কালের সাক্ষী মহিষাদল রাজবাড়ী
মুঘলদের বাংলা জয়ের পর থেকেই বাংলায় জমিদারি প্রথা শুরু হয়। জমিদারদের ব্যাক্তিত্বের ইতিহাস, প্রভাব ও নানারকম পৃষ্ঠপোষকতার গল্প ছড়িয়ে আছে বাংলার গ্রামে গ্রামে। শুধু গ্রাম নয়, শহর কলকাতাতেও তাদের নানারকম কাহিনীর কথাও আমরা জানি। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় বেশ কয়েকটি রাজবাড়ীর হদিশ পাওয়া গেলেও বর্তমানে ঝাড়গ্রাম ও মহিষাদল রাজবাড়ী দুটি জেলার মানুষের আবেগ বহন করে চলেছে৷ প্রায় চারশো বছরের পুরনো মহিষাদল রাজবাড়িটি এখনও অতীত যুগের ঐতিহ্য বহন করছে ।
মুঘলদের বাংলা জয়ের পর থেকেই বাংলায় জমিদারি প্রথা শুরু হয়। জমিদারদের ব্যাক্তিত্বের ইতিহাস, প্রভাব ও নানারকম পৃষ্ঠপোষকতার গল্প ছড়িয়ে আছে বাংলার গ্রামে গ্রামে। শুধু গ্রাম নয়, শহর কলকাতাতেও তাদের নানারকম কাহিনীর কথাও আমরা জানি। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় বেশ কয়েকটি রাজবাড়ীর হদিশ পাওয়া গেলেও বর্তমানে ঝাড়গ্রাম ও মহিষাদল রাজবাড়ী দুটি জেলার মানুষের আবেগ বহন করে চলেছে৷ প্রায় চারশো বছরের পুরনো মহিষাদল রাজবাড়িটি এখনও অতীত যুগের ঐতিহ্য বহন করছে ।
মন চাইছিল আজ ইতিহাসের খোঁজ পেতে। তাই পুরনো রাজবাড়ীর সন্ধানে আজকের গন্তব্য মহিষাদল রাজবাড়ী। কলকাতা থেকে ১২০ কিমি দূরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমায় ৭০ একর জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এই বিশাল রাজবাড়ীটি। রাজা নেই। রাজত্বও নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে রাজাদের সেই ঐতিহ্য। মহিষাদল রাজবাড়ী সেই ঐতিয্যেরই প্রতীক। মহিষাদলের রাজাদের ও এই রাজবাড়ীর ইতিহাস বহু প্রাচীন।
তাম্রলিপ্ত বন্দরটি যখন রমরমিয়ে চলছে,গেঁওখালী, মহিষাদল অঞ্চলগুলি তখনও সমুদ্রগর্ভে। মধ্যযুগ থেকেই এই জমিদারি প্রথমে রায়চৌধুরী পরিবার, দ্বিতীয় উপাধ্যায় পরিবারের হাত ঘুরে শেষে গর্গ পরিবারের হাতে আসে। ১৬৫৩ সাল যখন বাংলার মসনদে শাজাহানের পুএ সুলতান সুজা। তখন মহিষাদলে প্রথম রাজা হন কল্যাণ রায়চৌধুরী। রায়চৌধুরীরা জমিদারি বেশিদিন চালাতে পারেননি। তারা গেঁওখালির ধনী ব্যবসায়ী কনৌজের ব্রাহ্মণ জনার্দন উপাধ্যায়কে নীলামে জমিদারি বিক্রি করে দেন। ব্যবসায়ী জনার্দনের উত্তরসূরিরা এই বিশাল ভূখণ্ডের শাসক হয়ে রাজ্যপাট চালাতে থাকেন। জনার্দনের পুত্র দুর্যোধন, দুর্যোধনের পুত্র রামশরণ, রামশরণের পুত্র রাজারাম, রাজারামের পুত্র সুখলাল, সুখলালের পুত্র আনন্দলাল একে একে রাজত্ব চালান। আনন্দলালের কোনো পুত্র ছিল না তার একমাত্র কন্যার বিবাহ হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় আনন্দলালের মৃত্যুর পর তার ধর্মপ্রানা স্ত্রী জানকীদেবী ১৭৭০ সালে রাজ সিংহাসনে বসেন। জানকীদেবী বেশ দক্ষতার সাথেই রাজ্যপাঠ চালিয়েছেন। জানকীদেবী তার মৃত্যুর আগেই তার একমাত্র কন্যা মন্থর গর্গের পুত্র অর্থাৎ জানকীদেবীর দৌহিত্র গুরুপ্রসাদ গর্গকে মহিষাদলের সমস্ত ভূসম্পত্তি, রাজপ্রাসাদ দান করে দেন। গুরুপ্রসাদ গর্গ সিংহাসনে বসেন। সেই থেকে গর্গ পরিবারের জমিদারি শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেরদিন পর্যন্ত এই গর্গের বংশধররাই এখানকার রাজ্যপাট চালিয়ে গেছেন। বর্তমানে এই গর্গ পরিবারের হাতেই এখানকার জমিদার বাড়ি ও তদসংলগ্ল ভূখণ্ডটি রয়েছে।
এই রাজ্ পরিবার ক্রমানুযায়ী তিনটি রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। প্রথম রাজবাড়ীটি অবলুপ্ত, বর্তমানে দুটি রাজবাড়ী রয়েছে। দ্বিতীয় রাজবাড়ী রঙিবসান (সিংহদুয়ার ) রাজবাড়ী, যা নবাব আমলে অর্থাৎ ১৮৪০ সালে তৈরী হয়েছিল। তৃতীয় রাজবাড়ী তথা শেষ রাজবাড়ী (ফুলবাগ রাজবাড়ী) রঙ্গীনবসান রাজবাড়ীর তৈরীর প্রায় ৯৪ বছর পরে ১৯৩৪ সালে ইংরেজ আমলে রাজা সতী প্রসাদ গর্গ নিজস্ব পরিকল্পনায় তৈরী করেছিলেন। রঙ্গীনবসান রাজবাড়ীটি বর্তমানে ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। ফুলবাগ রাজবাড়ীটিতে রাজ পরিবারের লোকেরা দ্বিতীয় তলে এখনো বসবাস করে। প্রথমতলে একটা সুন্দর সংগ্রহশালা রয়েছে। এছাড়া জলবাংলো (লালকুঠি ) নামে আর একটা বাড়ী আছে যেখানে রাজারা গ্রীস্মকালীন ছুটি কাটাতেন।
রঙ্গীনবসান রাজবাড়িটি সংরক্ষণের জন্য হেরিটেজ দপ্তর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । জেলা শাসকের দপ্তর থেকে ইতিমধ্যে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বলে এখানকার এক প্রবীণ বাসিন্দা জানালেন। তিনি আরো জানালেন যে রাজ্য সরকারের পি.ডব্লু ডি দপ্তর বেশ জোর কদমে সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। এই বাড়ীটি সংস্কারের বহুদিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি আজ পূরণের পথে এগিয়ে চলেছে।
রঙ্গীনবসান রাজবাড়িটি সংরক্ষণের জন্য হেরিটেজ দপ্তর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । জেলা শাসকের দপ্তর থেকে ইতিমধ্যে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বলে এখানকার এক প্রবীণ বাসিন্দা জানালেন। তিনি আরো জানালেন যে রাজ্য সরকারের পি.ডব্লু ডি দপ্তর বেশ জোর কদমে সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। এই বাড়ীটি সংস্কারের বহুদিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি আজ পূরণের পথে এগিয়ে চলেছে।
এই রাজ্ পরিবার বহু জায়গায় দেব-দেবীর মন্দির, রথ নির্মাণ, পুস্করিণী-দীঘি-ইঁদারা খনন, এই অঞ্চলে প্রথম দূর্গা পুজোর প্রচলন, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ গড়ে তোলা ইত্যাদি নানা রকম লোকহিতকর কাজ করেছিলেন। সেই সঙ্গে শরীর চর্চা, খেলাধুলা ,সুক্ষ সূচি-শিল্প , চিত্রকলা, উচ্চাঙ্গ সংগীতের সঙ্গে নানা বাদ্যযন্ত্রের মধ্য দিয়ে ললিতকলা-চারুকলার পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রানী জানকী দেবী মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রার প্রচলন করেন। দুই শতক পার করে আজও এখানকার এই রথের উত্সব, রথের মেলা এবং দুর্গাপুজোর আকর্ষণ অম্লান। মহিষাদলের রাজবাড়ির রথে কিন্তু শ্রীজগন্নাথদেব আরোহন করেন না। আরোহন করেন মহিষাদল রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনগোপাল জীঊ। পূর্বে ১৭ চূড়াবিশিষ্ট রথ টানা হতো, তবে বর্তমানে ১৩ চূড়াবিশিষ্ট রথ টানা হয়। এই রথে ৩৪টি চাকা রয়েছে। রাজা সতীশ প্রসাদ গর্গের আমলে রথের সামনে দুটি ঘোড়া থাকতো। বর্তমানে মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি পূর্বের সবরকম রীতিনীতি বজায় রেখে রথযাত্রা উৎসবটি পরিচালনা করে। মহিষাদল রাজবাড়ীর দূর্গাপুজো প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো পুজো। পুরোনো বনেদিয়ানা ও রীতিনীতি যতটা সম্ভব বজায় রেখে এখনো এই পুজো করা হয়। এলাকাবাসীদের কাছে রাজবাড়ীর পুজোর আকর্ষণ সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই একটা আলাদা মাত্রা পেয়ে আসছে । এখনো অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে এখানে স্থানীয়দের ভীড় উপচে পরতে দেখা যায়।
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে যে রাজবাড়ীর চলা শুরু হয়েছিল তাদের কিছু নিদর্শন এক সংগ্রহশালার মাধ্যমে তারা তুলে ধরেছেন।দশ টাকা টিকিটের বিনিময়ে শুধুমাত্র নীচের তলাতেই ঘোরাঘুরি করা যাবে। কিন্তু সংগৃহিত দ্রব্যের ছবি তুলতে পারবেন না, সংগ্রহশালার সামনের বরান্দাটাতেই শুধু ছবি তোলা যায়, সংগৃহিত সামগ্রী রাখা ঘরগুলোর ছবি তুলতে দেয় না। দ্বিতীয় তলে ঢোকার কোন সুযোগও মিলবে না। শুনলাম এই দ্বিতীয় তলে রাজপরিবারের বংশধরের কোনো একজন বর্তমানে বাস করে, এছাড়াও এই বংশের কেউ আসলে এখানেই থাকে। সংগ্রহশালার বিভিন্ন কক্ষে সংরক্ষিত সামগ্রীগুলো রাখা আছে। খেলা কক্ষে একটা বিশাল বিলিয়ার্ড বোর্ড রয়েছে, অস্ত্র কক্ষে নানারকম অস্ত্রে ভর্তি আছে , সংগীত কক্ষে তানপুরা, তবলা, সেতার , হারমোনিয়াম আছে , পুস্তক কক্ষে বিভিন্ন পুস্তক ও কিছু চিঠি রাখা আছে , বিশ্রাম কক্ষে একটা অতীব সুন্দর পালংক আছে, শিকার কক্ষে শকুন, হরিণ, বাঘ প্রভৃতির প্রমাণ মাপের প্রতিমূর্তি করে সংরক্ষণ করা আছে। এখানকার একজন কর্মচারী জানালো বাঘের চোখ দুটো বাদে বাকি সব আসল। সংগ্রহশালাটি জমিদারদের আভিজাত্যের ধারক বাহক বলা যায়। এই রাজপরিবারের সংগীতের প্রতি খুবই অনুরাগ ছিল তা এদের সংগীত কক্ষে গেলে বোঝা যায়। ভারতের বিখ্যাত সব উস্তাদরা এক সময় এখানে সংগীত পরিবেশন করে গেছেন। লেখা-পড়া ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আকর্ষণ যে কিছু কম ছিল না তা এদের সংগ্রহশালাটি দেখলে বোঝা যায়। ছবি তুলতে দেয় না বলে সংগৃহিত সামগ্রীর ছবি আপনাদের দেখাতে পারলাম না।
যখন একটা সিনেমা দেখতে গেলে আমাদের তিন চারশো টাকা ব্যয় করতে হয়, তখন মাত্র ১০ টাকা বিনিময়ে এরকম একটা সুন্দর সংগ্রহশালা দেখার সুযোগ পাওয়া সত্যি অকল্পনীয়। এছাড়াও এখানে দু-তিন ঘন্টা সময় কাটানোর এক মনোরম জায়গা।
কি ভাবে যাবেন :-
ধর্মতলা থেকে সরকারী-বেসরকারি বাসে করে নূরপুর লঞ্জঘাটে আসতে হবে। বাসে ঘন্টা তিনেক সময় লাগবে। ওখান থেকে লঞ্চে করে গেঁওখালী আসতে হবে। গেঁওখালী থেকে টোটো করে মহিষাদল রাজবাড়িতে পৌঁছনো যাবে।
তারিখ : ১০-০২-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment