ধরণের কথা, তার অত্যাচারিত হওয়ার কথা। এই সময় বেশ কিছুদিনের জন্য গৃহকর্তা দক্ষিণ ভারতে যান, ফিরে এসে দেখেনবেবী ততদিনে একশো পাতা লিখে ফেলেছে। লেখাটি পরে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি তার বেশ কয়েকজন বন্ধুকেও লেখাটি পড়ান। সবাই একবাক্যে লেখাটির তারিফ করে। তাঁরা অনেকে এনি ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সাথে লেখাটিকে তুলনা করেছিলেন।
প্রবোধবাবু নিজ উদ্যোগে লেখাটিকে বইয়ের আকারে প্রকাশ করেন। বইটির নাম হয় "আলো -আঁধারি"। এভাবেই দু- মলাটে তিনি বেবীর জীবনকে ধরে ফেললেন। পরবর্তী কালে এই বইটা ইংরেজিতে ও আরো ১২ টি ভাষায় অনুবাদ হয়। .পরে তিনি "ইসস্থ রূপান্তর" ও "ঘরে ফেরার পথ" নামে আরো দুটি বই লিখেছেন। সব কটা বইতেই সে তার শৈশব ও কৈশোরকে অক্ষরবৃত্তে ধরেছেন।
হটটকের মতোই তার জীবনের গল্প বিক্রি হতে লাগলো। তিনটি বই বেস্ট সেলার হয়। বেবী হয়ে ওঠে পরিচারিকা থেকে লেখিকা। তার চলা শুরু হয় গলি পথ থেকে রাজপথে।
লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ :০৫-০৭-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
1 comment:
সত্যিই তাই, মানুষ চাইলে যেমন অনেক দূরে পৌঁছতে পারেন, তেমন যদি মন থেকে যদি চাওয়া যায় আর লড়াই করা যায়, তাহলে ভাগ্য তাকে ঠিক ই তার গন্তব্য তে নিয়ে যাবেই।
Post a Comment