বেলা মিত্রের জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি
মাত্র কয়েকটি চিঠিতেই স্বামীর ফাঁসি রদ করেছিলেন এক বঙ্গললনা। চিঠিগুলো অবশ্য বঙ্গললনা নিজে লেখেননি, তাঁর অনুরোধে মহাত্মা গান্ধী তৎকালীন ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ ভাইসরয়কে চিঠিগুলো লিখেছিলেন নেতাজি সুভাষ অনুগামী চারজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসির আদেশ বন্ধ করার জন্য। সেই চিঠিগুলোর ফলে অবশ্য তাঁদের ফাঁসি বন্ধ হয়েছিল, ফাঁসির বদলে তাঁরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ভাবছেন নিশ্চই কে এই বঙ্গললনা? তিনি আমাদের রাজ্যের অর্থমন্ত্রী শ্রী অমিত মিত্রের মাতৃদেবী, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ভাইজি, সুরেশচন্দ্র বসুর কন্যা বেলা বসু। ওই চারজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর একজন হলেন হরিদাস মিত্র, যিনি ছিলেন বেলাদেবীর স্বামী। ১৯৭২ সালে হরিদাসবাবু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন। বাকি তিন বিপ্লবী হলেন পবিত্র রায়, জ্যোতিষচন্দ্র বসু ও অমর সিং গিল।
১৯২০ সালে মাতুলালয় ভাগলপুরে জন্মেছিলেন বেলাদেবী। তাঁর পিত্রালয় ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে। ১৯৩৬ সালে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্তচর বিভাগের অন্যতম প্রধান যশোর নিবাসী হরিদাসের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯২০ সালে মাতুলালয় ভাগলপুরে জন্মেছিলেন বেলাদেবী। তাঁর পিত্রালয় ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে। ১৯৩৬ সালে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্তচর বিভাগের অন্যতম প্রধান যশোর নিবাসী হরিদাসের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
বিবাহের বছর দুয়েকের মধ্যে বেলাদেবী তাঁর শশুরবাড়িতে গড়ে তুললেন মহিলা সমিতি। ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন থেকে বেরিয়ে নেতাজি আপস বিরোধী সম্মেলনের ডাক দেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সী বেলা সেই সম্মেলনের মহিলা শাখার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেহালার বাড়ি থেকে তিনি ট্রান্সমিটার মারফত সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুনে নেতাজির সঙ্গে সংবাদ বিনিময়ের ব্যবস্থা করেন। নেতাজির পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের উড়িষ্যার কোনারক মন্দিরের কাছে নিরাপদে অবতরণ করার জন্য বেলা ও তাঁর স্বামী প্রভূত সহায়তা করেন। বেলা দেবীকে এজন্য নিজের প্রায় সমস্ত গহনা বিক্রয় করতে হয়েছিল, হয়েছিল তাঁদের জীবন বিপন্ন।
নেতাজি তখন বিদেশে। ৬এ বিপিন পাল রোডের বাড়িতে ব্রিটিশ পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সুভাষ অনুগামী চার বিপ্লবীর কার্য্যকলাপ চলতো। তাঁরা এই বাড়িটিতে একটি টেলিগ্রাফ সেট বসিয়েছিলেন। এই টেলিগ্রাফ সেটের সাহায্যে তাঁরা সাংকেতিক ভাষায় গোপন খবর নেতাজিকে পাঠাতেন। মূলত এই কাজটি জ্যোতিষচন্দ্র বসু করতেন তাকে সহায়তা করতেন হরিদাস মিত্র ও পবিত্র রায়। ১৯৪৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার হলেন জ্যোতিষচন্দ্র বসু। তার কয়েকদিনের মধ্যে গ্রেফতার হলেন হরিদাস মিত্র, ওমর সিং গিল ও পবিত্র রায়। তাঁদের সকলকেই প্রথমে রাখা হয়েছিল লর্ড সিনহা রোডের গোয়েন্দা বিভাগের বাড়িতে। নেতাজিকে সাংকেতিক ভাষায় জানানো বিভিন্ন সংবাদ জানার জন্য পুলিশ অকথ্য অত্যাচার চালাতো এই বিপ্লবীদের ওপর। কিছুদিন পরে অমর সিং গিল ও জ্যোতিষচন্দ্র কে রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে আর হরিদাস মিত্র ও পবিত্র রায়কে রাখা হয়েছিল আলিপুর জেলে। অল্প দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর চার বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশ হল। জেলেরই এক কর্মীর পরামর্শে হরিদাস মিত্রের স্ত্রী ২২ বছরের বেলাদেবী ও জ্যোতিষচন্দ্রের পিতা রঞ্জন বিলাস বসু পুনায় গিয়ে মহাত্মা গাঁধীর স্বরণাপন্ন হলেন। গাঁধীজি যদি ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড ওভেলকে অনুরোধ করে পত্র দেন তাহলে এই চার বিপ্লবীর ফাঁসির হুকুম রদ হতে পারে এমনই তাঁদের ধারণা ছিল। সত্যি সত্যি একদিন সেই অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। রদ হল তাঁদের ফাঁসির আদেশ। শুধু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে তাঁরা দণ্ডিত হলেন। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টায় শেষমেশ সবার মৃত্যুদণ্ড মকুব হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপচর বিভাগের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হরিদাস ও বেলা বহুদিন সামলেছেন যখন হরিদাস যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জেলে ছিলেন, তখন বেলা নিজ হাতে সব কিছু সামলেছিলেন। শ্রী হরিদাস মিত্র স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের টিকিটে জিতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার হন। কিন্তু বেলাদেবী স্বামীর মতো রাজনীতিরআঙিনায় পা রাখেননি। ১৯৪৭ সালে বেলাদেবী আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টের (Rani of Jhansi Regiment) আদর্শে তৈরী করেন 'ঝাঁসি রানী বাহিনী'। যার সর্বাধিনায়ক তিনিই হন। স্বাধীনতার পর শিয়ালদহ ও অন্য কয়েকটি জায়গায় শরণার্থীদের ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৫০ সালে বালি ও ডানকুনির মধ্যবর্তী জায়গায় অভয়নগর অঞ্চলে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন। কঠিন পরিশ্রমের ফলে তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই ভেঙে পড়তে লাগলো। তিনি কঠিন রোগে পড়লেন। অবশেষে ১৯৫২ সালের ৩১শে জুলাই মাত্র ৩২ বছর বয়সে এই মহিয়সী মহিলার জীবনাবসান হয়। চিরকালই তিনি পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করে গেছেন।
১৯৫৩ সালে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে অভয়নগর অঞ্চলের নামটির পরিবর্তন করে বেলানগর করা হয়। ১৯৫৮ সালে ভারতীয় রেল ওই অঞ্চলে একটা নতুন স্টেশন তৈরী করে তার নামে নামাঙ্কিত করে।
এবছর অর্থাৎ ২০২০ সালে তার জন্মশতবর্ষ। কেউ আজ আর তাঁর নাম করে না। সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোথাও তাঁর জন্ম শতবর্ষের কথা শোনা যায় না। কোথাও তাঁর একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেও শুনিনি। কত সহজেই এই মহিয়সী নারীকে আমরা ভুলে গেলাম।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ২৮-০৩-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment