Friday, August 2, 2019

শ্রী শ্রী রামঠাকুর ও কৈবল্যধাম>

শ্রী শ্রী রামঠাকুর ও কৈবল্যধাম



"গুরু" এই শব্দটি বাঙালি জীবনের চলার পথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে।  যাঁর তুলনায় আমি লঘু তিনিই হলেন গুরু। গুরুই আমাদের চিত্তকে লঘুতার থেকে গুরুতার দিকে আকর্ষণ করেন। যুগে যুগে ভারতের মাটিতে বহু গুরুর আবির্ভাব ঘটেছে। বহু সদ্গুরু এসেছেন এই পুণ্যভূমিতে। তেমনই এক গুরু ১৮৬০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরের  ডিঙ্গামানিক গ্রামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মানবসত্তার অবমাননা, ধর্মের গ্লানি দূর করতে শ্রী শ্রী রামচন্দ্রদেবের আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনিই অপরমারাধ্য শ্রী শ্রী কৈবল্যনাথ বা শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ। দিব্যপুরুষ শ্রী শ্রী রামচন্দ্রদেবই সকলের পূজনীয় শ্রী শ্রী রামঠাকুর।


পিতা শ্রী রাধামাধব বিদ্যালঙ্কার ছিলেন একজন তন্ত্রাচারী সিদ্ধযোগী। মাতা শ্রীমতি কমলাদেবী আচার, নিষ্ঠা ও ধর্মপরায়ণ নারী ছিলেন।  তাঁদের চার পুত্র ও এক কন্যা ছিলেন।  তাঁদের তৃতীয় পুত্র শ্রী রামচন্দ্রদেব বাল্যকাল থেকেই অন্তর্মুখী ও ভাবুক প্রকতির ছিলেন।  পড়াশুনায় কোনো মন ছিল না, বনে-জঙ্গলে সবসময় ঘুরে বেড়াতেন।  মা চিন্তা করতেন পন্ডিতের ছেলে মূর্খ হয়ে থাকবে।  যদি তাঁর মনের পরিবর্তন হয় সেই কারণে অল্প বয়সেই তাঁর উপনয়ন দিয়ে দিলেন। উপনয়নের কিছুকাল পরেই রামচন্দ্র নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ালেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করলেন। তিনি স্বপ্নে এক গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা পেয়েছিলেন।  ভারত ও অধুনা বাংলাদেশের বিভিন্নপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি কামাখ্যা মন্দিরে এসে উপস্থিত হলেন।  এখানেই সেই তেজময় পুরুষের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হল যিনি তাঁকে স্বপ্নে দীক্ষা দিয়েছিলেন। গুরুর সাথে নিরুদ্দেশের পথে চলে গিয়েছিলেন, প্রায় আট-দশ বছর পরে তিনি গৃহে ফিরে আসেন। গুরুর সান্নিধ্যে থেকে তিনি হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ও অন্যান্য জায়গায় পরিভ্রমণ করেন। নানা তীর্থ দর্শনের সৌভাগ্যও তাঁর জীবনে ঘটেছিল। অল্প কিছুদিন বাদে তিনি আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যান।  ১৯০২-০৩ সাল নাগাদ আবার তাঁর পুনরাবির্ভাব হয়  কলকাতায়। ১৯০৩ সালে তাঁর মাতৃদেবীর মৃত্যুর সময় তিনি কালীঘাটে ছিলেন, তারপর কয়েক বছর হুগলির উত্তরপাড়াতে কাটান। ওখান থেকে আবার তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শোনা যায় এই সময় তিনি দক্ষিণ ভারতে কাটান এবং ১৯০৭ সালের শেষের দিকে তিনি আবার গৃহে ফিরে  আসেন। এই সময় থেকে তাঁর মহাপ্রয়াণ পর্যন্ত তিনি মানবসেবায় ব্রতী ছিলেন। তিনি কোনোদিন সন্ন্যাসীদের মতন গৈরিক বস্ত্র পড়েননি। গলায় মালা পরে,  অতি সাধারণ একটা ধুতি ও চাদর পরে সারাজীবন লোক শিক্ষা দিয়ে গেছেন।  তিনি অসীম আধ্যাত্মশক্তির আধার ছিলেন। ক্রমে ক্রমে একজন দুজন করে তাঁর ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। ভক্তগণ তাঁর দর্শন ও অমৃতবাণী শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলো। ভক্তগণ তাঁর সেবা করার জন্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ প্রকাশ করল। তারা চট্টগ্রামের কাছে জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের তলায় আশ্রম করার নির্দেশ পেলেন ঠাকুরের কাছ থেকে।  জরাজীর্ণ এক বটবৃক্ষকে ঘিরে আশ্রমটি ও যাত্রীনিবাস গড়ে তোলা হল। ঠাকুরের নির্দেশে শ্রী শ্রী কৈবল্যনাথের পট  প্রতিষ্ঠিত হল এবং শ্রীমৎ হরিপদ বন্দ্যেপাধ্যায় আশ্রমের প্রথম মোহন্ত নিযুক্ত হলেন। ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে সত্যনারায়ণ সেবাই হল কৈবল্যধামের প্রধান লক্ষ্য ও কর্তব্য। এছাড়া এখানকার ক্রিয়াকর্মের অভিমুখ হল জনকল্যাণমুখী এবং মানুষের হিতসাধন।

ঠাকুরের নির্দেশেই কলকাতার যাদবপুরে কৈবল্যনাথ শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৪২ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি। এটাই ভারতবর্ষের একমাত্র ঠাকুরের আশ্রম। এই আশ্রমে একটা পরিচালন কমিটি আছে।  কমিটির সদস্যরাই এখানকার কাজকর্ম ও উৎসবগুলি পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিদিন ভোরবেলা মঙ্গলারতি, মধ্যাহ্নে ভোগ, সন্ধ্যায় সত্যনারায়ণ সেবা, পাঁচালি পাঠ, সিন্নি হয়।  এখানে গ্রন্থাগার ও দাত্যব্য চিকিৎস্যালয় আছে। এখানে সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল ও আর্ত মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। এখানে এলোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথিক দুরকমের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া এম্বুলেন্স পরিষেবার ব্যবস্থাও রয়েছে।   দুস্থদের দান ধ্যান করা হয়। দুস্থ ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বইপত্তর ও স্কুল-কলেজের বেতন ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা করা হয়। ২০০৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর গ্রহাগারটির উদ্বোধন করা হয়। অধ্যাত্মবিষয়ক ও ভক্তিমুলকগ্রন্থে গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ। নাটমন্দিরের পাশে মূলমন্দিরে কৈবল্যনাথ বিজড়িত।  ভক্তদের মুক্ত হস্থের দনে এই বিশাল কর্মকান্ড চলে আসছে। "সত্যের সন্ধ্যানে" নামক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

ঠাকুর বলতেন আশ্রমই আমার প্রাণ, আশ্রমই হরিনামের লীলাভূমি ও নামযজ্ঞের স্থান।  এই স্থানের মাধ্যমে সর্বধর্ম সমন্বয় হবে এবং কালক্রমে কোন মহাপুরুষ এই পবিত্র ধামের মাহাত্ম্য প্রচার করবে। ঠাকুরের এই বাণী আজ সত্য বলে প্রমাণিত। দিনে দিনে যেমন ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে তেমন এই সত্যধামের কথা লোকমুখে প্রচারিত হচ্ছে।  ঠাকুরের দিব্য জীবনের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তারা উপলব্ধি করেছেন ঠাকুরের যোগমাহাত্ম্যকে। অপরিসীম আধ্যাত্মিক শক্তির মূর্ত প্রতীক শ্রী শ্রী ঠাকুর সর্বদা বিনয়ী থেকে মানুষের হিতসাধন করার চেষ্টা করে গেছেন। ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই  বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে প্রথমটি,  ভারতবর্ষের কলকাতার যাদবপুরে দ্বিতীয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়, এই দুটি আশ্রম "কৈবল্যধাম" নামে প্রতিষ্ঠিত। তৃতীয়টি তাঁর পবিত্র জন্মভূমি বাংলাদেশের ডিঙ্গামানিক  গ্রামে  "সত্যনারায়ণ শিবমন্দির" নামে  প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮৯ সালের ১লা মে শ্রী শ্রী ঠাকুর জীবন রাখেন। তাঁর নশ্বর দেহের  অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী গ্রামে ঠাকুরের মহাসমাধি হয়েছিল। যে স্থানে তাঁর দেহ সমাহিত হয় সেই স্থানে ঠাকুরের ইচ্ছা অনুযায়ী "সমাধি মন্দির" নির্মাণ করা হয় ও একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই আশ্রমটি ঠাকুরের চতুর্থ আশ্রম।

শ্রী শ্রী ঠাকুর ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় অবিভক্ত বঙ্গদেশে মানবজীবন ধারণ করে এসেছিলেন।  তিনি একান্তভাবে প্রচারবিমুখ ছিলেন।  একজন পরমপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের মানুষ তাঁর  সম্বন্ধে অজ্ঞ।

ঠিকানা : ৩৪,  রামঠাকুর সারণি, যাদবপুর, কলকাতার ৭০০০৩২

পথনির্দেশিকা : কলকাতার যে কোনো স্থান থেকে বাসে করে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডে এসে রিক্সা বা পায়ে হেঁটে পৌঁছানো যায়। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে যাদবপুর স্টেশানে নেমে রিক্সা বা পায়ে হেঁটেও  পৌঁছানো যায়।


তথ্যসূত্র : সময়-এসময় পত্রিকা, ১৪২২ মাঘ সংখ্যা

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০২-০৮-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

2 comments:

Unknown said...

Fantastic writeup

Anonymous said...

ঠাকুরের নরলীলার অলৌকিক ঘটনা সমুহ পোষ্ট দিন দয়া করে।জয় রাম।