Sunday, February 3, 2019

রসে ভরা গোল্লা Rosogolla >


রসে ভরা গোল্লা


বড়ো বড়ো, সাদা সাদা, গোল্লা, গোল্লা রসে একেবারে টইটুম্বুর, সম্পূর্ণ রসালো, যার পোশাকি নাম রসগোল্লা। রসগোল্লার নাকি আজ আবার জন্মদিন। আমরা জন্মদিন হতে দেখেছি মানুষের, এছাড়া বিভিন্ন পোষ্যের বা পুতুলেরও জন্মদিন পালন করতে ছোটবেলায় মাঝে মধ্যে দেখেছি। কখনও কোনো খাবারের জন্মদিন পালন হতে আগে দেখিনি। গতবছর আজকের দিনেই অথার্ৎ ১৪ই নভেম্বর, ২০১৭ সালে বাংলার এই রসালো গোল্লাটি ওড়িশার গোল্লার সাথে তুমুল লড়াই করে জয়লাভ করেছিল। তাই সারা বাংলা এই দিনটিকে মনে রাখার জন্য "রসগোল্লা দিবস" হিসেবে প্রতি বছর পালন করবে বলে ঠিক করেছে। সত্যি আজ বাঙালির গর্বের দিন। আজ সবাই একটা হলেও রসগোল্লা খেয়ে গর্ব সহকারে দিনটা উৎযাপন করুন।

বাঙালিদের কোনো অনুষ্ঠান মিষ্টি ছাড়া ভাবা যায় না, তা সে পুজো হোক বা বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠান বাড়ি হোক। উৎসব-পার্বণ বা অতিথি আপ্যায়নেও রসগোল্লা বাঙালির সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। মিষ্টি প্রিয় বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের মিষ্টি হলো রসে ভরা সাদা এই গোল্লাটি । সম্পূর্ণ ছানা দিয়ে তৈরী করা হয় একে, তাই অত্যন্ত পুষ্টিকরও। সাধারণ রসগোল্লার মত স্পঞ্জ রসগোল্লাও সমান জনপ্রিয়, আর শীতের সময় নলেন গুড়ের রসগোল্লার স্বাদতো একেবারে লা জবাব।

১৮৬৪ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলে চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস একটা মিষ্টির দোকান খোলেন। এই দোকানটি তিনি বেশিদিন চালাতে পারেননি।  এই দোকানটির  দু বছর  পর কলকাতারই বাগবাজার অঞ্চলে ১৮৬৬ সালে তিনি  আরেকটা মিষ্টির দোকান চালু করেন।  এই দোকানটিতে তিনি প্রধানত সন্দেশ জাতীয় মিষ্টি বিক্রি করতে থাকেন। শহরে বণিকদের এই সন্দেশের স্বাদে মন ভরছিল না।  তারা নতুন কোনো মিষ্টির স্বাদ পেতে চাইছিলেন। নবীন চন্দ্র দাসও  নতুন স্বাদের কোনো মিষ্টি তৈরির গবেষণা করছিলেন। রসগোল্লার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় বাগবাজারের চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস রসে চোবানো ১৮৬৮ সাল নাগাদ যে গোলাকার মিষ্টি তৈরি করেন , সেটাই নাকি আজকের রসগোল্লা। কঠোর অধ্যাবসায় ও অদম্য মনের জোরে দু বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে নবীন ময়রা এই রসগোল্লা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং বাঙালিকে তার মনের মত একটা  মিষ্টি উপহার দিয়েছিলেন।  


 কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলেন অধুনা বাংলাদেশের বরিশালই নাকি এর উৎপত্তিস্থল। পর্তুগিজদের আমলেই সেখানকার ময়রারা ছানা, দুধ, সুজি ও চিনি দিয়ে এইরকম গোলাকার মিষ্টি তৈরি করেছিল, যা ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে ওখানকার ময়রাদের বংশধররাই পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় বিস্তার লাভ করে। 

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৫ সালে ভারত সরকারের সংস্থা " জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন অফ ইন্ডিয়া" (জি আই) এর কাছে আবেদন করে পশ্চিমবঙ্গকে রসগোল্লার আবিষ্কারক হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। এই জি আই সংস্থাই রাজ্যগুলির নিজস্ব সম্পদের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। ওড়িশা  সরকার একই দাবী করতে থাকে। রসগোল্লার আবিষ্কার প্রথম কোন প্রদেশে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ না ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গের দাবীর  পড়েই  এই প্রশ্নটি উঠে আসে।  পশ্চিমবঙ্গের দাবীর সাথে সাথেই ওড়িশার  সাথে তুমুল দ্বন্দ্ব বেঁধে  যায়। এই নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই চলতে থাকে। অবশেষে গত বছর এই দিনে জি আই জানায় যে পশ্চিমবঙ্গই রসগোল্লার আসল মালিক। তারাই রসগোল্লার আবিস্কারক।  একদম সনাতন পদ্ধতিতে তৈরী খাঁটি বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের মিষ্টি রসগোল্লাই সবশেষে সরকারি খেতাবটি জিতে নেয়। অবশেষে রসগোল্লার বাঙালি বা বাঙালির রসগোল্লারই জিৎ হয়। গর্বিত হওয়ার মতোই এই ঐতিহাসিক জয়। এই সাফল্যের স্বাদ সব অর্থেই খুব মিষ্টি হয়ে ওঠে। 



ওড়িশা  সরকার বলেছিল কয়েক শতক ধরে পুরীর জগন্নাথকে প্রসাদ হিসেবে রসগোল্লা দেওয়া হয়। তারা দাবী  করে যে রসগোল্লার রেসিপি ওড়িশা  থেকেই পশ্চিমবাংলায় গেছে। কারণ হিসেবে তারা বলে বহু বাঙালি পরিবারে ওড়িয়া পাচক রান্নার কাজ করতো, তারাই এই রসগোল্লার রেসিপিটা নিয়ে যায়। তারা আরো বলে বহু গবেষণা পত্রে এই সম্বন্ধে লেখা রয়েছে। তাদের এই দাবীর পেছনে তারা নানারকমভাবে প্রমান দিতে থাকে।  

পশ্চিমবঙ্গ সরকার দাবী  করে  ওড়িশাতে  যে রসগোল্লা পাওয়া যায় তার সাথে এখানকার রসগোল্লার অনেক ফারাক রয়েছে।  এখানে যে রসগোল্লার তৈরী হয় সেটা সম্পূর্ণ ছানা থেকেই তৈরী করা হয়, সেখানে ছানার সাথে অন্য কিছু মেশানো হয় না।  কিন্তু ওড়িশা বা অন্য জায়গায় যে রসগোল্লা বলে মিষ্টি পাওয়া যায় তাতে ময়দা বা খোয়া ক্ষির, সুজি মিশিয়ে তৈরী করা হয়।  দুটির পদ্ধতিগত ফারাকের জন্যই  স্বাদের আকাশ পাতাল ফারাক হয়ে যায়।  

রসগোল্লার আবিস্কার যেখানেই হোক তা নিয়ে বাঙালিরা খুব একটা চিন্তিত নয়, তাদের পাতে সুস্বাদ বজায় রেখে এই মিষ্টিটা পড়লেই তারা খুশি। শ্রদ্ধেয় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯২ সালে তাঁর লেখা  গানে "আমি কলকাতার রসগোল্লা" বলে দাবী  করে গেছেন, সেই গান জনপ্রিয়তার শীর্ষেও পৌঁছেছিলো। রসগোল্লা আজ আর শুধু কলকাতার বা বাংলার নয়, সারা পৃথিবীই এর রসের কাছে, এর স্বাদের কাছে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে।

রসগোল্লা যে বাংলারই সৃষ্টি জি.আই  শংসাপত্র পাওয়াতে সরকারিভাবে তা প্রমাণিত হয়ে গেলো। বাংলার এই অহংকার ওড়িশা বা আর কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না। বাংলার মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা এই রায়ে খুবই উচ্ছসিত। বাংলার  রসগোল্লা শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষে পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়, কলকাতা বা তার আশপাশ থেকে প্রচুর রসগোল্লা বিদেশে নিয়মিত রপ্তানি করা হয়ে থাকে।  


আজ শিশু দিবস, শিশুরা খুব আনন্দ করো,  সারাদিন ধরে চকোলেটের সাথে রসগোল্লার স্বাদও নিও। সব শেষে চুপি চুপি আর একটা কথা বলি ডায়াবেটিক রোগীদের, আপনারা আজ ভুল করেও রসগোল্লার স্বাদ নিতে যাবেন না যেন , আজ আপনাদেরও দিন, আজ আবার "বিশ্ব ডায়াবেটিক ডে" তাই একটু সাবধানতা অবলম্বন করুন

রসগোল্লার মালিকানা নিয়ে যত বিতর্ক হয় হোক।  রসগোল্লা যে বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বরাবর ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।  রসগোল্লা দেখলে বাঙালির জিভে সবসময়ই জল আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।  



তারিখ :০৯-০২-২০১৯
ছবি : সংগৃহিত

লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া



 আমার এই লেখাটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


1 comment:

habib kajol said...

সুন্দর পোষ্ট । ভালো লাগলো । ধন্যবাদ আপনাকে । বগুড়ার বিখ্যাত দই এব ৫০+ রকমের সু-স্বাদু মিষ্টি নিয়ে এই সাইটটি দেখতে পারেন ।
"অনলাইন দই & মিষ্টি সার্ভিস"