আভিজাত্যের অহংকার আজ অস্তাচলে
নহবত -
ভারতবর্ষে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সুনাম আছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। বাদ্যযন্ত্রকে সাধারণত তাদের গঠনগত তারতম্যের ভিত্তিতে চার ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন ঘট বাদ্য , আনদ্ধ বাদ্য, শুষি বাদ্য ও তত বাদ্য। কোনো ধাতু দিয়ে তৈরি বাদ্য যন্ত্রকে ঘট বাদ্য, চামড়া দিয়ে ঢাকা কোনো বাদ্যকে আনদ্ধ বাদ্য, তারের সাহায্যে যে যন্ত্রকে বাজানো হয় তাকে তত বাদ্য বলে, যে যন্ত্রের গায়ে ফুটো থাকে তাকে শুষি বাদ্য বলা হয়ে থাকে। সানাই একপ্রকার শুষি বাদ্য। সানাই দুটি রিডযুক্ত ওবো শ্রেণীর শুষি বাদ্য । কারুকার্য করা কাঠের নলের একপ্রান্তে থাকে দুটি রিড আর অপরপ্রান্তটি ধুতরো ফুলে মত ছড়ানো থাকে। এই নলের গায়ে সুর তোলার উপযোগী ফুটো থাকে। প্রায় দেড়ফুট লম্বা এই যন্ত্রটিকে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়। পারস্য উপমহাদেশের "সূরনা" নামক এক জায়গা থেকেই সম্ভবত এই সানাইয়ের উৎপত্তি হয়েছিল বলে সবার ধারণা। সানাই হচ্ছে সাপুড়েদের "পুঙ্গীর " জাতীয় বাজ্নাটারই উন্নত সংস্করণ বলে সবাই মনে করে। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এই বাজনা বাজানো হয়। সানাই বাদকের সাথে আর একজন সহযোগী সানাই শিল্পী ও একজন টিকারা নামক একপ্রকার তালযন্ত্র বাজান। সহযোগী সানাইবাদক মূল সানাইবাদকের সুরকে অবিচ্ছিন্ন রাখার জন্য টানা বাজাতে থাকেন। এই তিনজন অর্থাৎ মূল সানাইবাদক, সহযোগী সানাইবাদক ও টিকারাবাদক মিলে একটা দল তৈরী হয়। এই দলকে রৌশন চৌকি বলে। বর্তমানে এই রৌশন চৌকি বসানোর রেওয়াজ আর নেই বললেই চলে। তবে ব্যান্ডপার্টির সাথে সানাইকে এখনো বাজাতে দেখা যায়। রাগসঙ্গীতের উপযোগী যন্ত্র হিসেবে সানাইয়ের ব্যবহার বিশেষ ভাবে দেখা যায়।
-------------------------------------------------------
তারিখ : ০৩-০২-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
![]() |
রৌশন চৌকি |
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসতাম ক্ষমতাসম্পন্ন পরিবারের বিয়ে বাড়ির প্রবেশপথে একটা গেট থাকতো আর এই গেটের ওপরে তিন-চারজন বসার মত সুন্দর করে সাজানো একটা ঘর করা হতো। এই ঘরের মধ্যে একটা চৌকি পাতা থাকত। এই ঘরের মধ্যে ওই চৌকির ওপর দেখা যেত তিন-চারজন ধবধবে সাদা ইস্ত্রি করা পাজামা - পাঞ্জাবী পরে, আবার শীতের সময় পাজামা -পাঞ্জাবির সাথে রাজসিক জওহর কোর্ট পরে বসত। তাদের মধ্যে দুজন কাঠের নলে মুখ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছেন আর একজনকে দেখা যেত টিকার নামে একটা যন্ত্র বাজাচ্ছে। ওদের কাছাকাছি পৌঁছলে দেখা যেত জায়গাটা আতরের গন্ধে ভরপুর। তারা সানাইয়ের মধুর আওয়াজে বিয়ে বাড়িকে উৎসব বাড়িতে পরিবর্তন করে দিতেন। এই সানাইয়ের সুরে সুরেই হবু দম্পতিকে বিয়ে অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে নিয়ে আসা হতো।
আজ আর কোনো বিয়ে বাড়িতে এরকম নহবত মণ্ডপ দেখা যায় না, দেখা যায় না সেরকম সানাইবাদকদের দলকেও । এখন সানাইয়ের বদলে সেখানে বাজে চটুল হিন্দি গান। কোথাও কোথাও আজ আবার ডিজের আওয়াজে বিয়ে বাড়ি সরগরম হয়। তবে এখনও কিছু বনেদি পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে বা অন্য কোনো অনন্দানুষ্ঠানে সানাইয়ের কদর দেখা যায়। সেটা সংখ্যায় খুবই কম। শোভাবাজার রাজবাড়িতে দশমীর দিনে এখনও নহবত বসে বলে শুনেছি। তাঁরা এই সানাইয়ের করুন সুরেই মাকে অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানায়। এই প্রথা এই রাজবাড়িতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।
বিসমিল্লাহ খাঁ সানাই বাজনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ছিলেন। লোকবাদ্য হিসেবে প্রচলিত যন্ত্র সানাইকে আনুষ্ঠানিক সংগীতসভার মঞ্চে উপস্থাপন ও সুধী সমাজে একে জনপ্রিয় করে তোলার একক কৃতিত্ব তাঁরই। বিসমিল্লা খাঁ তার মামা বিলায়েত খানের হাত ধরে প্রথম কলকাতায় সানাই বাজাতে আসেন। তিনি ১৯৩৭ সালে কলকাতার অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সানাই বাজিয়ে যন্ত্রটিকে নতুনভাবে পরিচিত করান। এই শিল্পীই সানাইকে আজ উচ্চাঙ্গ সংগীতের মঞ্চে পৌছে দিয়েছেন। সানাই নামক বাদ্যযন্ত্রকে ফুঁ-এর জাদুতে তিনি কথা বলাতে পারতেন । সানাইকে তিনিই বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির লালকেল্লায় বিসমিল্লা খাঁ সাহেব অন্তরের মাধুরী ঢেলে "কফি" রাগ পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর বাজনা শুনে উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। ভারতের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে এক বিসমিল্লা খাঁ অবিস্মরণীয় নাম। সানাইকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বাদনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে এই অমর শিল্পী ভারতের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে "ওস্তাদ" উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে তিনি তৃতীয় ব্যক্তি যিনি "ভারতরত্ন" পদক পেয়েছেন। তিনি ছিলেন অল্পসংখ্যক গুণীদের মধ্যে একজন যিনি ভারতের চারটি সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকে সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর যোগ্যতায় সানাই এবং ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব সমার্থবোধক হয়ে গেছে তখনকার আমলে তামিল হোসেন , আলী হোসেন খান, পন্ডিত রঘুরাম প্রশান্ত সব দিকপাল সানাইবাদক ছিলেন।
আভিজাত্যের এই অহংকার আজ অস্তাচলে। বাঙালি বিয়েতে সানাইয়ের মধুর ধ্বনি আজকাল প্রায় একদমই শোনা যায় না। আজ আর বাঙালির নহবত সংস্কৃতি খুব একটা দেখা যায় না। ওয়াটগঞ্জ বা চিৎপুরের সানাই শিল্পীদেরও সেই দিন আজ আর নেই। কাজের অভাবে নতুন প্রজন্মও আর সানাই বাজতে আসছে না।
--------------------------
তারিখ : ০৩-০২-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment