Wednesday, February 13, 2019

স্মরণে: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র Birendra Krishna Bhadro>

বাজলো তোমার আলোর বেনু....






আমার ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় ঠাকুর তৈরী করা হতো, প্রতিদিন তিন থেকে চারবার তা দেখতে যেতাম , কতটা তৈরী হলো আর কতটাই বা বাকি রয়ে গেলো, তা নিয়ে সারাক্ষণই মনের মধ্যে গবেষণা চলতো । এই ঠাকুর দেখেই আমি মায়ের আগমন অনুভব করার চেষ্টা করতাম। যেহেতু আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা সবটাই শহর কেন্দ্রিক, তাই শিউলির গন্ধ বা কাশের দোলা দেখার সুযোগ আমার ছিল না। মহালয়ের প্রভাতে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বলিষ্ঠ উদাত্ত কণ্ঠের স্তোত্রপাঠ ও "জাগো, তুমি জাগো, জাগো দশ প্রহরণ ধারিণী" দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গুরু গম্ভীর গলায় গাওয়া গান কানে পৌঁছনোর পরই "মা আসছে" এই শব্দটা যেন শরীরের শিরা-উপশিরায় পৌঁছে যেত, সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে যেত। মহালয়া ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যেন একে ওপরের পরিপূরক। তিনি ছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক।  

উত্তর কলকাতার মাতুলালয়ে ১৯০৫ সালের ৪ঠা  আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ আর মাতা ছিলেন সরলাদেবী।  তাঁর পিতা বহুভাষায় বিশারদ ছিলেন।  তিনি ১৪টি ভাষা জানতেন। নিম্ন আদালতে দোভাষীর কাজ করতেন। তিনি লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯২৭ সালে "রায়বাহাদুর" খেতাবটি পান। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের দাদামশাই ছিলেন পুলিশ কোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। প্রথমে তাঁর পরিবার উত্তর কলকাতার এক ভাড়াবাড়িতে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঠাকুমা শ্রীমতি যোগমায়াদেবীর কেনা ৭ রাধারমণ মিত্র লেনের বাড়িতে তাঁরা সপরিবারে উঠে আসেন। ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ নামে তাঁর আর এক ভাই ছিলেন। প্রথমে তিনি রেলের  চাকরি করতেন। তারপর রেলের চাকরি ছেড়ে তিনি আকাশবাণীতে যোগ দেন।  

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ১৯২৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯২৯ সালে তিনি আকাশবাণীতে যোগদান করেন। ১৯৩১ সালে প্রথম "মহিষাসুরমর্দ্দিনী " সংগীতালেখ্যটি প্রচার হয়, যা আজও সবার কাছে সমান জনপ্রিয়। রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ও মাতা সরলাদেবীর কনিষ্ঠ সন্তানকে এই গীতিআলেখ্যটি খ্যাতির উচ্চসীমায় পৌঁছে দেয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুধু বেতার সম্প্রচারক ছিলেন না, তিনি নাট্যকার, নাট্য প্রযোজক, ও অভিনেতাও ছিলেন। "হিতোপদেশ". " বিশ্বরূপ দর্শন". "রানা-বেরানা" প্রভৃতি বই তিনি লেখেন। "বিরূপাক্ষ" এই ছদ্মনামেও তিনি  অনেকগুলো রম্য রচনাও লিখেছিলেন। এছাড়া ১৯৫৫ সালে তিনি "নিষিদ্ধ ফল" নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেন, বিমল মিত্রের "সাহেব বিবি গোলাম" উপন্যাসটি মঞ্চায়িত করেন, ১৯৫২ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের "সুবর্ণ গোলক " গল্পটিকেও নাট্যায়িত করেন। 

বেতারে প্রতি বছর প্রচারিত মহালয়ার প্রভাতে মহিষাসুরমর্দিনী সংগীতালেখ্যটি বীরেন্দ্র কৃষ্ণকে  সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছে।মহিষাসুরমর্দিনী সেই ১৯৩১ সালে আকাশবাণীতে প্রথম প্রচার হয় মহালয়ের পুন্য প্রভাতে। তখন নাম ছিল "প্রত্যুষ প্রোগ্রাম" পরের বছর ওই দিনে ওই প্রোগ্রামটা আবার প্রচারিত হয়, কিন্তু নামটির পরিবর্তন করে করা হয় "প্রভাতী অনুষ্ঠান" এই নামে  অনুষ্ঠানটা আরো দুবছর চলার পর আবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "মহিষাসুর বধ"  কিন্তু এতেও অনুষ্ঠান কর্তারা সন্তুত  হতে পারলেন না,  তারা পরের বছর আবার নামটির পরিবর্তন ঘটান, এবার তারা নাম দেন :"মহিষাসুরমর্দিনী"  এই মহিষাসুরমর্দিনী হল শ্রী শ্রী চন্ডীর স্তোত্র বা চন্ডীপাঠ, বাংলা ভক্তিগীতি ধ্রপদী সংগীত এবং পৌরাণিক কাহিনীর এক অসামান্য নাট্যরূপ। যা রচনা করেছিলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুরে আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অনবদ্য গ্রন্থনা ও শ্লোকপাঠে বেতারের এই মহিষাসুরমর্দিনী সংগীতালেখ্যটি  আজও অর্থাৎ রচনার প্রায় ৯০ বছর পার করেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভ্রদ্রকে অবিস্মরনীয় করে রেখেছে। এখনো তার জনপ্রিয়তা বা মহিমায় এতটুকু ভাটা  পরেনি।  দেবীপক্ষের সূচনায় মহালয়া অমবস্যা ও দুর্গা পুজোর সাথে এই অনুষ্ঠানের  যেন নাড়ির যোগ রয়েছে। এখনো মানুষের মনে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের অসাধারণ গুরুগম্ভীর কণ্ঠের সেই  শ্লোক ও  স্ত্রোত্রের  পাঠ কানে না পৌঁছলে যেন শারদীয়া উৎসবের আমেজ মনে আসে না। 


প্রসঙ্গক্রমে একটা ঘটনার কথা বলি,  ১৯৭৬ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে না জানিয়ে আকাশবাণীর কর্তারা একটা গোপন বৈঠক করে ঠিক করেন, এই বছর মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের বদলে মহালয়ার প্রভাতে  তারা  "দেবী দুর্গতিনাশিনী " নামে  একটা অনুষ্ঠান করবেন। যেমন ভাবনা ঠিক তেমন কাজ। তারা অনুষ্ঠানটি লেখার জন্য বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর গোবিন্দ গোপাল মুখার্জী মহাশয়কে ঠিক করলেন।  ভাষ্যপাঠের জন্য মহানায়ক উত্তমকুমারকে দায়িত্ব দিলেন।  মহানায়ক প্রথমে এই দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিলেন  না। অবশেষে বিভিন্নজনের  চাপাচাপিতে তিনি কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই রাজি হলেন। আকাশবাণীর এই কাজে তিনি যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেন। এই ভাষ্যপাঠ রেকর্ডিং করার আগে তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়িতে গিয়ে তার অয়োগ্যতা ও অস্বস্তির কথা জানান।  সহজ সরল মানুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাকে উৎসাহ দেন ও বলেন কোনো চিন্তা না করতে সব ঠিক হয়ে যাবে। যথারীতি নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠানটা আকাশবাণী থেকে পরিবেশন করা হল।  বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বাড়িতে বসে অনুষ্ঠানটার সবটা শুনছিলেন। অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি শুধু বলেছিলেন " লোকে যদি নেয় তাহলে নিক" কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে বাদ দিয়ে  এই অনুষ্ঠানটা বাংলার মানুষ মেনে নিতে পারেনি।  এই নিয়ে আকাশবাণী ভবনে বিক্ষোভ দেখান বেশ কিছু মানুষ।  আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই সেই বছর ষষ্ঠীর প্রভাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের "মহিষাসুরমর্দিনী" সংগীতালেখ্যটি আবার প্রচার করে।   


শ্রী অজিত বসু তাঁর বইতে এক জায়গায় শ্রী বীরেন্দ্রকুমার ভদ্রের একটা লেখা দিয়েছেন যে "২২শে শ্রাবনের মধ্যাহ্নে সজনীকান্ত দাস জোড়াসাঁকো থেকে সর্বাগ্রে খবর পাঠালেন যে রবীন্দ্রনাথ  প্রয়াত  হয়েছেন। সঙ্গে  সঙ্গেই সেই সংবাদ কলকাতা বেতারে  প্রচার করেই আমি ছুটে গেলাম জোড়াসাঁকো। বেতারের যন্ত্রপাতি ও ইঞ্জিনিযারদের নিয়ে শ্বশান ঘাটে ছুটে গেলাম আমরা, আমার সঙ্গী ছিলেন মনমোহন ঘোষ (চিত্রগুপ্ত), দুজনে সেখানকার ব্যবস্থা ঠিক করেই   ছুটলাম জোড়াসাঁকোয়।  লোকে লোকেলোকারণ্য। গেটের মধ্যে জোর করে ঢুকে কবিকে শেষ দর্শন করার জন্য অগণিত জনতা গেটে ধাক্কা দিচ্ছে - তার ফলে একটি গেট ভেঙে গেলো। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ভিতরে প্রবেশাধিকার পেলেন না বা পাওয়া সম্ভবও  ছিল না।  ঠাকুর বাড়িতে শবদেহ বেশিক্ষন রাখার রীতি নেই, বিশেষত মধ্যাহ্নে যিনি মহাপ্রয়াণ করেছেন, তাঁকে বিকেলের মধ্যেই নিয়ে যেতে হবে।  অগণিত জনতা রবীন্দ্রনাথের শ্বাশানুগমন করতে থাকে। আমরাও সংবাদ সংগ্রহ করতে নিমতলা শ্বশান ঘাটে উপস্থিত হই। তিলধারণের স্থান নেই, একটি মই সংগ্রহ করে শ্বশান ঘাটের একটি চূড়ায় উঠলাম আমি, তারপর নামলাম একটি ভগ্ন আলসের ওপরে, হাত দিয়ে ধরবার মতো কোনো জিনিস সেখানে ছিল না এবং সেখানে বিপদ তুচ্ছ করে বসে এক হাতে মাইক্রোফোন ধরে রেকর্ড করতে লাগলাম রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্যের সংবাদ। দুঃখের বিষয় সেদিন যে আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে আমি ধারাবিবরণী রেকর্ড করেছিলাম সেই রেকর্ডটি বেতারে আর নেই।   সহস্র রেকর্ডের সঙ্গেই ভগ্ন হয়ে গেছে, তার কোনো নকল করেও রাখা হয়নি। 

সেই ধারাবিবরণী শুনে একদিন রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী শ্রীমতি সরলা দেবী স্বয়ং বেতার অফিসে এসে আমাকে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন। সমগ্র বাঙালির জাতির মনে যে দুঃখের ঝড় সেদিন বয়েছিল তারই সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে পেরেছিলুম - " সমুখে দেখছি অপরাহ্নের সূর্য শেষ বিদায়ের পথ নিচ্ছে - ভাগীরথীর গৈরিক জলপ্রবাহে উঠেছে এক করুন তাপ - আজ সমস্ত বাংলার বুকে দীর্ঘশ্বাসের ওঠা-পড়া - বাতাসে হাহাকার - বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ আর নেই।  রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের জানি, কিন্তু তিনি বাঙালির রবিঠাকুর, বাঙালির গৌরব, বাঙালির প্রাণের প্রাণ, একটি আপনজন। - আজ সূর্যকে কি বিসর্জন দিয়ে চিররাত্রির অন্ধকারের মধ্যে বাঙালি জাতি আত্মগোপন করবে - না আবার সে নবসূর্যের আলোক সভাতলে জ্যোতির সমুদ্রে স্নান করতে পারবে ? সমগ্র বাঙালির মনে এই প্রশ্ন উঠছে বার বার, আজ তাই সকলের মনে এই প্রার্থনা জেগে উঠছে, হে কবি, হে পুরাতন, হে চিরনূতন - রাত্রির অবসান ক্ষণিক হোক - আগামীকালের নবপ্রভাতে নূতনরূপে তুমি দেখা দাও, - দেখা দাও আবার হে নুতন। "

উত্তমকুমারের  মৃত্যুর পরও তাঁর  অন্তিম যাত্রার ধারাবিবরণী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র দিয়েছিলেন। তিনি ভাষা ও কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করেছিলেন, তা শোকাতুর বাঙালির চোখের জলের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিলো।


তিনি খুব অভিমানীও ছিলেন। চাদর ও উত্তরীয় ছাড়া কোনো সরকারি খেতাব বা সম্মান তার জোটেনি।






তারিখ : ১৩-০২-২০১৯
লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া



যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

No comments: