Saturday, February 9, 2019

মোনালিসা Monalisa>



মোনালিসা


মোনালিসা নাসরিন 


"মোনালিসা", এই নামটা বা শব্দটা শুনলেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা সেই পৃথিবী বিখ্যাত ছবিটার কথাই সবার আগে  মনে আসে, কিন্তু আমি সেই মোনালিসার কথা আপনাদের বলছি না। আজ আমি মোনালিসা নামে বাংলার এক অনামী তরুণীর জীবন সংগ্রামের মর্মস্পর্শী কথা জানাবো। যে সংগ্রামী জীবন কোনো ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসেনি, সম্পূর্ণ সত্য ও বাস্তব এক জীবন কথা। এই তরুণীকে আমি প্রথম দেখি "কলকাতা মিনি মেকার ফেয়ার" নামে এক বিজ্ঞান মেলায়। সেই মেলায় তরুণীটি  তাদের তৈরী বেশ কিছু সৌরবিদ্যুতের সরঞ্জাম ও এল.ই.ডি আলো নিয়ে এসেছিলো। পরবর্তীকালে ব্যবসায়িক কারণে তার সাথে আরো কয়েকবার আমার দেখা হয়েছে। সেইসব সময় আলাপচারিতায় তার জীবন সংগ্রামের কথা আমি জেনেছিলাম।


মোনালিসা নাসরিন, মাত্র ২২ বছরের একজন গরিব সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়ে। যার অদম্য ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু গরিব পরিবারে সে জন্মেছে, তাই পদে পদে নানারকম বাঁধার সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে। সে সব বাঁধাকে অনায়াসে জয় করে পড়াশুনার সাথে সংসারের সব দায়িত্বও আজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। যখন তার ১৮ বছর বয়স তখন পড়াশুনা ছাড়িয়ে দিয়ে বিবাহ দেওয়ার জন্য তার পরিবারের লোকেরা উঠে পড়ে লেগেছিলো। তার বাবা ব্যবসায়িক সূত্রে দিল্লিতে ছিলেন।মোনালিসার লেখা-পড়া সেখানেই শুরু হয় । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। বাবা মার সাথে মোনালিসাকেও সব ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়। তার পরিবারও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে  যায়। বহু কষ্ট করে সে তার স্কুলজীবন শেষ করে। সেই সময় থেকে পড়াশুনা করে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তোলাই তার জীবনের ব্রত হয়ে উঠেছিল।


মোনালিসা ও অধ্যাপক রাজীব গাঙ্গুলি 


তার ইলেক্ট্রনিকস নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খুব ইচ্ছে। কিন্তু পরিবারের সকলে তার এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তাদের মত, গরিব ঘরের মেয়ের উচ্চ শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই, একটা ভালো পাত্র দেখে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়াই সব থেকে উচিত কাজ হবে। কিন্তু মোনালিসার অদম্য জেদের কাছে পরিবারের লোকেরা হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তাদের আর্থিক ক্ষমতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো সম্ভব হয় না। তারা মোনালিসাকে ২০১৪ সালে যোগমায়াদেবী কলেজে রসায়ন নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি করে দেয়। কিন্তু রসায়নের রস মোনালিসার মন ভরাতে পারলো না। ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়ার মনোগত ইচ্ছাকে সে কিছুতেই ভুলে রসায়নে মন দিতে পারছিলো না । এইভাবে একটা বছর  পার  হয়ে গেলো। মোনালিসা এই এক বছরের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করে ফেলে । এই টাকা দিয়ে ২০১৫ সালে সে কলকাতার ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ম্যানেজমেন্টে  (UEM, Kolkata) ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হলো। তার দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস ও সততার কাছে সব কিছু পিছু হটে যায়। ৪০ হাজার টাকা দিয়ে সে কলেজে ভর্তি হলেও পরবর্তী সেমিস্টারের টাকা কোথা থেকে আসবে সেই চিন্তা তাকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। সে অত্যন্ত সাহসী ও মেধাবী ছাত্রী। সে তার ভালো রেজাল্টের সাহায্যে স্কলারশিপ পায়। সেই টাকায় সে তার পরবর্তী সেমিস্টারগুলো অনায়াসে পার করে দিয়ে  আজ চতুর্থ বর্ষে পৌঁছে গেছে।


মোনালিসার সাথে আমরা

সংখ্যালঘুদের জন্য সরকার যে স্কলারশিপ দেয়, মোনালিসা তার ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় প্রচুর হাঁটা-হাঁটি করে এই স্কলারশিপ আদায় করেছিল। শুধু তার নিজের জন্য নয়, পরবর্তীকালে তার নেতৃত্বে লড়াই করে এই ইউনিভার্সিটির প্রায় ২০০ জন মেধাবী সংখ্যালঘু ছাত্র - ছাত্রী আজ এই সুবিধা ভোগ করছে। তার এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তার ইউনিভার্সিটি তাকে ২০১৭ সালে বিশেষ উৎকর্ষ পুরস্কারে ভূষিত করে।


মোনালিসা ও ওর ইউনিভার্সিটির 
ডিন অধ্যাপক রাজীব গাঙ্গুলি  

এদিকে দিনকে দিন তার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। মোনালিসাকে তখন বাধ্য হয়েই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। তার ইউনিভার্সিটির ডিন অধ্যাপক ডঃ রাজীব গাঙ্গুলী মহাশয় তার জীবন সংগ্রামের কথা জেনে ও তিন বছর ধরে তার যোগ্যতা ও ক্ষমতা চাক্ষুস করে তাকে নিয়ে "RMB Technology" নামে একটা ব্যবসা চালু করে। তারা সৌরবিদ্যুৎ ও LED-র নানারকম সরঞ্জাম তৈরী করতে আরম্ভ করে। গতবছরের  মেলায় মোনালিসা তাদের তৈরী দ্রব্য ও ব্যবসার উদ্দেশ্য আমায় বুঝিয়েছিল । সে বলেছিলো গ্রাম্য জীবনে ও সাধারণ জীবনে কম খরচে সৌরবিদ্যুৎকে পৌঁছে দেওয়াই তাদের ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য। ওই মেলায় তাদের তৈরী সোলার লণ্ঠন, সোলার সাহায্যে চলা যন্ত্রের মাধ্যমে আবর্জনাকে ধ্বংস করার যন্ত্র, মোবাইলের সাহায্যে ঘরের আলো -পাখা বা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্যের চালু করা বা বন্ধ করার জন্য হার্ডওয়ারও তারা বাজারে এনেছে বলে জানিয়েছিল।



মোনালিসা তার শক্ত কাঁধে ব্যবসার বেশিরভাগ দায়িত্ব নিয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত। পড়াশুনার সাথে ব্যবসা, আর ব্যবসার সাথে সংসারের অথনৈতিক দায়িত্বও সে আজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আজ সে অনায়াসে পড়াশুনার সাথে ব্যবসা ও পরিবারের দায়িত্ব সামলাচ্ছে।



কারো অদম্য ইচ্ছা, ভবিষ্যতের লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, তাহলে অভাব-অনটন বা অন্য সব বাঁধাকে অবহেলার সাথেই পার করা যায়। নিজের স্বপ্নকে পূরণ করা যায়। মোনালিসা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।মোনালিসাকে আমার তরফ থেকে অসংখ্য ধ্যনবাদ জানাই। তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য আমার তরফ থেকে অফুরন্ত আশীর্বাদ রইলো।

তারিখ : ০৯-০২-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী


 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

No comments: