শব্দসুরের জাদুকর
পঞ্চাশের দশকের প্রায় শেষের দিকে পদার্থ বিজ্ঞানের এক ছাত্র গান শুনবেন বলে একটা ভালো মিউজিক সিস্টেম কিনলেন। ছাত্রটি তখন প্রবাসে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছেন। এই মিউজিক সিস্টেমে গান শুনে তার মন ঠিক মতো ভরছিল না। কোনো অডিটোরিয়ামে বসে গান শোনা আর এই মিউজিক সিস্টেমে গান শোনার মধ্যে অনেকটাই ফারাক সে অনুভব করতে লাগল। সে এই ফারাকটাকে ভরাট করার জন্য পদার্থ বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে গবেষণা শুরু করলো। পদার্থ বিদ্যার জ্ঞানকে সূত্র করে সে নতুন মিউজিক সিস্টেম তৈরী করতে লাগলো।
এই বাঙালি ছাত্রটির নাম অমর গোপাল বোস। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সবটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ার ফিলাডেলফিলায়। তার মা ছিলেন আমেরিকান কিন্তু বাবা ছিলেন বাঙালি। তার বাবা ননী গোপাল বোস একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ছিলেন। কয়েকবার কারাবাসও করেছেন। ১৯২০ সালে গ্রেফতারের ভয়ে তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান।
অমর গোপাল বোস পেনসেলভালিয়ার অ্যাবিংটন সিনিয়র হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালের শুরুতে তিনি সেখান থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক হন। এরপর বোস নেদারল্যান্ডের এইডোভেন এ এনভি ফিলিপস ইলেক্ট্রনিকস এর গবেষণা ল্যাবে এক বছর কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি ফুলব্রাইট রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসাবে দিল্লিতে এক বছর কাটান এবং এখানেই তার হবু স্ত্রী প্রেমার সাথে পরিচয় হয় (বর্তমানে তার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে)। তিনি এমআইটি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি সম্পন্ন করেন; তার অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু ছিল নন-লিনিয়ার সিস্টেমস।
ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব কৌতূহলী ছিলেন। যেকোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে তার সম্বন্ধে জানার কৌতূহল ছিল তার সহজাত গুন।
মাত্র তের বছর বয়সেই তিনি তার প্রতিভার পরিচয় দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের যোগান দিতে তিনি তার স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মেরামতের একটি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। লোকের বাড়িতে গিয়ে তারা নষ্ট হয়ে যাওয়া খেলনা ট্রেন ও রেডিও সারাই করে দিতো। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তার বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তার পরিবার খুবই অর্থকষ্টে পড়ে। তখন তিনি তার পিতা ননী গোপালকে বললেন বিভিন্ন দোকানে গিয়ে জানিয়ে আস্তে যে তারা পুরোনো রেডিও সারাই করে। তার পিতা সারাদিন দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে খারাপ হয়ে যাওয়া রেডিও সারাই করার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসতো। স্কুল থেকে ফিরে অমর সেই রেডিওগুলো সারাই করে দিতো। এইভাবেই সে তার পারিবারিক আর্থিক অনটনের পিতার পাশে দাঁড়ান। যুদ্ধের পর অমর রেডার টিউব ও ট্রান্সফরমার দিয়ে একটা টেলিভিশন বানিয়ে ফেলে। তার বুৎপত্তি দেখে পিতা তাকে আমেরিকার সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় পোড়ানোর কথা ভাবলেন। কয়েকজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তিনি ১৯৪৭ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ছেলেকে ভর্তি করে দেন।
স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর অমর বসু এমআইটিতে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। তিনি একুইস্টিকস এ তার গবেষণা নিবদ্ধ করেন এবং ফলশ্রুতিতে তিনি এমন একটি স্টিরিও লাউড স্পীকার আবিষ্কার করেন যা ঘরের ভেতর কনসার্ট হলের মত জোরালো প্রতিধ্বনিত শব্দক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। ১৯৬৪ সালে তিনি উন্নত মানের স্পিকার বানানোর জন্য একটা প্রতিষ্ঠানা গড়ে তোলেন। অন্য দেন "বোস কর্পোরেশন"। তাঁর উদ্ভাবন রাতারাতি বাজারে আলোড়ন ফেলে দিলো। তার নির্মিত স্পিকারটি আসলে ছোটো ও বড়ো কয়েকটির স্পিকারের সমষ্টি। তিনি এই সমষ্টিতে রাখলেন উফারস টুইটার্স ছাড়াও একটি সক্রিয় ইকোয়ালাইজার দিলেন। তার ফলে হল ঘরে দুই কোনে দুটি স্পিকার বসিয়ে দিলে কনসার্টের মতো আমেজ পাওয়া যেতে লাগলো। তার এই আবিষ্কার তাঁকে ও তাঁর বোস কর্পোরেশনকে বড়লোক বানিয়ে দিলো। সেই থেকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠ স্পিকার সিস্টেমগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠানই তৈরি হতে লাগলো।
তিনি শুধু বড় বড় হল ঘর নয় বাড়িতে বসেও যাতে লোকে সুন্দর শব্দ-সুধা পান করতে পারে তার ব্যবস্থা করলেন। বিমানে বসে শোনার জন্য একপ্রকার হেডফোন আবিষ্কার করলেন। ১৯৮০ সালে তিনি গাড়িতে বসে গান শোনার কথা চিন্তা করলেন। অচিরেই তিনি কার সিস্টেম আবিষ্কার করে ফেললেন। বর্তমানে সারা বিশ্বেই এখন বোস করপোরেশনের অফিস ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। প্রায় সাড়ে নয় হাজার কর্মী সেখানে কাজ করেন। আমৃত্যু নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তার কাজ তিনি নিজে করেছেন। তিনি ছিলেন প্রভূত সম্পদের অধিকারী। ২০১১ সালে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
৮৩ বছর বয়সে ২০১২ সালের ১২ জুলাই এই শব্দের জাদুকর মারা যান। এই শব্দসুরের জাদুকর দুটি বিবাহ করেন তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন প্রেম আর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন উরসুলা। তাঁর ভানু বসু ও মায়া বসু নামে এই দুটি সন্তান রয়েছে। তিনি ব্যাডমিন্টন খেলতে আর বেহালা বাজাতে খুব ভালোবাসতেন।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ৩০-০৭-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
পঞ্চাশের দশকের প্রায় শেষের দিকে পদার্থ বিজ্ঞানের এক ছাত্র গান শুনবেন বলে একটা ভালো মিউজিক সিস্টেম কিনলেন। ছাত্রটি তখন প্রবাসে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছেন। এই মিউজিক সিস্টেমে গান শুনে তার মন ঠিক মতো ভরছিল না। কোনো অডিটোরিয়ামে বসে গান শোনা আর এই মিউজিক সিস্টেমে গান শোনার মধ্যে অনেকটাই ফারাক সে অনুভব করতে লাগল। সে এই ফারাকটাকে ভরাট করার জন্য পদার্থ বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে গবেষণা শুরু করলো। পদার্থ বিদ্যার জ্ঞানকে সূত্র করে সে নতুন মিউজিক সিস্টেম তৈরী করতে লাগলো।
এই বাঙালি ছাত্রটির নাম অমর গোপাল বোস। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সবটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ার ফিলাডেলফিলায়। তার মা ছিলেন আমেরিকান কিন্তু বাবা ছিলেন বাঙালি। তার বাবা ননী গোপাল বোস একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ছিলেন। কয়েকবার কারাবাসও করেছেন। ১৯২০ সালে গ্রেফতারের ভয়ে তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান।
অমর গোপাল বোস পেনসেলভালিয়ার অ্যাবিংটন সিনিয়র হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালের শুরুতে তিনি সেখান থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক হন। এরপর বোস নেদারল্যান্ডের এইডোভেন এ এনভি ফিলিপস ইলেক্ট্রনিকস এর গবেষণা ল্যাবে এক বছর কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি ফুলব্রাইট রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসাবে দিল্লিতে এক বছর কাটান এবং এখানেই তার হবু স্ত্রী প্রেমার সাথে পরিচয় হয় (বর্তমানে তার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে)। তিনি এমআইটি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি সম্পন্ন করেন; তার অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু ছিল নন-লিনিয়ার সিস্টেমস।
ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব কৌতূহলী ছিলেন। যেকোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে তার সম্বন্ধে জানার কৌতূহল ছিল তার সহজাত গুন।
মাত্র তের বছর বয়সেই তিনি তার প্রতিভার পরিচয় দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের যোগান দিতে তিনি তার স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মেরামতের একটি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। লোকের বাড়িতে গিয়ে তারা নষ্ট হয়ে যাওয়া খেলনা ট্রেন ও রেডিও সারাই করে দিতো। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তার বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তার পরিবার খুবই অর্থকষ্টে পড়ে। তখন তিনি তার পিতা ননী গোপালকে বললেন বিভিন্ন দোকানে গিয়ে জানিয়ে আস্তে যে তারা পুরোনো রেডিও সারাই করে। তার পিতা সারাদিন দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে খারাপ হয়ে যাওয়া রেডিও সারাই করার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসতো। স্কুল থেকে ফিরে অমর সেই রেডিওগুলো সারাই করে দিতো। এইভাবেই সে তার পারিবারিক আর্থিক অনটনের পিতার পাশে দাঁড়ান। যুদ্ধের পর অমর রেডার টিউব ও ট্রান্সফরমার দিয়ে একটা টেলিভিশন বানিয়ে ফেলে। তার বুৎপত্তি দেখে পিতা তাকে আমেরিকার সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় পোড়ানোর কথা ভাবলেন। কয়েকজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তিনি ১৯৪৭ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ছেলেকে ভর্তি করে দেন।
স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর অমর বসু এমআইটিতে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। তিনি একুইস্টিকস এ তার গবেষণা নিবদ্ধ করেন এবং ফলশ্রুতিতে তিনি এমন একটি স্টিরিও লাউড স্পীকার আবিষ্কার করেন যা ঘরের ভেতর কনসার্ট হলের মত জোরালো প্রতিধ্বনিত শব্দক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। ১৯৬৪ সালে তিনি উন্নত মানের স্পিকার বানানোর জন্য একটা প্রতিষ্ঠানা গড়ে তোলেন। অন্য দেন "বোস কর্পোরেশন"। তাঁর উদ্ভাবন রাতারাতি বাজারে আলোড়ন ফেলে দিলো। তার নির্মিত স্পিকারটি আসলে ছোটো ও বড়ো কয়েকটির স্পিকারের সমষ্টি। তিনি এই সমষ্টিতে রাখলেন উফারস টুইটার্স ছাড়াও একটি সক্রিয় ইকোয়ালাইজার দিলেন। তার ফলে হল ঘরে দুই কোনে দুটি স্পিকার বসিয়ে দিলে কনসার্টের মতো আমেজ পাওয়া যেতে লাগলো। তার এই আবিষ্কার তাঁকে ও তাঁর বোস কর্পোরেশনকে বড়লোক বানিয়ে দিলো। সেই থেকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠ স্পিকার সিস্টেমগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠানই তৈরি হতে লাগলো।
তিনি শুধু বড় বড় হল ঘর নয় বাড়িতে বসেও যাতে লোকে সুন্দর শব্দ-সুধা পান করতে পারে তার ব্যবস্থা করলেন। বিমানে বসে শোনার জন্য একপ্রকার হেডফোন আবিষ্কার করলেন। ১৯৮০ সালে তিনি গাড়িতে বসে গান শোনার কথা চিন্তা করলেন। অচিরেই তিনি কার সিস্টেম আবিষ্কার করে ফেললেন। বর্তমানে সারা বিশ্বেই এখন বোস করপোরেশনের অফিস ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। প্রায় সাড়ে নয় হাজার কর্মী সেখানে কাজ করেন। আমৃত্যু নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তার কাজ তিনি নিজে করেছেন। তিনি ছিলেন প্রভূত সম্পদের অধিকারী। ২০১১ সালে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
৮৩ বছর বয়সে ২০১২ সালের ১২ জুলাই এই শব্দের জাদুকর মারা যান। এই শব্দসুরের জাদুকর দুটি বিবাহ করেন তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন প্রেম আর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন উরসুলা। তাঁর ভানু বসু ও মায়া বসু নামে এই দুটি সন্তান রয়েছে। তিনি ব্যাডমিন্টন খেলতে আর বেহালা বাজাতে খুব ভালোবাসতেন।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ৩০-০৭-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
তারিখ : ৩০-০৭-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment