Monday, February 4, 2019

দেরে গ্রাম ভ্রমণ Deregram >

দেরে গ্রাম


হুগলী  জেলার গোঘাট থানার অন্তর্গত একটি ছোট্ট  গ্রামের নাম 'দেরে'। তবে সরকারী  খাতায় এই দেরে গ্রামটির নাম ছিল অবশ্য  "দ্বারিয়াপুর"। এই গ্রামটি কামারপুকুর থেকে মাত্র দু-তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কেউ কেউ একে দ্বারিয়াপুর নামে এখনো ডেকে থাকে। এককালে এই গ্রামেই এক মহাপুরুষের পৈতৃক বাস্তুভিটে ছিল। তাঁদের বাড়ী অর্থাৎ  বাস্তুভিটের সাথে রন্ধনশালা, রঘুবীরের মন্দির, বসতবাড়ী ও একটা গোয়ালঘরও ছিল। এই বাড়ী ও ঘরগুলো ছাড়াও প্রায় দেড়শ বিঘার মত চাষের জমিও ছিল।  

 শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পৈতৃক বাস্তুভিটে  এই দেরে গ্রামেই ছিল।  তাঁর পিতা শ্রী ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ১৭৭৫ সালে এই দেরে গ্রামেই  জন্মগ্রহণ করেন।  তিনি তাঁদের কুল দেবতা রঘুবীরের খুব  ভক্ত ছিলেন।তিনি একজন সৎ, কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। সৎ ব্রাহ্মণদের যেমন সত্যনিষ্ঠা, ক্ষমা, ত্যাগ করার গুণ থাকে,  ক্ষুদিরামের ভিতরেও ওই সকল গুণ প্রচুর পরিমানে ছিল। গ্রামবাসীরা তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। তাঁর বংশের দেবতা রঘুবীরের পূজা না করে তিনি কখনো জলগ্রহণ করতেন না।  পিতার মৃত্যুর পর সংসার ও বিষয় সম্পত্তির দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। তাঁর প্রথম স্ত্রী খুব অল্প বয়েসে মারা যান। পঁচিশ বছর বয়েসে ক্ষুদিরাম  ১২০৫ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন। তিনি সরাটিমায়াপুর গ্রামের  আট  বছরের কন্যা শ্রীমতি চন্দ্রমনির পাণিগ্রহণ করেন। এই দেরে গ্রামেই ১৮০৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর  জ্যেষ্ঠ পুত্র  রামকুমার ও ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে   তাঁর জ্যেষ্ঠা  কন্যা  কাত্যায়িনী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ক্ষুদিরাম স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও   তাঁর দুই ভ্রাতা নিধিরাম ও কানাইরামকে নিয়ে দেরে গ্রামে বেশ সুখেই বসবাস করছিলেন। কিন্তু এই সুখ তাঁর বেশিদিন সইলো না। 


কামারপুকুরের পশ্চিমদিকে সমতাবেড়ে, নারায়ণপুর ও দেরে এই তিনটি গ্রামের অবস্থান একদম পাশাপাশি ছিল। গ্রাম তিনটি খুবই সমৃদ্ধিসম্পন্ন গ্রাম ছিল। এই তিনটি গ্রাম কিন্তু আলাদা আলাদা জমিদারের জমিদারীতে ছিল। সেই  আমলে দেরে গ্রামের জমিদার ছিলেন রামানন্দ রায়।  তিনি অবশ্য সমতাবেড়ে গ্রামে বসবাস করতেন। দেরে গ্রামের একদম পাশেই ছিল এই সমতাবেড়ে গ্রামটা। সরকারী  খাতায় অবশ্য গ্রামটির নাম ছিল "সাতবেড়িয়া" এই দেরে গ্রামের জমিদার রামানন্দ রায় খুবই  সমৃদ্ধিসম্পন্ন জমিদার ছিলেন। তিনি সমৃদ্ধিসম্পন্ন হলেও  ভীষণ অত্যাচারী ও প্রজাপীড়কও ছিলেন।  রামানন্দ রায় নিজে কোনো জমিদারি গড়ে তুলতে পারেননি, বরঞ্চ  পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া জমিদারী  তিনি নষ্টই  করেছিলেন।  


১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশে লর্ড কর্নওয়ালিস "চিরস্থায়ী ব্যবস্থা" চালু করেছিলেন।  এই  চিরস্থায়ী ব্যবস্থায়পনায়   তখনকার জমিদারদের প্রজা উচ্ছেদ করা খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। সাধারন গরীব লোক এই ইতিহাস- কুখ্যাত  প্রথায় খুবই অসুবিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। এই প্রথার সাহায্য নিয়ে  সেই সময় অত্যাচারী জমিদাররা কুটিল ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে গ্রামের সহজ সরল প্রজাদের জমি দখল করে নিতেন।   

দেরে গ্রামের কাছেই খেঁজুরবাদি, কোকন্দ , বেতরা ইত্যাদি গ্রামগুলো সেই সময় নকুন্ডা  লাটের অধীনে ছিল। কলকাতার মিত্র পরিবার এই লাটের মালিক ছিল।  কলকাতার সেই মিত্র পরিবারের সন্তান দুর্গাচারণ মিত্রের কাছ থেকে উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ মুখার্জী ১৮২৫ সালে এই লাটটি  কিনে নেন। দূর্গাচরণ মিত্রের পিতার সাথে  জমিদার রামানন্দ রায়ের বর্ধমান জেলার ফৌজদারি আদালতে  একটা ফৌজদারি মামলা সেই সময় চলছিল। এই মামলায় জমিদার রামানন্দ রায়  সৎ ব্রাহ্মণ ক্ষুদিরামকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু  ক্ষুদিরাম মহাশয় খুব ধার্মিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি কোন মিথ্যা কথা বলে সাক্ষ্য  দিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে এই মামলায় রামানন্দ রায় হেরে যান। তিনি মিত্র পরিবারের সাথে বিবাদও মিটিয়ে ফেলেন। ঘটনাচক্রে,ঠিক  ওই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে  প্রথম বছর প্রচন্ড খরা আর দ্বিতীয় বছরে অতি বৃষ্টির ফলে এই অঞ্চলগুলিতে  কারোরই সেরকম ফসল ফলে নি। ক্ষুদিরামের ফসলও একদমই ভালো হয়নি। দরিদ্র ক্ষুদিরামের পক্ষে জমিদারের খাজনা দেওয়াও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। জমিদার রামানন্দ রায় মামলায় ক্ষুদিরামের  সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য তিনি হেরে গিয়েছিলেন। সেই রাগ তার মনে পোষা ছিল। রামানন্দ রায় লর্ড কর্ণওয়ালিসের  কুখ্যাত চিরস্থায়ী ব্যবস্থার অস্ত্রটি সৎ ব্রাহ্মণ ক্ষুদিরামের ওপর প্রয়োগ করলেন। তিনি রাজস্ব বকেয়ার অভিযোগে ক্ষুদিরামের সমগ্র কৃষিজমিটি কেড়ে নিলেন। তার বস্তুভিটাটা দখল করার  জন্য বর্ধমান জেলার দেওয়ানি আদালতে ক্ষুদিরামের নামে একটা মিথ্যা মামলা করেন। নিরীহ প্রকৃতির ক্ষুদিরাম আইন আদালত একদমই পছন্দ করতেন না।  তিনি  রামানন্দের মিথ্যা চক্রান্তের বিরুদ্ধে কোনো  প্রতিবাদ করলেন না।  তিনি এক বারের জন্যও আদালতে উপস্থিতও   হলেন না। যথারীতি জমিদার রামানন্দ রায় আদালত থেকে একতরফাভাবে ডিক্রি লাভ করলেন। এই ডিক্রির ওপর ভিত্তি করেই তিনি ক্ষুদিরামের বাস্তুভিটাও  অধিকার করে নিলেন।  তাঁকে তাঁর পরিবারসমেত  বাস্তুচ্যুত করে ছাড়লেন।  

১৮১৪ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ক্ষুদিরামকে ও  তাঁর পরিবারকে  দেরে গ্রামের তাঁদের পৈতৃক ভিটের মায়া ত্যাগ করতে হল। তিনি এই গ্রাম ছেড়ে কামারপুকুরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন। তখন কামারপুকুর লাটের অধিকর্তা ছিলেন সুখলাল গোস্বামী। এই সুখলাল গোস্বামীর সাথে  ক্ষুদিরামের পূর্ব পরিচয় ছিল। তিনি সেই পরিচয়টাকে অবলম্বন করে  কামারপুকুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন।  এখানে  আসার পর তিনি  সুখলাল গোস্বামী মহাশয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে সব ঘটনা জানান।  সুখলাল গোস্বামী মহাশয় গরিব ব্রাহ্মনের সব কথা শোনার পর তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে কাছারিবাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করার বন্দোবস্ত করে দিলেন।  কিছুদিন পর তিনি হালদার পুকুরের পশ্চিমদিকে ডোমপাড়ায় সাড়ে তিন কাঠা বাস্তুজমি ও দুই বিঘা তিন কাঠা চাষের জমি ক্ষুদিরামকে দান করলেন। ক্ষুদিরাম তাঁর  দশ বছর বয়সী পুত্র রামকুমার, চার বছর বয়সী কন্যা কাত্যায়নী ও স্ত্রী চন্দ্রমণিদেবীকে নিয়ে কামারপুকুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। 

এই কামারপুকুরেই ১৮৩৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন, শুক্লা দ্বিতীয়াতে )  শ্রীমতি চন্দ্রমণি দেবীর কোল আলো করে ক্ষুদিরামের ঢেঁকিশালে তাঁর পুত্র গদাধর জন্মগ্রহণ করলেন। পরবর্তীকালে এই গদাধরই  যুগপুরুষ  ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হন। কামারপুকুর গ্রামই ঠাকুরের পবিত্র জন্মভূমি, তাঁর বাল্য ও কৈশোরের লীলাভুমি। 

প্রায় দুশো বছর পর দেরে গ্রামের ক্ষুদিরামের বাস্তুভিটেতেই স্থানীয় বাসিন্দাদের উৎসাহে ও সকলের আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় "দ্বারিয়াপুর ক্ষুদিরাম রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম " ও "ক্ষুদিরাম স্মারক মন্দির" ২০০২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর ক্ষুদিরাম রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের নবনির্মিত মন্দিরটির  উদ্বোধন করেন রামকৃষ্ণ মঠ  ও রামকৃষ্ণ মিশনের মহাধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী গহনানন্দজী মহারাজ।  কালের গর্ভে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটের  প্রায় সবই নষ্ট  হয়ে গেছে কিন্তু তাঁদের পুকুরটা অর্থাৎ 'চাটুজ্জ্যে পুকুর' টা আজও  আছে।  এছাড়া ২০০ বছর পূর্বের মন্দিরের দরজাটা এখনো এখানে আসলে দেখা যায়।  




কি করে যাবেন :- 

হাওড়া থেকে ট্রেনে করে গোঘাট স্টেশনে নেমে টোটো গাড়ি করে দেরে গ্রামে পৌঁছনো যায়।  এছাড়া হাওড়া বা কলকাতার  ধর্মতলা থেকে সরকারি ও বেসরকারি বাসে করে সরাসরি কামারপুকুরে পৌঁছে টোটো করেও এখানে আসা যায়।


কোথায় থাকবেন :-

দেরে গ্রামে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। কামারপুকুরে মিশনের নিজস্ব গেস্ট হাউস আছে.।  অনেক আগে থেকে এই গেস্ট হাউসটিকে ভাড়া করতে হয়, না হলে পাওয়া যায় না।  এছাড়া কামারপুকুর  মন্দিরের বাইরে রাস্তার ওপর অনেকগুলো বেসকারি থাকার লজ আছে।  বিশেষ বিশেষ দিনগুলো ছাড়া এই লজগুলো সাধারণত ফাঁকা পাওয়া যায়। 





তারিখ : ২০-০১-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

5 comments:

Anonymous said...

Wonderful information

Unknown said...

জয়কৃষ্ণ মুখার্জি এর বংশতালিকা টি দিলে খুব উপকৃত হই।

SUDIPTA MUKHERJEE'S BLOG said...

দুঃখিত, আমার জানা নেই।

Anonymous said...

খুব ভালো তথ্য।

Anonymous said...

জয়কৃষ্ণ মুখার্জির বংশলতিকার জন্য ওই পরিবারেরই সন্তান দেবাশিস মুখার্জির লেখা বই দেখতে পারেন।