Monday, March 9, 2020

ল্যাংচা ও শক্তিগড়>P

ল্যাংচা ও শক্তিগড়





বাঙালির খাদ্য তালিকা মিষ্টান্ন ছাড়া ভাবা যায় না। শেষ পাতে মিষ্টি চাইই  চাই।  উৎসব অনুষ্ঠান হোক বা অতিথি আপ্যায়ন হোক রসনা তৃপ্তির জন্য মিষ্টি  অপরিহার্য।  বাংলার মিষ্টিও বৈচিত্রময়।  একেক জায়গা একেক ধরণের মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। স্থান বিশেষে বাঙালির মিষ্টি বিশ্ব জয় করেছে।

বাংলা অভিধানে ল্যাংচা কথাটির অর্থে বলা আছে পঙ্গু বা খোঁড়া অথচ এই শব্দটি বাঙালির রসনা তৃপ্তির জন্য একটি  অনবদ্য শব্দ।  বর্ধমান রাজপরিবারে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের কন্যার বিবাহ হয়েছিল।  বর্ধমান রাজার এই পুত্রবঁধুর গর্ভে যখন সন্তানের  আগমন ঘটলো তখন তাঁর মুখে কোনো সুখাদ্য ভালো লাগছিল না।  পরিবারের লোকেরা এই বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। একদিন বর্ধমান মহিষী অর্থাৎ বঁধুটির শাশুড়ি তাঁর কাছে জানতে চাইলেন তাঁর কি খেতে ইচ্ছে করছে। বালিকা বঁধুটি নতমুখে বলে ফেলেছিলো তাঁর ল্যাংচা খাওয়ার ইচ্ছে করছে।  কিন্তু ল্যাংচা কথাটি রানী পূর্বে কোনোদিন শোনেন নি। তিনি পরিবারের সবার কাছে কথাটি জানালেন। কেউই শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলেন না।  পরেরদিন রাজপুত্র সবার সামনে তাঁর মাকে জানালেন ল্যাংচা কোনো খাদ্যদ্রব্য নয়। একপ্রকার মিষ্টান্ন।  রাজবঁধু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে এক রকম মিষ্টান্ন খেয়েছিলেন, যে মিষ্টান্নটি একজন খোঁড়া মানুষ তৈরী করেছিলেন।  আজ আর তাঁর বঁধুসেই মিষ্টান্নটির নামটা মনে করতে পারছেন না।  সেই খোঁড়া মেঠাইওয়ালার তৈরী সেই মিষ্টিটি তাঁর খাওয়ার স্বাদ হয়েছে। রাজমহিষী গোপনে সংবাদটা মহারাজকে জানালেন।  বর্ধমান মহারাজ  কথাটি শোনার পরই তাঁর বিশ্বস্ত একজন অশ্বারোহীকে একটি জরুরি ও গোপন পত্র দিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে পাঠালেন। কয়েকদিনের মধ্যেই অশ্বারোহী নদিয়ার সেই খোঁড়া ময়রাকে বন্দী করে নিয়ে এসে বর্ধমান রাজপ্রাসাদে হাজির করলেন।  বর্ধমানরাজ সেই ময়রাকে বর্ধমান শহরের পুবদিকে প্রায় ক্রোস চারেক দূরে বড়সুল গ্রামে কিছু ভূসম্পত্তি দান করলেন এবং তার বসবাসের জন্য একটি ঘরও তৈরী করে দিলেন।  প্রতিদিন ময়রার ভিয়েন থেকে রাজবাড়িতে প্রায় মন খানিক এই বিচিত্র ধরণের মিষ্টান্ন সরবরাহ হতে লাগল। খোঁড়া ময়রা প্রতিষ্ঠা পেলেন ল্যাংচা বিশারদ হিসেবে। উপরিউক্ত কাহিনীটি বিখ্যাত লেখক নারায়ণ স্যান্যালের 'রূপমঞ্জরী' উপন্যাস অবলম্বনে লেখা। ল্যাংচা বিশেষভাবে তৈরী একপ্রকার রসের  ভাজা মিষ্টি, খেতে খুবই সুস্বাদু ও নরম।  রঙ হয় কালচে বাদামি। ময়দা, ছানা, খোয়া ক্ষীর ও চিনির সাহায্যে এই মিষ্টি তৈরী করা হয়।


কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরে বর্ধমান বা বোলপুর-শান্তিনিকেতন যাওয়ার সময় সবাই শক্তিগড়ে যাত্রাবিরতি নেয়।  এই শক্তিগরের পূর্বে নাম ছিল বড়সুল। রাস্তাটার দুধারে অসখ্য মিষ্টির দোকান। দোকানগুলোর নাম বেশিরভাগ ল্যাংচা শব্দটি দিয়ে কোনটা ল্যাংচা ঘর, কোনটা ল্যাংচা সম্রাট, ল্যাংচা প্লাজা, ল্যাংচা নিকেতন আবার কোনটা ল্যাংচা কুঠি এরকম। বাহারি স্বাদের মতো নামের বাহার সব।   সেখানেই পাওয়া যায় এই সুবিখ্যাত ও সুস্বাদু মিষ্টিটি।  গাড়ি থামিয়ে গরম গরম ল্যাংচার স্বাদ নিতে কেউ ভোলে না। যদিও বর্তমানে ল্যাংচা আর শক্তিগড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই তা পৌঁছে গেছে  ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই।  তবে শক্তিগড়ের ল্যাংচার স্বাদ ভিন্ন ধরণের। রসগোল্লা, ল্যাংচা, সন্দেশ বাঙালির খুবই প্রিয়। শক্তিগড়ের ল্যাংচা খাননি এরকম বাঙালি বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্ধমানের শক্তিগড়ের ল্যাংচা ছাড়াও সীতাভোগ ও মিহিদানাও খুব প্রসিদ্ধ। বছর আড়াই আগে বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহিদানা ভৌগোলিক স্বীকৃতি (জি. আই) পেয়েছে। এবার শক্তিগড়ের ল্যাংচার এই স্বীকৃতি পাওয়ার পালা।


ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ১০-০৩-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




No comments: