Sunday, October 27, 2019

কেওড়াতলা শ্মশান ও শ্মশানকালী>

কেওড়াতলা শ্মশান ও শ্মশানকালী



শ্মশান মানে শবদেহ দাহ করার স্থান। এ এমনি এক স্থান যেখানে প্রত্যেক মানুষকে কারোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার জন্য বা নিজের আন্তষ্টির সময় মৃত অবস্থায় যেতেই হয়। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই বেশিরভাগ শ্মশানেরই অবস্থান কোনো না কোনো নদীর তীরে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে দ্বারকা নদীর তীরে তারাপীঠের মহাশ্মশান, কোপাই নদীর তীরে কঙ্কালীতলার মহাশ্মশান। তেমনি কেওড়াতলা মহাশ্মশানটিও আদি গঙ্গার তীরে অবস্থিত। বহু সাহিত্যিকের কলমে শ্মশানের কথা বার বার উঠে এসেছে।  যদিও শ্মশানের চরিত্র বর্তমানে  সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কাঠের বদলে এসে গেছে বৈদ্যুতিক চুল্লি। আগের আলো-আঁধারি ভয়াবহ পরিবেশও পাল্টে হয়ে উঠেছে আলো ঝলমলে। মৃত্যু মানে জীবনের শেষ, তারপর দাহ পদ্ধতির মাধ্যমে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া। এখানে আসলে মনে হবে যেন এটাই বুঝি পৃথিবীর শেষ স্টেশন। 'শ' শব্দটির অৰ্থ শব অর্থাৎ মৃতদেহ আর 'শ্মান' শব্দটির অর্থ হলো শান বা বিছানা।  শ্মশানে আসলেই সব সময় শোনা যায় "বল হরি, হরি বোল" বা "রাম নাম সত্য হ্যায়" কথাগুলো। "হরি" বলতে বোঝায় যিনি জন্ম-মৃত্যু, জড়া-ব্যাধি হরণ করেন। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে ভগবান রাম যিনি সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাভূত করতে সক্ষম। তাই বিশ্বাস অনুযায়ী রামের নাম করলে আত্মার মুক্তি মেলে। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ শ্মশানেই কালী মন্দির দেখা যায় বা শ্মশান কালীর পুজোও  হতে দেখা যায়।




রাসবিহারী মোড় থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে সেতু পার হয়ে চেতলার দিকে। ওই সেতুতে ওঠার ঠিক আগে একটা মোড় পড়বে।  এই মোড়ের ডানদিকে পড়ে কালীঘাট অঞ্চল ও বিখ্যাত কালীমন্দিরটি আর বামদিকে পড়ে টালিগঞ্জ অঞ্চল ও বিখ্যাত কেওড়াতলা মহাশ্মশানটি।

কথিত আছে, এই বাঁদিকের অঞ্চলটিতে  পূর্বে কেওড়া গাছের জঙ্গল ছিল, সেই থেকে অঞ্চলটির নাম কেওড়াতলা হয়।  কেওড়াতলা শ্মশানটি বৃহৎ ও কলকাতার অন্যতম প্রাচীন শ্মশান। শ্মশানটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আদি গঙ্গা। শ্মশানটি পূর্বে এই স্থানে ছিল না, কালীঘাট মন্দিরসংলগ্ন ঘাটে এর অবস্থান ছিল। শবদেহ দাহ করার সময় কালো ধোঁয়ায় মন্দিরটি ও অঞ্চলটি ভরে যেত। সমগ্র  অঞ্চলটিতে একটা অস্বাস্থ্যকর  পরিবেশ তৈরী হচ্ছিল। কলকাতা পৌরসংস্থা গঠন হওয়ার পর কালীঘাট মন্দিরের কাছে বর্তমান জায়গায় অর্থাৎ কেওড়াতলায় দুই বিঘা জমি নিয়ে শ্মশানটিকে স্থানান্তরিত করা হয়। শ্মশানটির ডান দিকে মায়ের ৫১ পীঠের এক পীঠ (কালীর মন্দির) ও নকুলেশ্বর ভৈরব মন্দির  থাকায়  জায়গাটা খুবই পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। শ্মশানটিকে তাই মহাশ্মশান বলা হয়।

বহুদিন যাবৎ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় ছিল। দহনের পোড়া কাঠ ও ভষ্মে জায়গাটা সব সময় অপরিষ্কার হয়ে থাকতো।  শ্মশানযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য কোনো ভালো জায়গা  ছিল না। কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত গঙ্গানারায়ণ হালদারের পত্নী শ্রীমতি বিশ্বময়ী দেবী শ্মশানঘাটটিকে বাঁধিয়ে দেন এবং পরবর্তীকালে তিনি শবযাত্রীদের বসার জন্য বিশ্রামাগার ও প্রবেশপথে একটা সুবিশাল তোরণ তৈরী করে দেন।  স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় কিছুটা  আধুনিকরণ ও সংস্কার করেন।  ২০০৪  ও ২০০৫ সালে পৌরসংস্থা বেশ কিছু টাকা ব্যয় করে আরো কিছু সংস্কার করে দেয়।  সেই টাকাতে নতুন  বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানো ও চত্বরটি সাজানোর কাজ করা হয়।  শবযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য উপযুক্ত একটি বিশ্রামাগার তৈরী করা হয়।  পরবর্তীকালে পৌরসংস্থা বিশ্রামাগারটিকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত করে দেয়। তার ফলে পুরোনো কাঠের শ্মশানটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। শ্মশান সংলগ্ন স্থানে ভারী সুন্দর, মনোরম একটা  বাগান তৈরী করা হয়েছে। গার্ডেনটির নাম "মাইসোর  গার্ডেন"। পৌরসংস্থা বর্তমানে আরো  সুন্দরভাবে গার্ডেনটিকে  সাজিয়ে দিয়েছে।

কলকাতার বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের শব এখানে দাহ করা হয়েছে। তাঁদের কয়েক জন যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখ্যোপাধ্যায় প্রমুখের স্মৃতিসৌধ করা আছে। এছাড়া জীবনানন্দ দাশ, সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, নেলী সেনগুপ্ত, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু,  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ ও আরো কত গন্যমান্য ব্যাক্তিত্বের দেহ এখানেই দাহ করা হয়েছে। এটি কলকাতা শহরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা শ্মশান বলে বিবেচনা করা হয়।

স্বজন হারানোদের কান্নায় যাদের দিন অতিবাহিত হয়, সেই ডোমরাই কেওড়াতলা শ্মশানে কালীপূজার রাতে  মায়ের আরাধনায় মত্ত হয়ে ওঠেন। সারা বছর শবদেহ ঘেটে যাদের জীবন চলে তারাই এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা। পূজার রাতেও ওদের ছুটি নেই, শবদেহ আসলেই দাহ করার জন্য ওদের ছুটতে হয়। কর্তব্য পালন করেই তারা পরিবার নিয়ে উৎসবে সামিল হন। শববাহী যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো প্রকার চাঁদা তোলা হয় না, স্থানীয় ব্যবসাদার ও  নিজেদের রোজগারের পয়সায় সম্পূর্ণ আয়োজন করা হয়। সমস্ত নিয়ম নীতি মেনেই ব্রাহ্মণ পূজা করে থাকেন। বাংলার অন্যান্য শ্মশানের মতো এখানেও খুব ঘটা করে পূজা করা হয়ে থাকে। কথিত আছে ১৮৭০ সালে একজন কাপালিক দুজন স্থানীয় ব্রাহ্মণের সাহায্যে শ্মশানকালী প্রতিষ্ঠা করেন। কাপালিক নিজের আনা  প্রতিমাতেই  পূজা করেন এবং পূজার পর প্রতিমা নিয়ে তিনি ফিরে যান। সেই প্রতিমা ছিল দুই হাত বিশিষ্ট ও প্রতিমার কোন জিহ্বা ছিল না। সেই থেকে এখানে ওই ধরনের মূর্তিই পূজিত  হয়ে চলেছে।  এখানকার মূর্তির দুটো হাত অর্থাৎ দেবী দ্বিভূজা। এক হাতে মাটির তৈরী নরমাংস থাকে  আর এক হাতে কারণবারি থাকে। দেবী ,মূর্তি উচ্চতায় ২২ ফুট। প্রতিবছর নিয়ম করেই শ্মশানকালীর পূজা করা হয়, যা আজও সমানভাবে চলে আসছে। দীপান্বিতা অমাবস্যায় মহাসমারোহে নিষ্ঠাভরে এই পূজার আয়োজন করা হয়। এখানে তান্ত্রিক মতে পূজা করা হয়। এখানে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। দেবীকে মুড়ি, চানাচুর, সিঙ্গারা, আট কড়াই ভাজা, ১৪ রকম মাছ, খিচুড়ি, পোলাও, সাদা ভাত ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করা হয়।  এছাড়া বলির মাংসও মেক ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। ১৯২৪ সাল থেকে একটা সর্বজনীন পূজাকমিটির তত্ত্বাবধানে পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর ভাইফোঁটার দিন শ্মশানকালির বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখার মত হয়।  অঞ্চলের অধিবাসীরা এই শোভাযাত্রা চাক্ষুষ করা "খুবই পবিত্র" বলে মনে করে থাকে। আমি দেখেছি, এই শোভাযাত্রার সময় অধিবাসীরা  যাত্রা পথে নিজ নিজ বাজী পুড়িয়ে শোভাযাত্রাটির শোভা আরও বাড়িয়ে তোলে। শোভাযাত্রা যাওয়ার সময় দর্শনার্থীরা সবাই মিলে উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি  দিয়ে থাকে। শোভাযাত্রা থেকে ফুল ও বাতাসা দর্শকদের উদ্দেশ্যে ছোড়া হয়, সেই ফুল ও বাতাসা নেওয়ার জন্য বেশ হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সত্যিই এক অনবদ্য শোভাযাত্রা হয়ে থাকে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :২৭-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

4 comments:

অলোক সরকার ( Alok Sarkar) said...

আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারছি না। যদি সম্ভব হয় দয়া করে আমাকে একটি মেসেজ দেবেন 8346031573এই নম্বরে বা মেইলে

Salil Hore said...

ভালো লাগলো, সমৃদ্ধ হলাম।

Sharmistha Chakraborty Nature Photography said...

Darun laglo dada. Porlam khub monojog diye ����

Unknown said...

খুব ভালো